ভালবাসাকে কাজ বানাও নতুবা কাজকে ভালবাসো
মন খারাপ – নাচো।
রেজাল্ট মিলে না – নাচো।
তো, ল্যাবে বসেই খবর পাওয়া গেল আবেদন মঞ্জুর হয়েছে দুই জায়গায়। জামার্নীর রেইন ভাল ইউনিভার্সিটিতে ইন্ডাসট্রিয়াল ফান্ডিং-এর আওতায় পিএইচডির সুযোগ। এ শুধু প্ল্যাঙ্ক-আইনস্টাইনের দেশে কাজ করার সুযোগ নয়, সঙ্গে সম্মানিও অনেক। মাসে বাংলাদেশি টাকায় তিন লক্ষ টাকার ওপরে। একই সময়ে ভারত সরকারের আইসিসিআর বৃত্তি নিয়ে নাচে স্নাতকোত্তর করার সুযোগ- রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে সেখানে সম্মানী কম ১২-১৮ হাজার টাকা মাত্র।
একদিকে শখ, ভালবাসার জগৎ। অন্যদিকে বিশ্বের বড় বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ, নিজেকে বড় মাপের বিজ্ঞানী বানানোর সুযোগ। কী করবেন গবেষক?
পরেরটুকু তাঁর মুখেই শোনা যাক, “(সেন্টার অব এক্সেলেন্স) ওই ভবনের চারতলায় শিক্ষক আর শিক্ষানবিশ গবেষকদের জন্য একটা অত্যাধুনিক ফুড কোর্ট আছে। দুপুরে খেতে গেলাম, সামনের টেবিলে কবীর স্যার। স্যার আমাকে তাঁর সঙ্গে লাঞ্চ করার আমন্ত্রণ জানালেন। এটা একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার। বিভাগের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত অংশ নিতাম, সেই সুবাদে সবাই জানত আমি ভালো নাচি। স্যারকে জার্মানির পিএইচডি অফারের কথা জানালাম, স্যার খুশি হলেন। আমি বললাম, জার্মানি গিয়ে সেই দেশের কিছু নাচও শিখে আসব। স্যার শুনে বললেন, ‘তুমি জীবনের যে প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছ, সেখানে নাচ ও ফিজিকস আর একসঙ্গে চালানো যাবে না, নাচ বাদ দিতে হবে।’ আমি বললাম, ‘দুটোই চালিয়ে নিতে পারব, নাচ বাদ দেওয়া অসম্ভব।’ স্যার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘তাহলে ফিজিকস বাদ দাও।’ আমি বললাম, ‘শুধু নাচ করে তো জীবন চালানো সম্ভব না, আর আমার মা-বাবাও রাজি হবেন না।’ স্যার বললেন, ‘তুমি জীবনে একটা রিস্ক নাও, সবাইকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী হতে হবে—এগুলো অনেক পুরোনো চিন্তাভাবনা। আর ভুলেও সরকারি চাকরির ধারেকাছে যাবে না, যে কাজে তোমার প্রতিভা আছে সেটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নাও। আমার বিশ্বাস তুমি সফল হবে।’ স্যার আমাকে খাবারের বিল দিতে দিলেন না। বললেন, ‘নাচ করে যেদিন অনেক উপার্জন করবে সেদিন দিয়ো।’
আর ভাবনা নেই। আমাদের গবেষক ছুটলেন রবীন্দ্রভারতী। হলেন নৃত্যশিল্পী।
আমি পোডিয়ামে দাড়ানো। আর আমাদের সেই গবেষক, নৃত্যশিল্পী পূজা সেনগুপ্ত ডায়াসে, আরও চারজনের সঙ্গে বসে আছে। ওর মুখ থেকে শোনা ভালবাসাকে কাজের ক্ষেত্র বানানোর এই গল্প। এই দেশে নাচকে পেশা হিসাবে নেওয়া যায় এটা এখনো ততোটা পরিচিত নয়। সেখানে একজন মেয়ে বেছে নিয়েছে এই পথ। কারণ সে নাচকেই ভালবাসে্! গড়ে তুলেছে তুরঙ্গমী নামে একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের নাচকে নিয়ে গেছে ভিন্ন মাত্রায়, অন্য উচ্চতায়। (পূজার নাচের একটা ক্লিপ এখানে দিলাম। আর ওর লেখাটা পড়া যাবে এখানে)।
৪ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে পূজার বিশ্ববিদ্যালয়েই আমরা যাত্রা শুরু করেছি ক্রাউন-সিমেন্ট প্রথম আলো তারুণ্যের জয়োৎসবের। সেদিন দ্বিতীয় পর্বে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছি ৫ তরুণকে যারা সফল, কেউ প্রচলিত পথে কেউ পূজার মতো পথকে ঘুরিয়ে নিয়েছে নিজের পথে!
