বিজ্ঞানের কদর আছে, আরো বাড়বে
বাজার ছোট এর ধারণাটিকে আর একটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে। অভিভাবক বা কোন কোন শিক্ষার্থী এই ক্ষেত্রে কিছু কারিগরি শিক্ষাকে হিসাবের বাইরে রাখেন। তাদের হিসাবে চিকিৎসা বিদ্যা, প্রকৌশল কিংবা ফার্মেসী শিক্ষার শিক্ষার্থীরা এই ধারার ব্যতিক্রম। কারণ তাদের চাকরির সেই অর্থে বড় রকমের সংকট নেই। কিন্তু এর বাইরে বিজ্ঞানের কোন বিষয়ে সেরকম কোন সুযোগ নেই।
একজন অভিভাবকের কথা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলছেন – “আমার ছেলেকে পদার্থবিজ্ঞান পড়িয়ে কী লাভ হবে। পড়াটা কাজে লাগবে এমন কোন চাকরিতো সে পাবে না!”
আমি জানতে চাইলাম তার ছেলে কী পড়ে। “ইতিহাস।”
আমি যখন তার কাছে জানতে চাইলাম চাকরি জীবনে ইতিহাসের জ্ঞান তার ছেলে কীভাবে কাজে লাগাবে তখন তিনি সত্যি কথাটা বললেন। বললেন- পদার্থবিজ্ঞান পড়তে যে কষ্ট তার সিকিভাগ কস্ট করে ইতিহাসে ডিগ্রীটা পাওয়া যায়।
তারমানে কথা দাড়ালো চাকরির সুযোগ শেষ কথা নয় বরং কম কষ্টে কীভাবে ডিগ্রি পাওয়া যায় সেটিই মুখ্য।
সত্যি কথা বলতে কী এই প্রতিযোগিতামূলক কর্মসংষ্থানের জগতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরাই কিন্তু অনেক বেশি চাকরি পান। সেটা বাংলাদেশই হোক কিংবা হোক দেশের বাইরে। দৃশ্যত দেশে ব্যাংক, বীমা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়াতে বাণিজ্য স্নাতকদের আপাত সুযোগ বেড়েছে। কিন্তু যেখানে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা হচ্ছে সেখানে বিজ্ঞানের স্নাতকরা এগিয়ে থাকছে। বিসিএস পরীক্ষার বিগত কয়েকবছরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে সেখানে সংখ্যা এবং মেধা তলিকার শীর্ষে থাকার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের স্নাতকদের সংখ্যায় বেশি। এমনকি সরকারি ব্যাংকগুলোতে এখনো বিজ্ঞানের স্নাতকদের সংখ্যা অন্যান্যদের চেয়ে সংখ্যায় বেশি।
প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের এগিয়ে থাকার অনেকগুলো কারণের একটি হল গণিত। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের গণিতে এবং যুক্তিতে বিশেষ পারদর্শিতা থাকে। আর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় গণিতে একটি ভাল নম্বর থাকেই!
এতো গেল চাকরি বাজারের প্রতিযোগিতার কথা। কিন্তু আগামীতে চাকরি বাহারে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের কী অবস্থা হবে?
অতি সম্প্রতি চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সভায় যোগ দিতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে জানলাম শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার বাইরে অন্যান্য বিষয়ে আগ্রহ কম। শিক্ষকরা জানালেন তাদের সব শিক্ষার্থীই স্নাতক হওয়ার আগেই চাকরি পেয়ে যায়। সেজন্য অন্যান্য বিষয়ে তাদের আগ্রহ নেই। বাংলাদেশের আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পরিস্থিতি বিদ্যমান?
