Perhaps sir, you will someday come back with books

Spread the love
রুমের দরজায় “School Library” কথাটা গর্বের সঙ্গে তার অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। তবে, রুমের ভিতর পুরোটাই খালি। একটি দেয়ালে পৃথিবীর মানচিত্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুগোশ্লাভাকিয়ার উপস্থিতি দেখে বোঝা যাচ্ছে কমপক্ষে এক দশকের প্রাচীণ। তবে, কোথাও কোন বই চোখে পড়ল না!
আমি সর্বোচ্চ বিনীতভাবে আমার প্রশ্নটি করলাম-
এটি খুবই সুন্দর একটি লাইব্রেরি রুম। আমাকে এটি দেখানোর জন্য আপানাদের ধন্যবাদ জানাই। আমার মাত্র একটি প্রশ্ন- ঠিক কোথায় আপনাদের বইগুলো?
প্রধান শিক্ষক দ্রুত রুম থেকে বের হলেন। একজন শিক্ষক একটি চাবি হাতে এসে রুমের মধ্যে রাখা ডেনিয়েল স্টিলের কেবিনেটটি খুললেন।
বই খুবই পবিত্র বস্তু। স্কুলের মাত্র গোটা কয়েক বই আছে। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের হাতে সে বই তুলে দিতে পারেন না, নষ্ট হয়ে যেতে পারে! তাই সেগুলো তালা মেরে রাখা হয়। সাকল্যে কয়েকটি মাত্র বই।
আমি জানলাম ঐ স্কুলে ৪৫০ জন শিক্ষার্থী আছে। ৪৫০টি শিশুর কোন বই নাই। আমি ভাবলাম কীভাবে এটা সম্ভব। এই সময় যখন কিনা বিশ্বে অনেক জাগতিক সম্পদ তৈরি হয়েছে?
প্রধান শিক্ষক জানালেন – আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের পড়ার অভ্যাস গড়তে চাই কিন্তু পারি না। কারণ এই আমাদের সম্পদ।
 
আমি সাহায্য করার কথা ভাবলাম। কিন্তু ওনারা কীভাবে নেবেন।
আমাকে বাঁচালেন হেড স্যার। বললেন-
“Perhaps sir, you will someday come back with books”
————————————————————-
 
আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে আমি জন উডের লিভিং মাইক্রোসফট টু চেঞ্জ দ্যা ওয়ার্ল্ড বইটি পড়ার সময় এ জায়গাতে এসে কেঁদে ফেলি। নেপালের যে ঘটনা থেকে উডের রুম টু রিডের সূচনা এটি তাইা। তারও প্রায় এক দশক আগে থেকে আমি বাংলাদেশের স্কুলে স্কুলে যেতে শুরু করি, গণিত অলিম্পিয়াডের জন্য। তখন থেকেই আমি জানি আমাদের স্কুলগুলোর লাইব্রেরির কী অবস্থা!
এখন সরকার প্রতিবছর বিরাট সংখ্যক বই স্কুলের লাইব্রেরির জন্য কেনে, তবে এখনও বেশিরভাগ স্কুলের লাইব্রেরিগুলো সচল নয়। বেশিরভাগ স্কুলে শিক্ষার্থীরা তাদের লাইব্রেরি খোলা দেখে না। আমি আমার স্কুল জীবনে কখনো স্কুল লাইব্রেরি থেকে কোন বই নিতে পারি নাই। তবে, আমার মেয়ের স্কুলের লাইব্রেরিটা খুবই সুন্দর। বিদুষী সপ্তাহে দুইটি নতুন বই সেখান থেকে আনে। ওদের স্কুলে লাইব্রেরি আওয়ারও আছে।
তবে, বেশিরভাগ স্কুলেই লাইব্রেরি আওয়ার নেই।
রংপুর বন্ধুসভার লাইব্রেরির জন্য আমার বই

জন উডের লেখা পড়ার পর থেকে আমি প্রতিবছরই কোন না কোন লাইব্রেরিতে কিছু বই দেওয়ার চেষ্টা করি। এ বছর আমার দুইটি বই বের হয়েছে। কাজে আমি যখন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাই, ঐ দুই বই সঙ্গে নিয়ে যাই। লাইব্রেরির জন্য দিয়ে আসি। প্রায় ৪০০+ কমিউনিটি লাইব্রেরিতে আমার এই দুইটা বই আমি পাঠিয়েছি। যারা সেগুলো চালান তাদের সঙ্গে কথা বলে খুব ভাল লাগে। মাত্র দুটো বই হয়তো নতুন একজন পাঠক সৃষ্টি করে। গ্রাম পাঠাগার আন্দোলনের সাত্তার, হিমু পরিবহনের মুরাদ, আসলাম, ড্রিমস ফর টুমরোর জাভেদ পারভেজ, প্রথম আলো বন্ধুসভার বন্ধুরা তাদের নিজেদের সামর্থে কমিউনিটি পাঠাগার গড়ে তুলেছে, সেটিকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আমার অন্যতম প্রিয় মানুষ মাহমুদ ভাই তাদের গ্রামে একটি পাঠাগার গড়ে তুলেছেন। সেখানেও আমার কিছু বই দেওয়ার কথা। তবে, আমার মতো একটা অলস লোক কি এতো কিছু করতে পারে!

