তারুণ্যের জয় অনিবার্য

Spread the love

আমাদের একসময়ের সহকর্মী, বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ক্রাউন সিমেন্ট-প্রথম আলো তারুণ্যের জয়োৎসবে আমাদের সঙ্গে সিলেট গেলেন। যাওয়ার পথে আমার কাছে জানলেন সকাল ৯টার দিকে শুরু হয়ে অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে ৩টা বেজে যায়। যখন জানলেন অনুষ্ঠানে বিরিয়ানি খাওয়ানো হয় না তখন তিনি বললেন, কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? ছেলেমেয়েরা কি এতক্ষণ থাকবে?

আমি তাঁর এই প্রশ্নের জবাব দিইনি। শুধু বলেছি—ময়মনসিংহের তারুণ্যের জয়োৎসবে নেত্রকোনা থেকে এক তরুণ ভোর ৭টার সময় এসে মিলনায়তনের সামনে বসে ছিল। বরিশালে আমরা পেয়েছি ভোলা, বরগুনার অংশগ্রহণকারী, সাতক্ষীরা-বাগেরহাট থেকে এসেছে খুলনায়। নিজেদের খরচে কেবল এই জয়োৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য! সিলেটের জয়োৎসবে বেলা আড়াইটার দিকে আমি দেখলাম তাঁর একটি খুদে বার্তা—‘মুনির ভাই, কেউ তো যাচ্ছে না!!!’

আমি তো জানতাম কেউ যাবে না। শুধু তাই নয়, রাজশাহীতে সময় বাঁচানোর জন্য আমরা দুটি সমান্তরাল সেশনের ব্যবস্থা রেখেছিলাম। কিন্তু তারপর রাজশাহী কলেজের মিলনায়তনের সহস্রাধিক তরুণ বিকেল ৪টা ১৫ মিনিটে অনুষ্ঠান শেষ করেই বের হয়েছে!

যে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলেই কোনো টি-শার্ট পাওয়া যায় না, নিজেদের খাতা-কলম নিয়ে যোগ দিতে হয়, খাবারের কথা তো আগেই বলেছি—সে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য তরুণদের কেন এত আগ্রহ, কেনই–বা তারা অনেক আগে থেকে এসে সেখানে বসে থাকে?

এই প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন যদি জানেন সেখানে কী হয়। এই আয়োজনের উদ্দেশ্য হলো—তরুণদের দেশ-বিদেশের বর্তমান কর্মবাজার, সেখানে যোগ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা, সে দক্ষতাগুলো অর্জনের কলাকৌশলগুলো জানিয়ে দেওয়া। এ জন্য আমাদের সঙ্গে থাকেন ব্রিটিশ কাউন্সিল বা এডুকেশন ইউএসএর প্রতিনিধি, থাকেন প্রধান প্রধান করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব, থাকেন সফল উদ্যোক্তা এবং থাকেন যাঁরা নিজের পড়াশোনার বাইরে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে সফল হয়েছেন। প্রচলিত পেশায় সফলরা যেমন তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা শোনান, তেমনি সেখানে থাকেন একেবারে ভিন্ন বিকল্প পেশার লোক। থাকে উদ্যোক্তাদের লড়াই ও এগিয়ে যাওয়ার গল্প। তবে, শুধু গল্পের আসর এটি নয়। কারণ, গল্পের কুশীলবদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি, যাঁদেরকে ধরা যায়, ছোঁয়া যায়। রাজশাহীতে যেমন ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন প্রাক্তনী, যাঁরা এখন নিজেরাই অনেকের চাকরি দেন। এঁদের একজনের প্রতিষ্ঠানের বানানো সফটওয়্যার এরই মধ্যে বিশ্বের মাত্র ২০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। নিজের মতো একজনকে দেখে ওরা বুঝতে পারে—চেষ্টা করলে ওরাও পারবে।

