চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব : উদ্যোক্তা হাট থেকে উদ্যোক্তা ক্যাম্প

Spread the love

বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ তরুন-যুবা। দু:খের বিষয় হল, এদের একটি বড় অংশেরই কোন কাজ নেই, কর্মসংস্থান নেই। দেশের বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় তিনকোটি। প্রতিবছরই কর্মবাজারে নতুন ২১ লক্ষ তরুন-তরুনী যুক্ত হচ্ছে। সরকারি চাকরির মাধ্যমে যে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় তা প্রায় সবাই জানেন। বিসিএস পরীক্ষার বিগত কয়েকবছরের পরিসংখ্যান থেকে এই বিষয়টি সহজে অনুমেয়ও বটে। ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় মাত্র ২,০৫২টি শুন্যপদ পূরণের জন্য আবেদন করেছেন  দুই লাখ ২১ হাজার ৫৭৫ জন কর্মপ্রত্যাশী। ৩৩তম বিসিএসে ৪,২০৬ পদের বিপরীতে এই সংখ্যা ছিল এক লাখ ৯৩ হাজার ৫৯ জন, ৩১তম বিসিএসে ছিল ২,০৭২টি পদের বিপরীতে এক লাখ ৬৪ হাজার ১৬৭ জন প্রার্থী। শূন্যপদের তুলনায় আবেদনকারীর সংখ্যা আগামীতে আরো বাড়বে। বিশ্বব্যাপী এগিয়ে যাওয়া ও অগ্রসরমান দেশগুলো এই সমস্যার সমাধান করেছে লক্ষ লক্ষ উদ্যোক্তা তৈরি করে। এই সকল ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের উদ্যোক্তারা একই সঙ্গে দেশজ উৎপাদন যেমন বাড়ান তেমনি তারা কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি করেন। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে এসএমই সেক্টরের উন্নয়ন, নারীদের অধিকহারে স্ব-কর্মসংস্থানে উৎসাহী করে তুলতে পারলে কর্মসংস্থানের একটি বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যায়। বিশ্বব্যাংক তাদের অতি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও কর্মসংষ্থান বাড়াতে পারলে জাতীয় প্রবৃদ্ধি দুই শতাংশ বাড়বে বলে মত দিয়েছে।

DSC_0468 [1600x1200]

তবে, বাংলাদেশে উদ্যোক্তাদের পথ সহজ নয়। বাজারজ্ঞানের অভাব, আর্থিক খাতে প্রবেশঅগম্যতা, মার্কেটিং দুর্বলতা, ভাষাজ্ঞানের দক্ষতার অভাব এবং সর্বোপরি সমাজে উদ্যোক্তা-বিরোধী পরিবেশ নতুন উদ্যোক্তাদের মোটেই উৎসাহ যোগায় না। এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন “বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন)” বিগত কয়েকবছর ধরে স্বতন্ত্র আইটি উদ্যোক্তাসহ উদ্যোক্তা তৈরির জন্য কাজ করে চলেছে। এই জন্য আমরা দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মশালা, প্রশিক্ষণ, সেমিনার, অনলাইন মেন্টরিং-এর আয়োজন করে থাকি। ২০০৭ সালে আমরা যখন ফ্রিল্যান্সিংকে প্রমোট করতে শুরু করি তখন অনেকেই বিষয়টিকে পাত্তা দেননি। বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান এবং সরকার নিজেও এই কাজে এগিয়ে এসেছে। দেশে মুক্তপেশাজীবীর প্রসারে আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্ঠার নানাবিধ সুফল আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে বাংলাদেশী মুদ্রায় এককোটি টাকা আয় করে থাকেন।

