সাকামুক্ত আমাদের বিজয় দিবস

Spread the love
ঢাকার বিজয় দিবসের সাজ। সৌজন্যে – প্রথম আলো

চট্টগ্রাম শহরের চকবাজারের অংশ কাপাসগোলা। সেখানে একাটা বেড়ার ঘরে জন্মের পর থেকে আমার থাকা। যদিও জন্ম হয়েছিল আন্দরকিল্লায়, নানার বাড়িতে। কাপাসগোলার বাড়িটার তেমন স্মৃতি আমার নেই কারণ ৭১ সনে আমরা যখন ঐ বাড়ি ছেড়ে নানার বাড়িতে আশ্রয় নেই তখন আমার বয়স মাত্র ৫ বছর।
তারও আগে ১৯৭০ সালের শেষের দিকে বাবা জার্মানী থেকে একটা ট্রেনিং করে ফিরলেন। সঙ্গে আনলেন ফ্রিজ, টেলিভিশন, কেকবেকিং যন্ত্র, পাউরুটি টোস্ট করার যন্ত্র – এরকম নানান ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র। আমি আর আমার ভাইয়ের জন্য আনলেন দুইটি খেলনা পিস্তল, কাগজের মধ্যে বারুদ লাগানো, রোল করা। গুলি করলে ধোয়া বের হয় আর শব্দ হয়।

তো, ২৫ মার্চের পর পরই দাদা আমাদেরকে পাঠিয়ে দিলেন নানার বাড়িতে। আমি মাত্র সেন্ট মেরিস স্কুলে ভর্তি হয়েছি। স্কুল তো বন্ধই হয়ে গেল। কাজে এদিক সেদিক মাঠে ঘোরাঘুরি। মার্চের ২৮ বা ২৯ তারিখের কোন একদিন আমি খেলার জন্য কিছুটা দূরে এক মামার বাসায় যাই। মামাতো ভাই তৌহিদ আর আমি খেলার পর আমি বাসায় ফিরবো। কি্ন্তু একা একা ফিরতে ভয়। তাই তৌহিদ আমাকে এগিয়ে দিতে আসলো আমাদের বাসায়। কিন্তু একা একা সেও ফিরতে পারে না। তাই আমি তাকে এগিয়ে দিতে আবার গেলাম! এভাবে কয়েকবার আসা যাওয়ার পর তৌহিদের মেজভাই, মইনু ভাই, ব্যাপারটা খেয়াল করলেন এবং আমাকে বাসায় দিয়ে গেলেন।

তার কদিন পরেই আমরা রাউজানে গ্রামের বাড়িতে চলে গেলাম। সে সময়কার স্মৃতি তেমন মনে নেই। পরের অনেক শোনা স্মৃতি থেকে দিনগুলোকে জোড়া লাগানো যায়। রাউজান হল রাজাকার শিরোমনি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীদের এলাকা। আমরা যে খুব নিরাপদ তাই নয়। কাজে কিছুদিন পরে আমাদেরকে পাঠানো হল ইয়াসিন নগরে অন্য একজনের বাড়িতে। ঐ বাড়িতে যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। বিলের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। কয়েক মাইল হেটে যাওয়া। আমার শুধু মনে আছে আমি আর আমার ভাই এই রাস্তার দীর্ধ সময় হয় নাসির চাচা (সাংবাদিক, এখন চট্টগ্রামের দৈনিক সুপ্রভাতের নগর সম্পাদক) কিংবা তসলিম চাচা (স্থপতি, দৈনিক পূর্বকোণের সম্পাদক)-এর কাঁধে চড়ে সেই বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানকার স্মুতি কেবল একটা মনে আছে। খদে পেয়ে বেছি চেচালে আমাকে মুড়ি খেতে দেওয়া হতো।

পরে আমরা সেখান থেকে ফিরে আসি নিজেদের বাড়িতে।

এর মধ্যে দাদা একদিন শহরে এসে কাপাসগোলা থেকে আমাদের বাসার জিনিষপত্র কী মনে করে আন্দরকিল্লায় নানার বাড়িতে রেখে দেন। আমরা যখন ইয়াসীন নগর থেকে আবার বাড়িতে ফিরে আসি তখন জানতে পারি পাকিস্তানীরা আমাদের কাপাসগোলার বাড়িটা সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দিয়েছে। ওখানে কিছু নেই। ১৯৭২ সালে একবার সেখানে গিয়ে আমরা দেখেছি কেবল নিচের পাকা ফ্লোরটি আছে। আর কিছু নেই। ওখানে একটা বহুতল ভবন হয়েছে এখন।