বোনাস হিসেবে ওরা পেয়ে যায় ক্রাউন সিমেন্টের একজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে, যিনি তাদের ভুল ভাঙিয়ে দিয়ে বলে দেন—ক্রাউন সিমেন্টের মতো দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন দেশের বাজার ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও সমানতালে বিকশিত হচ্ছে। কিন্তু সেখানে চাকরি শুরু করতে পূর্ব অভিজ্ঞতার দরকার হয় না।

আমাদের সঙ্গে ঘুরছেন বিসিএস পরীক্ষার বিভিন্ন ক্যাডারে প্রথম স্থান অধিকারীরা। চাকরিপ্রত্যাশীদের প্রথম পছন্দের সরকারি চাকরিতে লড়াইয়ে জেতার রসদ তারা পেয়ে যাচ্ছে একেবারে সাম্প্রতিক সফলদের কাছ থেকে। তারা অবাকও হয়, যখন শোনে তাদেরই মতো একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন বিতর্ক করে, নতুন নতুন সংগঠনের জন্ম দিয়ে, সহপাঠীকে নিরন্তর সহযোগিতা করে। কিন্তু কেবল বিসিএসে নয়, স্নাতক বা স্নাতকোত্তরেও তিনি প্রথম হয়েছেন!

তবে, শুধু ক্যারিয়ারের আলোচনা হয় তা নয়। জয়োৎসবে আমরা বলি—আমি আছি, কারণ আমরা আছি। আই অ্যাম, বিকজ উই আর। আমার আশপাশের সবাই আছে বলেই আমার অস্তিত্ব। তারা না থাকলে আমি থাকতাম না। আর তাই তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না, তাদেরকে ধন্যবাদ দিলেই কেবল তা পূর্ণতা পায়।

আমরা জয়োৎসবের গান শোনাই, কোথাও কোথাও আমাদের বন্ধুরা নাচেও। আর এই নাচানাচির ফাঁকে একজন করপোরেট প্রশিক্ষক খুঁজে নেন চারজন প্রতিনিধি, যাদের তিনি বসিয়ে দেন চারটি হাতলবিহীন চেয়ারে। ভোজবাজির মতো চেয়ারগুলো উবে যাওয়ার পরেও দেখা যায় তারা মাটিতে পড়ছে না। দিন শেষে তাই তাদের জানা হয়ে যায়, সামনের লড়াই কঠিন। কিন্তু পারস্পরিক সহযোগিতা তাদেরকে হারতে দেবে না। আর যদি তারা পেয়ে যায় তাদের মেন্টর, তাহলে সে লড়াই হবে অনেক শাণিত।

জয়োৎসবের শেষের দিকে দেখানো হয় ১৯৯২ সালের বার্সেলোনা অলিম্পিকে গ্রেট ব্রিটেনের ৪০০ মিটারের দৌড়বিদ ডেরেক রেমন্ডের দৌড়ের ভিডিও। দৌড়ের মাঝামাঝিতে মাংসপেশির টানের জন্য ট্র্যাকে পড়ে যান ডেরেক। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোতে থাকেন, কারণ তিনি দৌড় শেষ করবেন। এ সময় নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে তাঁর পাশে এসে হাজির হন তাঁর বাবা। তারপর বাপ-বেটা মিলে দৌড় শেষ করেন। একেবারে শেষ মুহূর্তে ডেরেকের বাবা ডেরেককে ছেড়ে দেন যেন ডেরেক তাঁর লড়াই নিজেই শেষ করতে পারেন। স্টেডিয়ামের ৬৫ হাজার দর্শক দাঁড়িয়ে ডেরেককে সম্মান জানায়।

আমরা অনুষ্ঠান শেষ করি এ কথা বলে—তরুণ, জয় তোমারই হবে যদি তুমি হাল ছেড়ে না দাও।

2 Replies to “তারুণ্যের জয় অনিবার্য”

  1. তরুণদের এমন আগ্রহই আমাদের এত চেষ্টা একদিন আলোর মুখ দেখাবে। স্যার জয়োৎসব সামনে আর চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন প্লীজ। সাধ্যমত চেষ্টা করে যাবো এই প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

Leave a Reply Cancel reply

Exit mobile version