আবার বিশ্বের অন্যান্যদেশের মত বাংলাদেশেও বাড়বে অটোমেশন ও স্বয়ংক্রিয়করণের কাজ। আর এর মাধ্যমে বাড়বে সিস্টেম অটোমেশন, অটোমেটেড সিস্টেমের রক্ষণাবেক্ষণ এবং নতুন নতুন সিস্টেম বোঝার কাজ। এগুলোর বড় অংশেই বিজ্ঞান মিক্ষার্থীরা এগিয়ে থাকবে। শুধু তাই নয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণা ও প্রয়োগ বাড়বে। বাংলাদেশেই আগামী ৫ বছরে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হবে। ঐ কেন্দ্রে জন্যই শতাধিক পদার্থবিজ্ঞানের লোক প্রয়োজন হবে। একইভাবে মানুষের প্রযুক্তি সম্পৃক্ততা বাড়ার ফলে প্রযুক্তি-সহায়ক সেবা ও কারিগরি খাতের পব্যাপক বিকাশ হবেই। সেখানে বিজ্ঞানের লোকদের কদর বাড়বে।
আর দেশে বাইরে?
বিশ্বব্যাপী অদক্ষ লোকের চাহিদা একেবারেই কমে যাচ্ছে। দক্ষ ও জ্ঞানকর্মীর চাহিদা বাড়ছে ব্যাপকভাবে। প্রযুক্তির বিকাশের কারণে দেশে দেশে জ্ঞান ও প্রযুক্তিকর্মীদের চাহিদা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে।
একটা উদাহরণ হতে পারে কাতার। ২০২২ সালে তারা ফিফা কাপের আয়োজন করবে। এজন্য স্টেডিয়াম বানাচ্ছে। ওরা ২০২০ সালের সামার অলিম্পিকের জন্যও চেষ্টা করছে। ফলে, আরো অনেক কিছু বানাবে- স্টেডিয়াম, হোটেল, হাসপাতাল, রাস্তা। প্রচুর শ্রমিক লাগবে সন্দেহ নাই। কিন্তু আরো কী লাগবে?
সবগুলো স্টেডিয়াম এবং নতুন স্থাপনাগুলোর বেশিরভাগ হবে স্বয়ংক্রিয়। ফলে, এগুলো ম্যানেজ করার জন্য হাইস্কিল লোক লাগবে অনেক। এদের হতে হবে রেফ্রিজারেটর বিশেষজ্ঞ, ইলেকট্রিসিটির পণ্ডিত, ইলেকট্রনিক্সের লোক, কম্পিউটার জানা। হোটেলগুলোর হাউস কীপিং এর জন্য লাগবে ভাল ইংরেজি জানা লোক। স্টেডিয়াম, হোটেল আর রাস্তা বানানোর জন্য সেখানে হাজির হবে শ’খানেক বা তারো বেশি বহুজাতিক কোম্পানি। সেই কোম্পানিগুলোর প্রত্যেক অফিসে ফ্রন্টডেস্কে লোক লাগবে, তাদের কম্পিউটারগুলো সচল রাখার জন্য মেইনটেইস্যান্সের লোক লাগবে, নেটওয়ার্কটাকে ৯৯.৯৯% সময় আপ থাকতে হবে।
ইচ্ছে করলেই এই লিস্ট আর বাড়ানো যায়। এটি কেবল কাতারের জন্য সত্য নয়। আগামী দিনগুলোতে বিশ্ব-রেমিট্যান্সের বড় অংশই চলে যাবে জ্ঞানকর্মীদের হাতে। আর সেই জ্ঞানকর্মীদের বড় অংশই হবে বিজ্ঞান জানা, বিজ্ঞানের মনোযোগী শিক্ষার্থী।
এরকম অবস্থায় শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে আগ্রহী করার জন্য আমাদের অনেক কাজ করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের এই সংক্রান্ত তথ্য জানিয়ে দেওয়া দরকার। আরো দরকার শ্রেণীকক্ষে বিজ্ঞান শিক্ষাকে আনন্দময় করে তোলা। আর এই কাজটি সম্ভবত সরকারি উদ্যোগ ছাড়াই সমাধান করা সম্ভব।