ফ্রিল্যান্সিং-এর পাশাপাশি সরাসরি উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য ২০১১ সালের ১৩ এপ্রিল আমরা একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলি। “চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব (www.facebook.com/groups/uddokta/)” নামের এই প্ল্যাটফর্ম থেকে বিগত সময়ে বেশ কিছু নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়েছে। এই গ্রুপের উপজীব্য হল – পথে নামলেই কেবল পথ চেনা যায়। অনলাইন মেন্টরিং ছাড়াও আমরা উদ্যোক্তা ও হবু উদ্যোক্তাদের জন্য বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বিনিময়, দক্ষতা বৃদ্ধি ও নেটওয়ার্কিং-এর নানান আয়োজন করে থাকি। এর ফলে, আমরা লক্ষ করেছি আমাদের সদস্যদের মধ্যে অনেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার কঠিন পথটি বেঁছে নিচ্ছেন। গ্রুপের দ্বিতীয় বছরে আমরা এরকম পথে নেমে পড়া ৩১ জন উদ্যোক্তাকে সম্মাননা জানিয়েছি। সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল আমাদের উদ্যোক্তাদের সম্মাননা জানানোর সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

নবীন উদ্যোক্তা এবং হবু উদ্যোক্তাদের এই প্ল্যাটফর্মে এখন প্রায় ১৬ হাজার সদস্য। এই উদ্যোক্তাদের কেও তৈরি করছে নতুন ডিজাইনের টি-শার্ট, কারো বা পছন্দ জামদানী, কেও ই-কমার্সে বিক্রি করছে বগুড়ার দই, কেওবা বিদেশে পাঠাচ্ছে বাংলাদেশের পন্য। আবার অনেকেই গড়ে তুলছেন তার সফটওয়্যার বা আইটি সেবার কোম্পানি। কৃষি নিয়ে কাজ করছেন এমন অনেকেই এখন এই প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত। এই প্ল্যাটফর্মে আমরা উদ্যোক্তা ও উদ্যোক্তা হতে আগ্রহীদের জন্য পূঁজি সংগ্রহ, প্রতিষ্ঠান গঠন, ব্যবসা উদ্যোগ এগিয়ে নেওয়া, ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট, ইন্টারনেট মার্কেটিং ইত্যাদি বিষয়ে সেমিনার, কর্মশালা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদির আয়োজন করে থাকি। রয়েছে আমাদের মেন্টরিং ব্যবস্থা যাতে সফল উদ্যোক্তা ও বিষয় বিশেষজ্ঞগণ নতুনদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা দেওয়ার জন্য ওম্যান চেম্বারের সদস্যদেরও আমরা প্রশিক্ষণে সহায়তা করে থাকি। স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমেই আমাদের এই সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে থাকে।

এই সকল উদ্যোক্তাদের সহায়তা, তাদের পণ্যকে বাজারজাত করার সুবিধা এবং সর্বোপরি তাদেরকে নেটওয়ার্কিং-এর সুযোগ দেওয়ার জন্য আমরা ১-২ মে চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো একটি  “উদ্যোক্তা উৎসব” আয়োজন করেছে। সেই উৎসবে আমরা নতুন উদ্যোক্তাদের তাদের পণ্য ও সেবা তুলে ধরার সুযোগ সৃষ্টি করা, উদ্যোক্তা, সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী এবং ব্যাংকারদের মধ্যে নেটওয়ার্কিংএর ব্যবস্থা, উদ্যোক্তাদের পথের চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিত করা, নতুন টুলস সম্পর্কে উদ্যোক্তাদের দক্ষতার উন্নয়ন এবং সর্বোপরি সমাজে উদ্যোক্তা সৃষ্টির সচেতনতা তৈরি করার চেষ্টা করেছি।

