যে ৫ শব্দে কুপোকাত টাটার ন্যানো গাড়ি
২০০৮ সালে ভারতীয় কনগ্লোমারেট টাটা তাদের ন্যানো গাড়ি বানানোর ঘোষণা দেয়। এটি ছিল বিরাট ব্যাপার কারণ রতন টাটার ভাষায় এটি হলো “পিপল’স কার”। ওনার কথার পেছনে যুক্তিও ছিল। কারণ গাড়ির দাম রাখা হবে মাত্র এক লক্ষ রূপী (২০০০-২৫০০ ডলার, বাংলাদেশী টাকায় দেড় লক্ষ টাকার মতো)। আমার নিজের মনে আছে সে সময় আমাদের মিডিয়াগুলোও এ ব্যাপারে বেশ সরগর ছিল। আমি অনেককে দেখেছি যারা ভেবেছে এবার তারাও একটি গাড়ি ব্যবহার করবে।
রতন টাটা আর তার ন্যানো গাড়ির কথা মনে পড়ছে কয়েকদিন ধরে কারণ হলো আমাদের এপার্টমেন্টর পার্কিং লটে এমন একটা গাড়ি কয়েকদিন আগে দেখেছি এবং এরই মধ্যে একদিন রাস্তায়ও দেখেছি। কারওয়ান বাজারে এসসিবির ব্র্যাঞ্চের সামনে একটা ন্যানো গাড়ি দেখে মনে হলো আহা এমন একটা গাড়ি তো আমারও থাকতে পারতো। সেটা চালিয়ে আমি বাসার কাছে হাজির বিরিয়ানির দোকানে যেতে পারতাম।
আমি যে গাড়িটি এখন ব্যবহার করি (প্রথম আলো থেকে দেওয়া) সুজকি অলটোর মডেলে ওয়াগনার সেটাও একই রকম ছোট। কিন্তু ন্যানোর দিকে তাকালেই একটা ভাব আসে মনে। এই যে আমি আমার এপার্টমেন্টের পার্কিং-এ বা রাস্তায় যে ন্যানো দেখেছি এটা নিশ্চিত হলাম যখন দেখলাম ফেসবুক আর গুগোল আমাকে ন্যানোর ছবি-টিব দেখাচ্ছে! তখন নিশ্চিত হলাম যে আমি ন্যানোই দেখেছি অন্য কিছু নয়।
বেশি পড়ালেখা করি নাই কিন্তু সামান্য ঘাটাঘাটি করে যা বুঝলাম তাতে দেখলাম ন্যানোর দুর্ভাগ্যের পেছনে কারিগরি ত্রুটির চেয়েও বেশি সমস্যা মার্কেটিং-এর। তাই ভাবলাম আমার মার্কেটার বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করি।
১৩০ কোটি লোকের দেশ ভারত। তবে, সেখানে গণপরিবহণ আমাদের তুলনায় কমপক্ষে কয়েকগুণ ভাল এবং নিরাপদ। বেশিরভাগ লোকেই গণপরিবহণ ব্যবহার করে। তবে, একসময় লোকের হাতে টাকা আসতে শুরু করে এবং মধ্যবিত্তরা পারিবারিক বা ব্যক্তিগত গাড়ির কথা ভাবতে শুরু করে।
টাটার ন্যানোর লক্ষ্য কাস্টোমার কিন্তু এরাই। এদের চরিত্র বোঝার জন্য আপনি কোলকাতাবাসীকে নিয়ে আমাদের ঢাকাবাসীর ট্রলগুলো মনে করতে পারেন। আর একটা হলো সেই সত্তর দশকে ইন্দিরাগান্ধীর জরুরী অবস্থার সময় ভারতীয়দের মধ্যে সঞ্চয়ের একটি বড়ো মনোভাব গড়ে উঠে। আমার অন্যতম প্রিয় শিক্ষক কায়কোবাদ স্যারের একটি কথা খুবই প্রণিধানযোগ্য – ভারত আঙ্গুর রপ্তানী করে কিন্তু নিজেরা বাজার থেকে আঙ্গুর কেনে গ্রাম হিসাবে। আমরা আঙ্গুর আমদানী করি কিন্তু কেজির নিচে কেনাকাটায় আমরা নাই। তো, এসব হিসাব করে আমরা ন্যানোর এই পরিণতি বিশ্লেষনে যেতে পারি।ন্যানো গাড়ি বানানোর টাটার উদ্দেশ্য ছিল মধ্যবিত্তদের জন্য একটি ‘সাশ্রয়ী, নিরাপদ” গাড়ি বানানো। কোয়ালিটি ঠিক রেখে দাম কম রাখার নীতিতে ২০০৮ সালে ন্যানো গাড়ি বাজারে আসে।