আমাদের দেশে প্রাথমিক পর্যায়ে, যখন শিক্ষার্থীদের মৌলিক ভিত্তি গড়ে ওঠে, বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষন করার চেষ্টা থাকে না। স্কুলগুলো গতানুগতিকভাবে পড়ানো এবং মুখস্থ করানোর কাজে লিপ্ত। বিজ্ঞানের ঝামেলা হচ্ছে এর যে পদ্ধতি অর্থাৎ পর্যবেক্ষণ, উপাত্ত সংগ্রহ, হাউপোথিসিস দাড় করানো ইত্যাদি ব্যাপারে আগ্রহী না হলে শেষ বিচারে কারো পক্ষে বিজ্ঞানে নিজের আগ্রহ ধরে রাখা অসম্ভব।
এক্ষেত্রে শিক্ষকরা শ্রেণী কক্ষে নানা উদ্যোগ নিতে পারে যাতে এই ব্যাপারগুলো শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গে করতে পারে। আমি একট উদাহরণ দিতে পারি। তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের “গ্রাফ” বোঝানোর জন্য একবার এক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পার্কিং লটে পাঠিয়ে দিলেন। ওদেরকে বলা হল কয়টা টয়োটা গাড়ি আর কয়টা অন্য গাড়ি তা গুণে আনতে। তারপর শিক্ষার্থীদের দেওয়া হল তারা কতোভাবে সেটি প্রকাশ করতে পারে। দ্বিতীয় দিন শেষে শিক্ষার্থীরা বারচার্টের জায়গাটাতে যেতে পেরেছে। তবে বেশিরভাগ স্কুলে এমনটি করা হয় না।
প্রাথমিকের পরে যখন শিক্ষার্থী সেকেন্ডারি স্কুলে যায় সেখানে ৯ম শ্রেণীতে শিক্ষার্থীদের গণিত বা বিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ শিক্ষক পড়ান আর ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম পর্যন্ত অন্য শিক্ষকরা পড়ান। আমি দেখেছি একটি স্কুলে ভূগোল শিক্ষককে গণিত আর বিজ্ঞান পড়াতে দেওয়া হযেছে। অনেকেই বলবেন ক্লাশ সিক্সের গণিত বা বিজ্ঞান এমন কী। যে কেও পড়াতে পারেন!!! আসলেই কী পারেন?
আমি চট্টগ্রামের মুসলিম হাই স্কুলে পড়েছি। আমাদের গণিত আর বিজ্ঞানের শিক্ষকদের অন্যতম ছিলেন সাত্তার স্যার (আল্লাহ তাঁকে বেহেস্থ নসীব করুন)। তিনি একদিন ক্লাশে এসে আমাদের একটি বাড়ির কাজ দিলেন। কাজটা সোজা। আমরা সবাই বাসায় গিয়ে বিভিন্ন ব্যাসার্ধের ১০টি বৃত্ত আঁকবো। তারপর মায়ের কাছ থেকে সুতা নিয়ে সেটির পরিধি আর ব্যাস মাপবো এবং পরিধিকে ব্যাস দিয়ে ভাগ করবো। আমার এখনো মনে পড়ে সেদিন বাসায় ফিরে আমি কতোটা উত্তেজিত ছিলাম। মায়ের কাছ থেকে সুতা নিয়ে নানান রকম কায়দা কানুন করে পরেরদিন বাড়ির কাছ করে স্কুলে যাই। আমরা ভেবেছিলাম স্যার আমাদের খাতা দেখবেন কিন্তু তিনি তা না করে ব্ল্যাকবোর্ডে চলে যান এবং এক একজন করে সবার কাছ থেকে ১/২/৩টা করে ফলাফল জানতে চান (মানে পরিধিকে ব্যাস দিয়ে ভাগ করে আমরা কতো পেয়েছি)। সেই রেজাল্ট তিনি বোর্ডে লিখতে শুরু করেন এবং আমরা ক্রমাগত অবাক হয়ে দেখতে থাকি যে আমার রেজাল্টের সঙ্গে আর একজনের রেজাল্ট মিলে যাচ্ছে, সবাই কমবেশি ৩.