১৭ ডিসেম্বর আমাদের গ্রামে কয়েকজন রাজাকারের নেতৃত্বে একদল পাকিস্তানী সৈন্য প্রবেশ করে। টের পেয়ে বাড়ির পুরুষরা মেয়েদেরসহ আমাদেরকে পেছনের বিলে পাঠিয়ে দেয়। পাকিরা বিভিন্ন বাড়িতে যা পায় সেগুলোতো নিয়েছেই, যাবার সময় ডালপালা দিয়ে ঢেকে রাখা এক চাচার তিনটে বাসে আগুন দিয়ে যায়। আর আমাদের গ্রামের কম বয়স্কদের ধরে বেঁঁধে নিয়ে যায়। রাউজান কলেজে যুদ্ধের সময় পাকিদের আর রাজাকারদের আড্ডা। সেখানে সাকার নেতৃত্বে যে কত লোকরে মারছে আল্লাহ জানেন। আমাদের গ্রাম থেকে রাজাকার আর পাকিরা যখন রাউজান কলেজে গিয়ে ঢোকে ততক্ষণে সেখানকার পাকিদের পতন হয়েছে। রাউজান কলেজ চলে গেছে মুক্তিবাহিনীর হাতে। কাজেই রাজাকার এবং পাকিরা ধরা পড়লো। আর চাচারা সবাই বেঁচে গেলেন।

এই আমার মহান মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা। তবে, এ কেবল আমার গল্প নয়, এ বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষেরই গল্প। আমার চাচারা বেঁচে গিয়েছিলেন মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের জন্য। কিন্তু সবার বাবা কিংবা চাচারা পারেননি। ৩০ লক্ষ শহীদ হয়েছেন। আর তাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের আজকের এই বিজয়।

অমিয় তরফদারের ছবি। প্রথম আলোর সৌজন্যে

এই বছরের বিজয় দিবস অন্যরকম আনন্দের। আমার জন্য সবিশেষ। কারণ বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে যতোবারই বাড়ি যেতাম পথে কুন্ডেশ্বরীর বাড়িটা চোখে পড়তো। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে জানতাম কুন্ডেশ্বরীর মালিককে নিজহাতে হত্যা করেছে সাকা চৌধুরী এবং এ রাজাকারের কোন বিচার হবে না। আমাদের গ্রামসহ পুরো রাউজান দাপিয়ে বেড়িয়েছে সাকার পেটোয়াবাহিনী। ছোটবেলায় শুনতাম সাকার কখনো শাস্তি হবে না। কিন্তু না, আল্লাহতায়ালা শেখের বেটিকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী করেছেন যেন রাউজান কালিমামুক্ত হতে পারে।

সাকাবিহীন বিজয় দিবস কতো আনন্দের, কতো আনন্দ-অশ্রুর তা কেবল রাউজানের লোকেরাই বলতে পারে। ধন্যবাদ শেখ হাসিনা আমাদেরকে আনন্দের একটা বিজয় দিবস উপহার দেওয়ার জন্য।

একটি ক্ষুধা, দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়া স্বপ্ন নিয়ে ত্রিশ লক্ষ শহীদের সেই স্বপ্নের কথা যেন আমরা না ভুলি।আমাদের “যার যা কিছু আছে তাই দিয়ে” যেন আমরা সেই স্বপ্নপূরণের লড়াই অব্যাহত রাখতে পারি।এবারের বিজয়ের আনন্দের আর একটি সোপান কিন্তু আমাদের নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতুর নির্মান শুরু করা। আমরা এখন বিশ্বের ৩৮তম অর্থনীতি। ঘাড় উচু করে আমরা দাড়াতে শুরু করেছি।

মহান বিজয় দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক এই উঠে দাড়ানোর শক্তিকে এগিয়ে নেওয়ার।

সবাইকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।

জয় বাংলা।

Leave a Reply Cancel reply

Exit mobile version