শুরু থেকে মিডিয়া এই গাড়িকে ফলো করেছে। ডিজাইনের কী হচ্ছে, কী কী ফ্যাসিলিটি থাকছে সবই জানা হয়ে যাচ্ছিল সবার। তৈরি হচ্ছিল আকাঙ্খাও। অনেকই ধারণা করেছেন ন্যানো হবে ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় গাড়ি! তৈরি হয়েছে হাইপ।
ফলাফল?
গাড়ি বিক্রিতে বিরাট উল্লম্ফন। দু্ই লক্ষ প্রি-অর্ডার হয়েছে, ডিজাইন, জ্বালানী সাশ্রয় আর কম ওজনের জন্য ন্যানো বেশ কিছু পুরস্কারও পেয়ে যায়! কিন্তু এই মধুচন্দ্রিমা বেশিদিন সইল না। দেখা গেল গাড়ির বিক্রি দ্রুত কমে গেল। কী কারণ?
পজিশনই যখন মিস-পজিশন
কিন্তু বাজারে আসার পর প্রথম মাসেই বেশ কয়েকটি গাড়িতে রাস্তায় আগুন ধরে যায়। দ্রুত সেটা মিডিয়াওয়ালাদের নজরে আসে। লোকজন সতর্ক হয়ে যায়।
লাখ রুপী নয়!!!
দ্বিতীয় ধাক্কা হলো গাড়ির দাম। কথা ছিল এটি কিনতে খরচ হবে লাখ রূপী। যারা প্রি-অর্ডার করেছে তারা লাখ রূপীতেই পেয়েছে। কিন্তু যারা পরে কিনতে গেল? না তাদের গুণতে হলো বাড়তি টাকা! মানুষ ব্যাপারটা কেমন করে নিলো?
এই বিষযটা বিবেচনাতে না নিয়ে টাটার মাথা ব্যাথা হলো নিরাপত্তার বিষয়টা।এটাই হওয়ার কথা, তাই না? কারণ গাড়ি তো নিরাপদ করতে হবে। ফলে নিরাপত্তার প্রযুক্তি যোগ করতে গিয়ে গাড়ির দাম আরও বেড়ে গেল!!! এই যাত্রাও হয়তো মেরে কেটে ন্যানো বের হতে পারতো। কিন্তু গোল পাকালো টাটার মার্কেটিং!
যে ৫ শব্দে কুপোকাত ন্যানো
টাটার মার্কেটিং টিম ন্যানোকে নতুন করে পজিশন করলো – ““cheapest car in the world” “বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা গাড়ি”!
সস্তা! আর ইউ কিডিং। আপনি মধ্যবিত্তের কাছে গাড়ি বিক্রি করতে চান যারা কিনা নিজেদের নিন্মবিত্ত থেকে আলাদা করেই “তাদের অপেক্ষাকৃত বাড়তি টেকাকড়ি দিয়ে”। তাদের কাছে আপনি বেচবেন বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা গাড়ি!!! নৈব নৈব চ!
যে সমাজে টাকাকড়ির সমস্যা সেখানে কমদামে একটি গাড়ি বিক্রির কৌশল হিসাবে দামটাকেই মূখ্য বিবেচনা করা হয়। এতে তেমন কোন সমস্যা মনে হয় না। কিন্তু শব্দের ব্যবহারটা খেয়াল করুন। “চিপেস্ট’’ – সবচেয়ে সস্তা!!!
