তোত্তো চানঃ জানলা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্টো মেয়েটা
অতিথি কলাম : লিখেছেন টুকুনজিল নায়ীরা
মিষ্টি একটা মেয়ে তোত্তো চান!
মজার একটা ইশকুল তোমোই গাকুয়েন!
তোত্তো চানের সত্যি সত্যি নাম কিন্তু “তোত্তো” না। ওর ভালো নাম তেত্সুকো। কিন্তু বেচারি এতোই ছোটো যে কিছুতেই তেত্সুকো শব্দটা বলতে পারেনা। অথচ এইটুক ছোটো বয়সেই ওকে ওর প্রথম ইশকুল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো!
তোত্তোর অপরাধ ছিল ক্লাসে অমনোযোগিতা। পড়া ফেলে সে জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। বাজনাবাদকদের গান শুনতে চাইতো কিংবা সোয়ালো পাখিদের সাথে গল্প জুড়ে দিতো। এমন বেয়াড়াপনা কাঁহাতক সহ্য করবে টীচাররা?! তাই দিলো ওকে ইশকুল থেকে তাড়িয়ে!!
পরে ওর আম্মু অনেক খোঁজাখুঁজি করে “তোমোই গাকুয়েন” ইশকুলের কথা জানতে পারে। জাফর ইকবাল স্যারের পথচারী ইশকুলের কথা মনে আছে?! প্লাস্টিক দিয়ে বানানো উল্টো একটা ইশকুল! ছোটোবেলায় মনে হতো এমন মজার ইশকুল আর হয়না। তখন তো আর তোমোই ইশকুলের কথা জানতাম না! তোমোই ইশকুলের ক্লাসঘর ছিল ভাঙা ট্রেনের বগি! কী মজা ভাবো তো একবার!! কুউউউ ঝিকঝিক আস্ত একটা ট্রেনের বগিতে ক্লাস হচ্ছে! গরম লাগলে জানলা খুলে দিলেই ঝিরঝির বাতাস এসে শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে! কারণ ইশকুলের চারপাশেই অসংখ্য গাছগাছালি!
জানো তো, তোমোই ইশকুলে পড়ার জন্য কোনো এডমিশন টেস্ট দিতে হয়না। শুধু প্রিন্সিপালকে গল্প শোনালেই হয়। তোমার যা খুঁশী গল্প বলতে পারো। যতক্ষণ খুঁশী! কারণ প্রিন্সিপাল “সোসাকু কোবায়াশীর” খুবই মজার এবং অসম্ভব ভালমানুষ!!
ফিনল্যান্ডের স্কুলিং সিস্টেম নাকি পৃথিবীর মধ্যে সেরা! ওদেরও কি তোমোই ইশকুলের মতো মজার ইশকুল আছে?! এই ইশকুলে কোনো ধরাবাঁধা ক্লাস হয়না। নিয়ম হচ্ছে, দিনের শুরুতেই ক্লাস টীচার কি কি শেখানো হবে, পড়ানো হবে তার একটা লিস্টি দিয়ে দিবে। তারপর এই লিস্ট থেকে যার যা খুঁশী করবে! কেউ হয়তো ছবি আঁকছে, কেউ ব্যায়াম করছে, কেউবা ততক্ষণে সব অক্ষর চিনে ফেলেছে! আর কেউ হয়তো বিজ্ঞানের এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলেছে!! এইভাবে পড়ানোর একটা উদ্দেশ্য আছে। ছেলেমেয়েরা উঁচু ক্লাসে উঠতে উঠতে টীচাররা জেনে যাবে কার কিসে আগ্রহ বেশী, কে কিসে ভালো করবে!
ইশকুলের টিফিন ব্যাপারটাও খুব মজার। টিফিনের নাম “সাগর থেকে, পাহাড় থেকে”। অর্থাৎ শিশুকে সব ধরণের পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে এই জরুরী কথাটা খুব সহজেই বোঝানো গেলো। “সাগর থেকে, পাহাড় থেকে” নিয়ম মেনে টিফিন বানাতে গেলে প্রতিদিনের টিফিনে শিশুরা সব ধরণের পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার পেয়ে যাচ্ছে!
এছাড়াও আছে শত শত মজার ব্যাপার। যেমন দুপুরে খাওয়ার পর হাঁটতে যাওয়ার কথাই ধরো। হাঁটতে হাঁটতে বাচ্চারা চিনে ফেলছে ফুল-পাতা-প্রজাপতি। গ্রীষ্মের ছুটিতে ওরা শিখছে ক্যাম্পিং। মাঝেমাঝে আছে ভুতের ভয় তাড়ানোর এডভেঞ্চার। ইউরিদমিক্স ক্লাসে শিখছে কিভাবে শরীর আর মনের সমন্বয় ঘটাতে হয়। টিফিনের পর প্রতিদিন কেউ না কেউ পুরো ইশকুলের সকল স্টুডেন্ট-টীচারদের সামনে বক্তৃতা দিচ্ছে!!
সোসাকু কোবায়াশীর একজন সত্যিকারের হৃদয়বান লোক। বাচ্চাদের কিভাবে শেখাতে পড়াতে হয় তার চাইতে ভালো কেউ জানতোনা! তাকাহাশির শারীরিক সমস্যা ছিল বিধায় ওকে সব স্পোর্টসে জিতিয়ে দেবার জন্য কত মজার মজার খেলা আবিষ্কার করলেন! তোত্তো চানের দস্যিপনায় যখন সবাই অতিষ্ঠ সেখানে তিনি সুযোগ পেলেই তোত্তোকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “জানো তো, তুমি কিন্তু সত্যিই খুব ভালো মেয়ে!” আবার মিয়ো চান যখন তোত্তোর চুলের ফিতের মতো সুন্দর ফিতের আবদার করলো তখন সেটা খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা বাবার মতো তোত্তোর কাছে অনুরোধ করে বসলেন, “তোত্তো চান তুমি যদি এই ফিতেটা আর স্কুলে বেঁধে না আসো তাহলে আমি তোমার প্রতি খুব কৃতজ্ঞ থাকবো। আসলে কী জানো, মিয়ো চান এতো করে চাইছে এমন একটা ফিতে! এটা না পড়লে তোমার কি খুব কষ্ট হবে?”
এমন একজন ভালোমানুষ প্রিন্সিপালের কথা না শুনে থাকা যায়?! আর ইশকুলের সব ছেলেমেয়েরা যখন সুর করে গাইতো-
“তোমোই স্কুল, চমৎকার স্কুল;
ভেতরে আর বাইরে খুবই চমৎকার স্কুল!”
তখন অফিসঘরে বসে কোবায়াশীর কেমন আনন্দ হতো কল্পনা করতে পারো?!
ইশ.. এমন একটা চমৎকার ইশকুলে পড়তে না পারাটা কি কষ্টের একটা ব্যাপার! আবার যদি শৈশবে ফিরে যেতে পারতাম আর তোমোই স্কুলে পড়তে পারতাম কি মজা হতো!!
একদিন বুড়ো বয়সে সত্যিসত্যি এমন একটা চমৎকার স্কুল দিতে হবে!