২ বা সেরকম কিছু উত্তর পেয়েছি। স্যার যখন বোর্ডের মাঝমাঝি এসেছেন ততক্ষনে আমরা হৈচৈ ফেলে দিয়েছি। স্যার তখন ব্যাখ্যা করলেন – যেমন করেই তুমি বৃত্ত আকঁ না কেন, তার পরিধিকে ব্যাস দিয়ে ভাগ করলে ফলাফল সবসময় একই হবে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি ঐ ক্লাসে আমরা যারা ছিলাম তাদের মাথা থেকে পাই (Pi) কেও আর কোনদিন বের করতে পারবে না। এটি সাত্তার স্যারের মতো শিক্ষক যিনি সর্বদা গণিত আর বিজ্ঞান নিয়ে ভাবেন তার পক্ষেই সম্ভব।
অন্যদিকে ক্লাশ সিক্স বা এইটে পড়ার সময় আমাদের শিক্ষার্থীরা কোনদিন ল্যাবরেটরিতে যায় না। যায় ক্লাশ নাইনে ওঠার পর। কিন্তু ওকে যদি নিচের ক্লাসে দেখানো যেতো একটি পানি ভর্তি গ্লাসকে উল্টে দিলে সেটি থেকে পানি পড়ে না বা একটু আলপিন দিয়ে বেলুনকে ফুটো করলেও সেটি ফাটে না তাহলে বিজ্ঞানের প্রতি তার আকর্ষনটা অনেক বাড়তো।
আমার কথা এইটুকু। নিজেরা একটু উদ্যোগী হলে স্কুলগুলোতে নিচের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষিত করার চেষ্টা করতে হবে। এজন্য শিক্ষকরা একটু উদ্যোগী হলেই হবে। ইন্টারনেট আর বই এর কারণে আমি যে পদ্ধতিগুলো উল্লেখ করছি সেগুলো এখন সহজে প্রাপ্য। কেবল একটু সদিচ্ছা দরকার।
আর স্কুলের বাইরে যাতে শিক্ষার্থিরা বিজ্ঞান নিয়ে বাড়তি ভাবে সেটার জন্য আলাদা করে শুরু হতে পারে বিজ্ঞান মেলা, বিজ্ঞান কংগ্রেস জাতীয় আয়োজন। তবে খেয়াল রাখতে হবে সেটি যেন এখনকার সরকারি মেলাগুলোর মত কেবল আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত না হয়।
আমাদের স্বেচ্ছাসেবী বিজ্ঞান সংস্থা বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি থেকে আমরা গত বছর থেকে গুগলের বিজ্ঞান মেলায় অংশগ্রহণে আগ্রহীদের প্রশিক্ষণের আয়োজন করছি। এছাড়া এই বছর থেকে আমরা শুরু করেছি শিশু কিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেস (www.cscongress.org)। স্থানীয়ভাবে এরকম নানান আয়োজন সম্প্ন করা যায়।
আর একটি বিষয়ে সরকারি সহযোগিতা ছাড়াও কাজ করা যায়। এটি হলো নিজ গ্রামের স্কুলের বিজ্ঞানাগারটিকে সাজিয়ে দেওয়া। অনেক স্কুলেই বিজ্ঞানাগারে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় সেটি কোন কাজ লাগে না। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা সহজে এই কাজে এগিয়ে আসতে পারেন।
{শিক্ষার বার্ষিক প্রতিবেদন, হালখাতা চট্টগ্রাম, স্কুল কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষার হালচাল -এ প্রকাশিত}
One Reply to “বিজ্ঞানের কদর আছে, আরো বাড়বে”