বইমেলার বই : দৃশ্যমান চৌকাঠের অন্তরালে
ছোটবেলায় গল্প উপন্যাস পড়ার সময় আমি মাঝেমধ্যে শেষেরটুকু কল্পনা করে নিতাম। বিশেষ করে গোয়েন্দা গল্প দিয়ে হাতে খড়ি বলে এমনটা ভাবতে মজা পেতাম। শুরুর দিকে ঠিক হতো না। কিন্তু যতোদিনে গোগোল, সন্তু, সন্ধ্যা শশী বন্ধু আর ব্যোমকেশকে চিনে ফেলেছি ততোদিনে ভালই ধরতে পারতাম। তবে, বাদশাহী আংটি আর জয় বাবা ফেলুনাথের মতো বোকা আর কখনো হইনি।
মাঝখানে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আবার ইদানীং শারদীয় আনন্দমেলা পড়তে গিয়েও একই অভ্যাস বজায় রেখেছি। তবে, কাজ তেমন একটা হয় না।
ধান ভানতে শিবের এই গীত কেন গাইছি সেটা আমি নিজেও জানি না। এমন একটা বই নিয়ে আমি লিখতে বসেছি, যেটার শেষটা কেমন হলো এটা এখনো বুঝতে পারছি না। গতকাল (২ ফেব্রুয়ারি) বইমেলাতে আফতাব আহমেদ স্যার বার বার বলছিলেন শেষ পাঁচ পৃষ্ঠাতে আপনি চমকে যাবেন। এতোবার বলছিলেন যে, কাল আর আজ পড়ার সময় কয়েকবারই মনে হয়েছে শেষের পাঁচপৃষ্ঠা পড়ে নিলে কেমন হয়।
কিন্তু নতুন এই উপন্যাস লেখক আমাকে এই কাজটা করতে দেননি।
আমার বই পড়া নিয়ে আমার পরিবারের লোকেদের ধারণা আমি ব্যাপক সংখ্যক পাতা উল্টে চল যাই, পড়ি না। ছোটবেলাতে (এমনকী বিয়ের পরেও) আমাকে তাই অন্যরা পড়া ধরতো। আর আমার প্রতিবার পার পেয়ে যাওয়ার ঘটনা থেকে শেষমেষ আমার “প্রেতের ভাগ্য” এই তকমা জুড়ে দিয়ে ভাগলবা হতো সবাই।
কিন্তু এই উপন্যাসটি পড়ার সময় আমি মোটেই অস্থির হইনি। যদিও বুঝতে পারছিলাম যে, একটা অন্যরকম পরিণতির দিকে আগাচ্ছে বইটা। কিন্তু খটকা ধরতে পারিনি। যদিও সব উপাদানই সেখানে ছিল।
মাঝেমশ্যে অবশ্য হোঁচট খেয়েছি কোনো কোনো অধ্যায় খুব ছোট বলে। কালকে আধাআধি পড়েছিলাম। তখনো এক দুইবার মনে হচ্ছিল, এতো ছোট ছোট চ্যাপ্টার! কিন্তু শেষের দিকে এসে বুঝতে পেড়েছি এ এক নতুন চেষ্টা (আমার জন্য, সাহিত্যের এমন ব্যাপার আছে কিনা আমার জানা নেই। আমি অঙ্ক-টঙ্ক কিছু বুঝলেও মানুষ আর সাহিত্য মোটেই বুঝি না)। এর ফলে উপন্যাসের প্রায় সব চরিত্রের সঙ্গে আমার জানাশোনা হয়ে গেছে শুরুতে। এবং যখন টের পেয়েছি সব চরিত্র সেভাবে দানা বাঁধছে না তখনই বুঝেছি কিছু কিছু চরিত্র কেবল মূল চরিত্রগুলোকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যই এসেছে।
ভাল কথা, এই উপন্যাসের মূল চরিত্র কোনটি? বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তার ব্যাচের সেরা ছাত্রটি? যার নাম অয়ন। সিজিপিএ ৪-এর পেছনে না দৌড়ে যে কিনা লেখক হওয়ার জন্য পড়ালেখা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে?
নায়ক অয়নের কোনো কোনো অংশে নিজেকেও খুজে পেয়েছি। ছেলেটি দুইটি টিউশনি করে। এর মধ্যে একটিতে সে দুপুরের পর পর যায়। ওই বাসাতে পড়াতে যাবে বলে সে দুপুরের খাওয়াকে ট্রিক্সে ফেলে দেয়। ও সময় অয়নের মধ্যে নিজের ছায়া দেখতে পাই। বুয়েটে পড়ার সময় মাসের শেষের দিকে সকালের নাশতার টাকা থাকতো না। তখন সকালের নাশতাকে ট্রিকসে ফেলা লাগতো। পড়াশোনাকে ধ্যানজ্ঞান করা অয়নের মধ্যে কখন গল্প লেখার ভূত চাপলো সেটা পরিস্কার করেননি লেখক। হয়তো উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন। অথবা মানব চরিত্রের সবচেয়ে রহস্যময় অংশটিকে নিয়েই তিনি কাজ করতে চেয়েছেন এই বইতে। ফলে, মানুষের মনের সবচেয়ে জটিল অংশের বিশ্লেষনগুলো খুব অবলীলায় বলে ফেলেছন। লিনিয়ারও তাই একসময় মনে পড়ে দিনের পর দিন টেবিল টেনিস খেলার সময় অয়ন কেন ইচ্ছে করেই হেরে যেতো ওর কাছে।
মানব মনের আশ্চর্য কিছু বিষয় খোলাসা করবেন বলে লেখক শুরুতেই অন্যতম মূল চরিত্র নোমান চৌধুরীর স্ত্রীকে পরপাড়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। অথচ পুরো বইটার সবটা জুড়ে সুমনা চৌধুরীর প্রবল উপস্থিতি। আমার তো মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছিল এ বুঝি কোন মেটাফিজিক্স না এসে পড়ে!
