কোন বিষয়ে পড়ব?
গত ৩৫ বছরে কর্ণফুলীতে অনেক পানি গড়িয়েছে, পৃথিবী এখন আর ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সীমাবদ্ধ নেই। এর ডালপালা গজিয়েছে অনেক, বিস্তৃত হয়ে তৈরি করেছে নানান সম্ভাবনাও। এই যেমন ধরা যাক ফেসবুকের কথা। মার্ক জাকারবার্গের হাতের এই জাদু এখন বিশ্বের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন ব্যবহার করে। এর প্রভাব এখন এত বেড়েছে যে নতুন একটি চাকরির ক্ষেত্রও তৈরি হয়ে গেছে—ফেসবুক মার্কেটিং বা সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং। আর সেই মার্কেটিং করার জন্য যত না মার্কেটিংয়ের বিদ্যাবুদ্ধি লাগে, তার চেয়ে বেশি লাগে সৃজনশীলতা এবং নেটওয়ার্কিং দক্ষতা। কে জানে, আগামী ১০ বছরে এমন নতুন কিছুর আবির্ভাব হবে কি না!
এখন তাই কোন বিষয়ে তুমি পড়ছ, তার চেয়ে বেশি দরকারি হচ্ছে তুমি নিজেকে একুশ শতকের দক্ষতায় ঋদ্ধ করছ কি না। একুশ শতকের দক্ষতার মধ্যে প্রধান চারটি হলো—সহযোগিতা ও দলীয় কাজ, কল্পনা ও সৃজনশীলতা, ‘ক্রিটিকাল থিংকিং’ এবং সমস্যা সমাধানের পটুত্ব।
ভালো করে একবার দেখো তো এই তালিকা—এটি দেখে কি কোনো একটি বিষয়ের কথা তোমার মনে হয় যে বিষয় পড়লেই তুমি এই দক্ষতা অর্জন করতে পারবে?
না, আলাদা করে সে রকম কোনো বিষয় নেই। এর মানে হলো তুমি যেকোনো বিষয়ে ডিগ্রি নিয়েও এই দক্ষতা অর্জন করতে পারো। তাহলে তুমি কোন বিষয়ে পড়বে?
তোমার যেটা ভালো লাগে। সেটা যে বিষয়েই হোক। তুমি তুলনামূলক সাহিত্য পড়তে পারো, তুমি ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষের ভাষা যোগাযোগ বিষয়ে পড়তে পারো, তুমি প্রকৌশল পড়তে পারো, তুমি আইন পড়তে পারো অথবা তুমি তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের একেবারে গভীরে যেতে পারো। কোনো অসুবিধা নেই।
তা তোমার পছন্দের বিষয় পড়ার সময় তুমি কী করবে? জবাব দিয়েছেন মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। তিনি বলছেন, তুমি যা পড়ছ সেটির গভীরে যাও, সেটির সর্বোচ্চ রস আস্বাদন করো। কারণ, সেটি তুমি ভালোবাসো।
এরই মধ্যে তুমি হয়তো ভাবছ, দুনিয়ায় এখন চারদিকে তথ্যপ্রযুক্তি আর প্রোগ্রামারদের জয়জয়কার। সে ক্ষেত্রে অর্থনীতি বা গণিত পড়ে কি তুমি তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে?
এ জবাবটাও বিল গেটস দিয়েছেন—সবার তো প্রোগ্রামার হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু তোমাকে জানতে হবে প্রোগ্রামাররা আসলে কী পারে আর কী পারে না।
তুমি সৃজনশীল লেখালেখিতে (আমাদের দেশের সৃজনশীল মুখস্থ পদ্ধতি নয়) ডিগ্রি করতে পারো, তুমি মাউন্টেনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি করতে পারো। একসময় আমরা কেবল দেখেছি ব্যবসা প্রশাসনের ডিগ্রি। এখন কিন্তু এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপেরও ডিগ্রি করা যায়। এই বাংলাদেশে এখন এমনও বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে পড়তে পড়তেই সবার চাকরি হয়ে যায়। চট্টগ্রামের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ-কারবার পশুদের স্বাস্থ্য নিয়ে!
দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন গবেষণার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। অনেকে পড়ছে, কাজ করছে। পরিবেশবিজ্ঞান কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত বিষয়গুলোও ইদানীং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা সমুদ্রবিজ্ঞান, জিন প্রকৌশল, মেডিকেল ফিজিকস অ্যান্ড বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো অল্প পরিচিত বিষয়গুলোও পড়ছে, ভালো করছে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, সব ডিসিপ্লিন কিন্তু এখন ওপরে উঠে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। করপোরেট হাউস বা সরকারগুলো এমন লোক খুঁজছে, যারা সমস্যার সমাধানে যেমন দক্ষ তেমনি সৃজনশীলও। নতুন কিছু তারা করে, সেই সঙ্গে পুরোনো সমস্যারও সমাধান করে। একই সঙ্গে ‘প্রোটোকল’ সামলাতে পারে আবার ‘ফেসবুকে’ পাওয়া সমস্যার সমাধানও দিতে পারে।
তুমি হয়তো এমন কিছু পড়তে চাও, যেটি এ দেশে পড়ার সুযোগ নেই। তুমি তোমার পছন্দের বিষয়ের কাছাকাছি কোনো বিষয়ে ভর্তি হয়ে ইন্টারনেটেই তোমার কাঙ্ক্ষিত বিষয়টির আদ্যোপান্ত জেনে নিতে পারো। এবং হাজির হতে পারো ভাইভা বোর্ডে।
৭০০ কোটি মানুষের এই পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি এখন ইন্টারনেটে যুক্ত। ফলে মানুষে মানুষে সম্পর্ক, দক্ষতা অর্জনের জন্য তাদের চেষ্টা, সামাজিক মূল্যবোধ—এসবের মধ্যে প্রযুক্তি ঢুকে পড়েছে প্রবলভাবে। ফলে, শিল্পবিপ্লবের কারণে প্রাযুক্তিক দক্ষতা যেমন মানবিক দক্ষতাকে আলাদা করে ফেলেছিল, তথ্যপ্রযুক্তি সেই ব্যবধানটাকে ভেঙে দিয়েছে। কাজেই মানবিক বিষয়গুলোর গুরুত্ব বেড়ে যাচ্ছে অনেকখানি। সামনে আরও বাড়বে। একইভাবে, প্রযুক্তির জ্ঞানও সীমাবদ্ধ থাকছে না গুটিকয়েক প্রকৌশলীর হাতে। ফলে যে কেউ যেকোনো বিষয় থেকে হাজির হয়ে যেতে পারবে নিজের পছন্দের কর্মক্ষেত্রে। দরকার হবে চট করে শিখে নেওয়ার দক্ষতা, থাকতে হবে সমস্যা সমাধানে পটুত্ব ও দলে-বলে কাজ করার মানসিকতা এবং হতে হবে সৃজনশীল।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষের পথে। এখন তুমি ভাবছ কোথায় পড়বে। অনেকেই নিজের পছন্দের বিষয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না। কিন্তু মনে রেখো, আগামী দশকে যখন তুমি কর্মক্ষেত্রে যাবে, তখন কেউ তোমার কাছে পঠিত বিষয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জানতে চাইবে না!
তারা তোমাকেই জানতে চাইবে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নিজেকে জানার প্রস্তুতিই তাই তোমাকে নিতে হবে।
[২১ মে, ২০১৭ প্রথম আলো’তে প্রকাশিত)