আমার পড়া বাংলা ভাষার সেরা কল্পবিজ্ঞানের বই
আমাদের বাসায় বাবার একটা বই-এর আলমিরা ছিল। সেখানেই কেরু সাহেবের মুন্সী, মেম সাহেব, দৃষ্টিপাতের সঙ্গে আমাদের ছোটবেলাতেই পরিচয়। সেখানেই বিদ্যুত মিত্রের (তখন কাজি আনোয়ার হোসেন এই নামেই লিখতেন) লেখা কুয়াশা-৩ও ছিল। এভাবে ছোটবেলা থেকে আমাদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দমেলা, দেশের মাধ্যমে সত্যজিৎ রায়, সুনীল, শীর্ষেন্দুর সঙ্গে পরিচয়। আবার পাক্ষিক কিশোর বাংলাও ছিল। এটি একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকা ছিল। সেখানে আলী ইমামের অপারেশন কাকনপুর, ইমদাদুল হক মিলনের ‘ডালুদা’র সঙ্গে পরিচয়। দীপু নাম্বার টু দিয়ে জাফর স্যারের সঙ্গে দেখা। এর পরপরই হাত কাটা রবিন পড়েছি। এসব করতে করতে কেউ একজনের কাছে শঙ্কনীল কারাগার আর নন্দিত নরকের কথা শুনি। পড়ার পর এর একটা নাটকও দেখে ফেলি বিটিভিতে। আর এভাবেই পরিচয় হয় গল্পের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদের লেখার সঙ্গে। জানতাম প্রতিবছর বই মেলাতে তার অনেক বই বের হয়। পড়তে বসলেই শেষ হয়ে যায় এমন লেখা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়তাম। এক নিশ্বাসে। মিশির আলি আর হিমু হয়ে ততোদিনে হুমায়ূন আহমেদের কল্পবিজ্ঞান পড়তে শুরু করেছি। মহাবিজ্ঞানী ফিহার কাজকারবার ভালই লাগে। এর মধ্যে একদিন অনন্ত নক্ষত্র বিথী পড়ে আপ্লুত হয়েছি। ভাবতাম কেমন করে লিখেন! তখনও আমার তারা তিনজন পড়া বাকী ছিল।
“তারা তিনজন” হুমায়ূণ আহমেদের ছোট্ট একটি কল্পবিজ্ঞানের বই। মাত্র ৭২ পৃষ্ঠা। আমার মনে আছে বাসায় যেদিন পড়তে শুরু করি তার কিছুক্ষণ পরই কারেন্ট চলে যায়। উত্তেজনায় আমি মোমের আলোতে বাকীটুক পড়েছি। মা একটু অবাক হয়েছেন। কিন্তু কিছু বলেননি যখন তিনি দেখেছেন আমি “তারা তিনজন” পড়ছি। সেদিন থেকে এই বই নিয়ে আমার ঘোর লেগেই আছে। আমি সুযোগ পেলেই বইটা পড়তাম। কতোবার যে পড়েছি তার ইয়ত্তা নেই। বাসা বদলানোর সময় অনেক বই বিভিন্ন পাঠাগারে পাঠিয়েছি। তখন সেটাও চলে গেছে।
ক’দিন আগে যখন আবার প্রবলভাবে তারা তিনজনের কথা মনে পড়লো তখন বাসায় খুঁজে বইটা পেলাম না। তাতে একটু মন খারাপ হলেও পরক্ষনে মনে হল আরে বই যোগাড় করা এখন কোনো কাজ? কাজে ঠিকই বইটা পেয়ে গেলাম এবং শুয়ে শুয়ে পড়ে ফেললাম আমার পড়া বাংলা ভাষার সেরা কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী।
মহাকাশের কোন একটি গ্রহে মানুষদের একটি মহাকাশযান গিয়ে পৌছায়। সেখানে তাদের সঙ্গে অয়ু, নিম ও লী নামের এই তিন প্রানীর সঙ্গে দেখা যবদেরকে তারা নিয়ে আসে নিজেদের মহাকাশযানে। দিন দুয়েক তারা সেখানে ছিল। এটাই কাহিনী।
অবশ্য কাহিনী মহাকাশযান ঐ গ্রহে নামার একটু আগে থেকে শুরু হয়। অয়ু-নীম-লির কথোপকথন দিয়ে কাহিনীর শুরু। এই তিন প্রাণী শুধু সমস্যার সমাধান করতে ভালবাসে। তারা চিন্তা করতে ভালবাসে। তারা ‘মনে করে’ সমস্যা সমাধান করেই সব কিছুর সমাধান করা যায়।
ঐ গ্রহে নিওথলি সভ্যতার নমুনা ছয়টা ঘরও রয়েছে। এই সভ্যতা একটি রহস্য। ওরা তিনজন এই রহস্য উদ্ধারের জন্য চেষ্টা করছে।
ওদের চিন্তার মধ্যে আছে আকাশের ওপারে কী আছে। “আরও আকাশ। তারপর আরও আকাশ”। এই বোধটা মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া একটু কঠিন। কিন্তু ওরা একরকম মেনে নেয়। আমি ভাবি লেখক কেন আকাশের কথা লিখেছেন? অন্য অনেক কিছু লিখতে পারতেন।
কারণটা সহজ এই দুনিয়াতে (Universe) যতো প্রাণি আছে তাদের সবার চূড়ান্ত জিঙ্গাষা হচ্ছে আমি কোথা থেকে এসেছি। আর অয়ূদের মতো আমরাও জানি উত্তরটা খুজতে হবে আকাশে।
মহাকাশযানে মানুষের সঙ্গে তাদের ইন্টারেকশনটা অদ্ভুত। তারা খেয়াল করে “মানুষেরা মুখে এক কথা বলে কিন্তু তাদের মনের মধ্যে অন্য কিছু”। এটি তাদের ভাবায়। তারা অবাক হয়। তারা বুঝতে পারে মানুষ বুদ্ধিমানপ্রাণী কিন্তু এখনও আরও উন্নত হওয়ার দরকার।
শেষুটুকু আমি বলছি না, পাঠক সেটা পড়ে নিক। আমার শুধু একটাই আপত্তি। মানুষেরা যখন তাদেরকে তিনটে আলাদা ঘরে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে তখন তারা সহজে সেখানে চলে গেছে। কিন্তু তারা তো জানতোই যে মানুষ যা বলে আসলে সেটা মিন করে না। তাহলে তারা কেন রাজী হলো?
না কি মানুষের এই নীচতার রহস্য উন্নত প্রাণিদের টের পাওয়ার কথা নয়।
[৬ বছর চেষ্টা করে আমি একটা সায়েন্স ফিকশন লিখেছি। ময়াল নামের এই বই-এর বিরুদ্ধে বেশিরভাগ পাঠকের অভিযোগ এটি যতো না সায়েন্স ফিকশন তার চেয়ে বেশি রহস্যকাহিনী। কেমন করে আমি বলি আমার মতো লোকের যেখানে একটা কাহিনী খাড়া করতে ৬ বছর লাগে সেখানে হুমায়ূন আহমেদ জাহাজের ডেকে হাটাহাটি করেই বাংলা ভাষার অন্যতম সেরা সায়েন্স ফিকশনটা লিখে ফেলেন]
[আমার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন টুইটার, লিংকডইন, ইউটিউব বা ফেসবুকে]