আর এবার ৬-৭ অক্টোবর ঢাকার ওম্যান ভলান্টারি এসোসিয়েশনের মেঘনা হলে হল দুইদিনের উদ্যোক্তা হাট। ২০-২৫ জন নবীন উদ্যোক্তা তাদের পন্য আর সেবার পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন সেখানে। ডাকা চেম্বারের সভাপতি সবুর খান ৬ তারিখে সেটা চালু করে দিয়ে সরাসরি বিমানে ওঠেছেন। তবে, কষ্ট করে তার আসাটা বর্থ হয়নি। দুইদিনি প্রায় ৮ হাজারের বেশি দর্শক সমাগম হয়েছে এই ছোট্ট হাটে। প্রায় সব মিডিয়াতে গুরুত্ব দিয়ে এই হাটের খবর প্রচারিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, অনেকেই হাটে এসে জানতে চেয়েছেন তারা কীভাবে উদ্যোক্তা হবেন।

আজ বুধবার রাতে ছিল মূল্যায়ন সভা আর খাইদাই। দেখলাম সব অংশগ্রহণকারীই সন্তুষ্ঠ। সবাই বলেছে তারা কেও বিক্রি হবে বলে ভাবেননি। কিন্তু হয়েছে। অনেকেই নতুন কাস্টোমার পেয়েছে। একজন পার্মানেন্ট কাস্টোমার পেয়েছে। হাটে তিনটি ব্যবসায়িক এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। এমনকী একটি স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বলেছেন তিনি নিজেও অনেক অণুপ্রাণিত বোধ করছেন। আলাপ আলোচনায় বেশ কিছু পরিকল্পনা উঠে এসেছে। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা হল-

–     একটি বড় আকারের হাট করা নভেম্বরমাসে বিশ্ব উদ্যোক্তা হাটের সময়

–     ঈদের পর থেকে উদ্যোক্তা ক্লিনিক চালু করা। শুরুতে সপ্তাহে একদিন বিডিওএসএন অফিসে এটা করা হবে। আগ্রহীরা তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান বা গাইডেন্সের জন্য এখানে পূর্ব-নির্ধারিত এপয়েন্টমেন্টের ভিত্তিতে পরামর্শ নেবেন

–     উদ্যোক্তা ক্যাম্প – এটির পাইলট করা হবে ৪০ জন উদ্যোক্তাকে নিয়ে। ক্যাম্পে উদ্যোক্তারা দলগঠন, মার্কেটিং, বিক্রয়, একসেস টু ফাইন্যান্স ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এক্সটেনসিভ ও রিগোরাস একটি ট্রেনিং-এর ভিতর দিয়ে যাবেন। থাকবে গ্রুপ ওয়ার্ক এবং সিনেমা দেখা। শুরু হবে কোন এক বৃহস্পতিবার সকালে। শেষ হবে শনিবার দুপুরের খাবার খেয়ে।

–     ১৮ নভেম্বর থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত বিশ্ব উদ্যোক্তা সপ্তাহ পালন করা হবে ঘটা করে।

–     ঢাকার বাইরে কয়েকটি হাটের আয়োজন এবং উত্তরা-পুরান ঢাকায় দুইটি হাটের ব্যবস্থা করা

আরো কিছু আলাপ আরোচনা হয়েছে তবে সবগুলোই ভার আলোচনা। গুরুত্বপূর্ণ হল একটি সফল আয়োজনের ফলে উদ্যোক্তারা এবং গ্রুপের সংগঠকরা সবাই অনুপ্রাণিত এবং চার্জড। এটিই তাদেরকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে।

পথে নেমেছেন বরেই তারা পথ চিনতে পারছেন।

সবার সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক।

5 Replies to “চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব : উদ্যোক্তা হাট থেকে উদ্যোক্তা ক্যাম্প”

  1. Thank You, Thank You, Thank You very very very much for your excellent initiative. I am highly motivated. I am taking preparation for marketing my first product “HAPPINESS”. I will need your valuable advice.

  2. ভালো সব সময় লাগে আপনার সব উদ্যেগ এবার ও লাগলো । তবে মনে হচ্ছে খুব বড় একটা মিস করলাম । পরিক্ষা থাকার কারণে অনেক কিছু মিস করলাম ।

Leave a Reply Cancel reply

Exit mobile version