ভারতের লোকেরা দামের ব্যাপারে খুবই সচেতন কিন্তু সবচেয়ে সস্তার ব্যাপারটি তাদের কাছে একটি প্রত্যাখ্যাত শব্দ। ভাবেন, আপনি সদ্য নিম্নবিত্তের গণ্ডি পার হয়েছেন, বাসে করে আপিসে না গিয়ে নিজের গাড়ি করে যাবেন। আর রাস্তায় সব লোক আপনার গাড়ির দিকে তাকিয়ে বলবে – “মুনিরজী দুনিয়ার সবচেয়ে সস্তা গাড়িটাই কিনেছে। বুঝলে না। টাকা বাঁচানো আর কি। আরে দাদা, গাড়ি কিনলে তো খালি হয় না। বনেদী হতে হয় চিন্তায়। মুনিরজী সারাজীবন সস্তার সস্তা জিনিষেই থেকে গেলেন”।
এ কথা নিতে পারার মতো বাঙ্গালি মধ্যবিত্ত আপনি ভূ-ভারতে কই পাবেন?
ভারতীয় সমাজে শ্রেণি আর স্ট্যাটাসের অনেক সমস্যা। বিষয়টি স্পর্শকাতরও বটে। উঠতি বড়োলোকরা গাড়ি কিনতে চান এমনই যা তাদের স্ট্যাটাস আরও বাড়াবে, কমাবে না। দরকার হলে টেকা-টুকা একটু বেশিই যাক। নিজেদের খেলো হতে দেবে না। “the cheapest car in the world” এই শ্লোগানটি বলে দিচ্ছে এই গাড়ি দরিদ্রদের জন্য, পুওরদের জন্য। এতো কষ্ট করে মধ্যবিত্তের তকমা অর্জনকারী কেন এই গাড়ি কিনে ধরাটা খাবে?
আর এভাবেই শেষ পর্যন্ত ধরা খেয়ে গেল রতন টাটার “পিপলস’স কার”।
বিশেষ ঘোষণা –
কেউ যদি আমাকে একটি টাটা ন্যানো গাড়ি উপহার দিতে চান, দিতে পারেন। এই গাড়ি চালাতে আমার কোন সমস্যা নাই। এই গাড়ি চালিয়ে হাজির বিরিয়ানি খেতে যাওয়ার মধ্যে একটা বনেদী ভাবতো মুনিরজী পাবেন। তাই না?
10 Replies to “যে ৫ শব্দে কুপোকাত টাটার ন্যানো গাড়ি”
Leave a Reply Cancel reply
You must be logged in to post a comment.
khubi valo likhesen…
আজ আমি ব্যাচেলর থাকলে বাই সাইকেলের সাথে সাথে কিস্তিতে এই গাড়ী এক খানা এমনিই কিনে রাখতাম 🙂
Very interesting marketing analysis
হা হা হা, “মুনিরজী দুনিয়ার সবচেয়ে সস্তা গাড়িটাই কিনেছে। বুঝলে না। টাকা বাঁচানো আর কি। আরে দাদা, গাড়ি কিনলে তো খালি হয় না। বনেদী হতে হয় চিন্তায়। মুনিরজী সারাজীবন সস্তার সস্তা জিনিষেই থেকে গেলেন।” স্যার এইকথা তখন হলে অবশ্যই শুনতে হতো। আর এখন হলেও শুনবেন 🙂
মুনির ভাই লেখা ভালো হয়েছে। বেশ ভালো।
সুন্দর বিশ্লেষণ ।
চমৎকার বিশ্লেষ।
Nice realisation.
স্যার, আপনি যে এই গাড়ি চালাবেন, আপনার তো ড্রাইভিং লাইসেন্স নাই। পুলিশ ধরবে তো।
করোনাকালে মনে হয় ধরে না।