পেনসিলের প্রতিশ্রুতি-৫: স্বপ্নলোকের চাবি

Spread the love

পেনসিলের প্রতিশ্রুতি-৪

pencil1বারানসীর গঙ্গানদী পৃথিবীর অন্যতম ময়লা নদী – শিল্প ও মানব বর্জে দূষিত। কিন্তু একই সঙ্গে তা পৃথিবীর অন্যতম পবিত্রও বটে। বারাকা সিনেমাতে দেখার পর থেকে আমার ইচ্ছে আমি এই নদীর তীর ধরে হাটবো। আমাদের জাহাজ যখন সমুদ্র ঝড়ে পড়ে, তখন আমি অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি প্রার্থনা করেছি। আর একটি উদ্দেশ্য পূরণের জন্য বাঁচতে চেয়েছি। আর এখন আমি সেই উদ্দেশ্যকে খুঁজে ফিরছি।

ভারতে আমার প্রথম রাতে আমি ব্যাপক জ্বরে আক্রান্ত হই। তারপরও সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমি ঠিকই ট্রেনে উঠে। আগ্রাতে রেল স্টেশনে যাবার পথে আমি প্রথম এমন দৃশ্য দেখি যা আমি আগে কখনো দেখিনি। খালি পায়ের একদল শিশু, আপাদমস্তক ধুলিধুসরিত, খাবার আর টাকা ভিক্ষা করছে!ছোট্ট মানুষগুলো একােবারেই একা। আমি দেখেছি চার বছরের শিশুর কোলে ছয় মাসের শিশু!!! আমাদের কেও কেও বাচ্চাদের জন্য খাবার কিনে আনলো। সারারাত আমি ভেবেছি এই বাচ্চাদের জন্য আমি কী করতে পারি।

পরের দিন সকালে আমরা গেলাম আগ্রা দুর্গে। তাজ মহলের কাছে লাল ইটের এই দালান এক আশ্চর্য সুন্দর স্থাপনা। কিন্তু আমি কিছুতেই মন বসাতে পারলাম না। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম আমার প্রশ্নটি আমি এই শিমুদের একজনকে করবো। ওদের কিছুই নেই। যদি পৃথিবীর কোন জিনিষ যদি পেতে পারে, তাহলে ওরা কী চাইবে?

আমি আমার দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম এবং খুঁজে পেলাম বাদামী চোখের এক বালককে। ও একটু আগেও ভিক্ষা করছিল। এখন এক জায়গায় বসে আছে। আমি যখন তার দিকে আগালাম তখন এক লোক আসলো আমার কথা অনুবাদ করে দেওয়ার জন্য।

আমি প্রত্যকে দেশের একটি শিশুকে একই প্রশ্ন করছি- শিশুটি যা চাইবে তাই পাবে। তাহরে সে কী চায়?
ছেলেটি কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললো-

pencil3“একটি পেনসিল”।

“তুমি শিওর?” আমি জানতে চাইলাম। ওর কোন ফ্যামিলি নাই, কিছুই নাই আর ও কি না এমন বেসিক জিনিষ চাইলো।

আরো অনেকে তখন আমাদের ঘিরে ধরেছে। “আরে যা খুশী চাও। ও তোমাকে সেটা দিতে পারে।”

ছেলেটি তার চাহিদায় অটল থাকলো – একটি পেনসিল।

আমার ব্যাকপ্যাকে একটা ২ নম্বর পেনসিল আছে। সেটি বের করে আমি তার হাতে দিলাম।
আমার হাত থেকে তার হাতে যখন পেনসিলটি গেল, তখন এক আশ্চর্য আলোতে তার চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। মনে হয় যেন হাতে একটি হীরা পেয়েছে এমনভাবে সে পেনসিলের দিকে তাকালো।

অনুবাদক মানুষটি আমাকে জানালো ছেলেটি কখনো স্কুলে যায়নি, কিন্তু সে দেখেছে অন্য ছেলেমেয়েরা পেনসিল দিয়ে লেখালেখি করে। আমি খুবই অবাক হলাম যে ছেলেটি কোন স্কুলে যায় নি দেখে। পরে বুঝলাম পৃথিবীর কোটি কোটি ছেলেমেয়েই হয়তো স্কুলে যায় না।

আমার জন্য পেনসিল একটা লেখার উপকরণ কিন্তু তার কাছে এ এক স্বপ্নলোকের চাবি। প্রতীক। সৃজনশীলতা, কৌতুহল আর সম্ভাবনার উন্মোচিত দ্বার। সব বড় বড় আবিস্কারক, স্থপতি, বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ – সকলে নিজের ছোটবেলায় একটি পেনসিল দিয়ে তাদের সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। একটি কাঠের লাঠি আর গ্রাফাইট মিলে তার সমানে উন্মোচিত করেছে এক বিশাল জগৎ।

এই ঘটনার আগ পর্যন্ত আমি সব সময় ভেবেছি আমার মত ছোট মানুষকে দিয়ে কিছুইই হবে না।
কিন্তু একটা ছোট্ট পেনসিল আমার ধারণাটাকে আমুল পাল্টে দিল।

 

Leave a Reply