শুরুতে সবাইকে সময় দিয়েছি। আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডের তামান্না ইসলাম উর্মিকে দিয়েই শুরু হয়। উর্মি তার স্নাতক সম্পন্ন করেছে ম্যাসাচুসেট ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, এমআইটি থেকে। অনেকের ধারণা বাংলাদেশ থেকে আন্ডারগ্র্যাডে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হলে একটি অলিম্পিয়াড মেডেল লাগে। ব্যাপারটা যে সত্য নয়, তার প্রমাণ উর্মি। উর্মিকে বলতে বলেছিলাম – আমেরিকার চাকরি ছেড়ে কেন আবার দেশে ফেরা? । উর্মির মুখেই শোনা যাক, ‘পড়াশোনা শেষে আমি আমেরিকাতেই চার–পাঁচ মাস কাজ করেছি। কিন্তু সেখানে কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করলে খুব ছোট একটা সমস্যার খুব ছোট অংশ নিয়ে কাজ করতে হতো। তাই পিএইচডি করার আগে বাংলাদেশে ফিরে বড় সমস্যা নিয়ে কাজ করছি।’ তার কাছ থেকে জানা গেল বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যথন তাদের নতুন শিক্ষার্থী খোঁজে তখন কেবল একাডেমিক ফলাফল দেখে না। দেখে বিশেষ ধরণের পার্সোনালিটি ট্রেইট। যেমন কোন ভার্সিটি দেখে লিডারশীপ, কোনটা দেখে একটা কাজে ধৈর্যের পরাকাষ্টা। কাজে বাইরে গিয়ে পড়তে চাইলে পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের ভালবাসা আর অন্যান্য গুণাবলীগুলোকেও ফুটিয়ে তুলতে হবে। নিজেকে তৈরি করতে হবে।
৩৬তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রশাসনে প্রথম হওয়া ইসমাইল হোসেনও ছিল। তার কাছেই ছিল সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন। তবে, তার পরামর্শ কিন্ত সহজ, ফলাফল যা-ই হোক না কেন, পরিশ্রম করে যেতে হবে। লক্ষ্যে পৌঁছাতে নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে, যাতে নেতিবাচক কিছু হলেও কোনো আক্ষেপ না থাকে।
বোঝা যায়, ইসমাইলের আপ্ত বাক্য আর আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডের আপ্ত বাক্য একই-লেগে থাকো।
ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের এক শিক্ষার্থীর প্রশ্নের উত্তরে ইসমাইল খুব সহজ ভাবেই বলেছে, “যারা ভাবে কেবল মুখস্ত করে বিসিএসে ফার্স্ট হওয়া যায় তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে”। তার মতো সায়েন্সের শিক্ষার্থীদেরও বিসিএসের জন্য বাড়তি অনেক প্রস্তুতি নিতে হয়।
আলোচনায় আমাদের কাউসার আহমেদও ছিল। কাউসার ও তাঁর জুমশেপারের গল্প আমাদের অনেকেই জানেন।আমার জানামতে কাউসারই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের একমাত্র তরুণ আইটি উদ্যোক্তা যে কিনা প্রথম আলো পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রথম লিড হয়েছেন। সেই কাউসার, পড়েছেন টেক্সটাইল কলেজে (এখন বিশ্ববিদ্যালয়) কিন্তু কাজের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন ভাললাগার প্রোগ্রামিংকে। টিউশনির টাকা জমিয়ে কম্পিউটার কেনা আর শেখার জন্য প্রাণপাত করা- এই ছিল শুরু। বললেন, “যখনই কোন একটা প্রবলেম সলভ করতে পারতাম না, দৌড়ে চলে যেতাম নিলক্ষেতে, বই-এর দোকানে। বই কিনে ফিরতাম। শুরু হতো পড়া, পড়া, পড়া”। এখন তার টিমে অনেকেই কাজ করে, কিন্তু নিজে কাজ করাটা ছেড়ে দেননি। কথা প্রসঙ্গে জানালো জুমশেপার এখন বিশ্বের এক নম্বর জুমলা বেজড কোম্পানি! ঢাকায় বসে এমন একটি কোম্পানি গড়া যায় সেটিই কাউসার প্রমাণ করেছে।
কাউসার আর পূজার ভালবাসাকে কাজের ক্ষেত্র বানানোর গল্পের পরই কথা বলেছে আইপিডিসি ফিন্যান্সের ব্র্যান্ড ও করপোরেট কমিউনিকেশনের প্রধান মাহজাবীন ফেরদৌস। বিবিএ করার পর শখের এডভার্টাইজিং এজেন্সিতে যোগ দেওয়া, মডেল হওয়ার চিন্তা ভাবনা। কিন্তু নানা কারণে পথ ঘোরাতে হয়েছে কর্পোরেট জগতে। কিন্তু তাতে দমেননি। কাজটাকেই ভালবাসতে শুরু করেছেন। ফলে, এখানেও সাফল্য তাঁকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। মাহজাবীনের কথাও সহজ – ভালবাসাকে যদি কাজ বানাতে না পারো, তাহলে যা করবে সেটাকেই ভালবাসো। তাহলেই হবে।
ওদের আলোচনা দিয়েই আমাদের উদ্বোধনী পর্ব শেষ হয়। আর কথা তো একটাই হয় ভালবাসাকে কাজ বানাও অথবা কাজকে ভালবাসো। জয় তোমার হবে। ঘুরে ফিরে এসে ভালবাসার কথা। এটাই তো তারুণ্যের প্রাণশক্তি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যারিয়ার ক্লাব আমাদের সহযোগিতা দিয়েছে। সঞ্চালনা করেন ক্যারিয়ার ক্লাবের সভাপতি হালিমা আক্তার।
১লা বৈশাখের পরপরই আমরা দেশের নানান স্থানে যাবো। আমরা বলবো- পৃথিবীর ৭৫০ কোটি মানুষ তোমার দিকে চেয়ে আছে। তোমার উদ্ভাবন, তোমার ভালবাসার জন্য।
তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দাও।
তারুণ্যের জয়োৎসবের খবরবখবর পাওয়া যাবে এখানে আর সঙ্গে থাকার জন্য যুক্ত থাকতে হবে আমাদের ফেসবুক পেজে।
সবার জন্য শুভ কামনা।