স্ত্রীর মৃত্যুর তিনবছর পর্যন্ত তার স্মৃতি কেন বৃদ্ধ নোমান চৌধুরীর মন থেকে এক মূহুর্তের জন্যেও মুছে যায়নি সেটা টের পাওয়া গেল শেষ দৃশ্যে এসে। যেখানে ফ্ল্যাশব্যাকে নোমান চৌধুরী ও মোনা চৌধুরীর বিয়ের পর পর বগুড়ার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার দৃশ্য। আর কী আশ্চর্য সেই ঘটনার সঙ্গে মিল উপন্যাসের মূল চরিত্র রহমতের।
ধুর, রহমতকে আবার মূল চরিত্র লিখলাম নাকি? আসলেই কি সে মূল চরিত্র?
নোমান চৌধুরী অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর তাকে দেখাশোনা করার জন্য এ বাড়িতে এসেছে রহমত যার দেড় বছরের শিশু পুত্রকে রেখে তার স্ত্রী চলে যায় চেয়ারম্যানের ছেলের সঙ্গে, ম্যালা বছর আগে। কিন্তু ছেলের জন্য আর তার বিয়েশাদী করা হয়না। রহমতের চিন্তা-চেতনা আর কাজ-কর্মকে সামনে রেখে মানব চরিত্রের আর একটি অংশও লেখক খুব সহজে উন্মোচন করেছেন। দরিদ্র কিন্তু নির্লোভ রহমতের বিপরীতে অয়নের বাবার চরিত্রটি হয়তো এই সমাজের প্রচলিত কিছু সত্যকে নতুন করে তুলে ধরে।
উপন্যাসে একটা আরোপিত অংশ আছে বলে আমার মনে হয়েছে তবে সেটাকে আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছি। পড়ার সময় মন খুলে হেসেছি (শব্দ না করে, আমাদের বাসায় শব্দ করা য়ায় না)। অনেকের হয়তো মনে আছে ইংলন্ডের এক হেডমাস্টারের লেখা একটা চিঠি বছর কয়েক আগে ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়েছিল। সেখানে ঐ হেডমাস্টার বলেছিলেন – যার যা ভাল লাগে তাকে সেটাই হতে দেওয়া উচিৎ। আমাদের নায়ক (নায়ক তো, কী জানি) অয়নের অসুস্থ হয়ে যাওয়ার জন্য অয়নের বোন নিশি তার মাকে দায়ী করে। বাড়ি ছেড়ে বন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার সময় মাকে যে চিঠি সে লিখে যায় সেটিতে ব্র্যাডফোর্ডের এই চিঠির কথা আছে। (আমার ধারণা আমাদের খান সাহেবরা যারা পিএসসি, জেএসসি চাুল করেছে তারা এটুকু পড়ার পর আর এ্বই নাও পড়তে পারে)।
মায়ের মিথ্যা স্বপ্ন পূরণের জন্য অয়ন কেবল পড়েছেই। অথচ নোমান চৌধুরী তাঁকে বলতে পারতেন লেখালেখি এবং তুখোড় রেজাল্ট খুবই একসঙ্গে যেতে পারে। এই বদ্বীপে অন্তত জোড়াভাইয়ের উদাহরণ তিনি তাদের দিতে পারতেন। কিন্তু লেখক সে পথে যাননি। উনি “জিপিএ ফাইভ প্রত্যাশী মায়েদের কাতারে” তুলে রেখেছেন অয়নের মাকে। “এক জীবনের দু:খ জোর করে অন্য জীবনের সুখে বদলে দেয়া যায় না” – এ সত্যটা নাজমা বেগমকে বড় কষ্ট করে জানতে হয়েছে।
এসএসসি পরীক্ষার সময় বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্রের বিভিন্ন প্রশ্ন উত্তরের জন্য কবি শেলীর একটি কোটেশন মুখস্ত করেছিলাম – আওয়ার সুইটেস্ট সং আর দো’জ টেলস আস স্যাডেস্ট থট! হয়তো আমাদের লেখকও এমনটা ভাবেন।
গুলতেকিন খানের প্রকাশিত সব বই আমি পড়েছি। আমার আগের অনুভুতিও লিখেছি। গতকাল মেলা থেকে এই বইটা সংগ্রহ করেছি (আমার কিনতে হয়নি, তাম্রলিপি প্রকাশনীর রনি আমাকে একটা কপি উপহার দিয়েছে} এবং লেখকের অটোগ্রাফও সংগ্রহ করেছি। লেখক নিজে অন্য লেখকদের উৎসাহ দেন বলে আমার দুই দুইটি বই-এর মোড়কও উন্মোচন করে দিয়েছেন।
এই বইটি আমি পরে আর একবার পড়বো। কেন জানি না। তবে, মনে হচ্ছে সেবারও আমি শেষ পাতায় এসে হতভম্ভ হয়ে বসে থাকবো।
যারা হরেদরে এবং মামুলী লেখার বদলে ঠাসবুননের সাধারণের মধ্যে অসাধারণ কিছু খুঁজে বেড়ান তাদের জন্য এই বই অবশ্যই পাঠ্য।
নবীন উপন্যাসিকের জয় হোক।
চৌকাঠ
গুলতেকিন খান
প্রকাশক – তাম্রলিপি
১১০ পৃষ্ঠা, ২০০ টাকা।
মেলায় পাওয়া যাচ্ছে তাম্রলিপির স্টলে। রকমারি থকে কিনতে হলে এখানে।