রংপুরের শিশু নিকেতন স্কুল লাইব্রেরির জন্য হেড স্যারের হাতে দিয়েছি। আমার পাশে আমাদের গ্রেট রুজু ভাই

গত এক সপ্তাহে রংপুর, চট্টগ্রাম ঢাকার কয়েকটা স্কুল কলেজে বই দিয়ে এসেছি, লাইব্রেরির জন্য, স্যার/ম্যাডামদের জন্য। চট্টগ্রামে প্রিয় শিক্ষক ড. জয়নব বেগমকে দুইটি বই দিয়ে এসেছি। একদিন পরেই তিনি ফোন করে জানালেন – মুনির তোমার শরবতে বাজিমাত বইটি আমি পড়ে ফেলেছি। ভাল লেগেছে। (আরও যা বলেছেন সেগুলো লিখতে চাই না। সবাই ভাববে আমি আমার বই-এর বিজ্ঞাপন করছি)। 

হুমায়ূন আহমেদে স্যারের এক রুম বই-এর সন্ধান পেয়েছি। সেগুলো আগামী মাসে কয়েককটা বড় কমিউনিটি লাইব্রেরিতে পাঠানোর চেষ্টা করবো। (থুব আনন্দের সঙ্গে কাজটা করতে পেরেছি)
কলম্বিয়াতে গিয়ে দেখেছি সেখানে অনেক “রাস্তার ধারের লাইব্রেরি” আছে। এয়ারপোর্টেও আছে। ওখানে বই সাজানে থাকে। ইচ্ছে করলে আপনি বই নিয়েও যেতে পারবেন, তবে একটা বই নিতে হলে দুইটা বই সেখানে রাখতে হবে। অনেকেই এয়ারপোর্টে বই পড়ে যাবার সময় সেটি সেখানে রেখে যায়। ঐ লাইব্রেরি গুলোতে কোন পাহারাদার থাকেন না!
আমাদের দেশে লাইব্রেরি সংস্কৃতি গড়ে না ওঠার মুল কারণটা আমি বের করেছি অনেকদিন আগে। সেটা হলো আমাদের পূর্ব পুরুষদের সঠিক ইংরেজি জ্ঞানের অভাব। ভারতের মুসলমানরা ইংরেজী ভাষাকে মেনে নেয়নি কারণ ইংরেজরা মুসলমানদের কাজ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিল। ইংরেজিকে দূরে রাখার কারণ তাদের ইংরেজি জানা হয়নি। কাজে যখন তারা নানা কিছু অনুবাদ করে তখন নানা রকম ভুল করে। যেমন area র অনুবাদ করে আয়তন, আসলে সেটা হবে ক্ষেত্রফল। প্রতিবছর আমাদের বোঝাতে হয় বাংলাদেশের আয়তন বলে কিছু নাই, ঐটি ক্ষেত্রফল হবে।
তবে, এটির সর্বংসহা রূপ হলো ইংরেজি Bookshop, bookstore আর library-র মধ্যে গুলিয়ে ফেলা।
আমি চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা এলাকাতে বেড়ে উঠেছি। সেখানেই ছিল চট্টগ্রামের বেশিরভাগ বই-এর দোকান। সেগুলোর নাম ছির ছাত্র-সখা লাইব্রেরি, তাজ লাইব্রেরি, জনতা লাইব্রেরি! জী, এখনও এ দেশে বই বিক্রির দোকানকে বলা হয় লাইব্রেরি!!! অথচ সেগুলো মোটেই লাইব্রেরি নয়, বুকশপ মাত্র। লাইব্রেরির প্রকৃত বাংলা শব্দ হলো পাঠাগার। যেখানে সবাই বই পড়তে পারবে।
ঐ যে আমরা বই-এর দোকানকে লাইব্রেরি বানিয়েছি, তখন থেকেই কাউকে লাইব্রেরিতে যেতে বললে সে ভাবে কেন সে বই কিনতে যাবে। “বই তো তার একখানা রয়েছেই”।
আমার আত্মজীবনীর  প্রথম পর্বটির নাম পড়ো পড়ো পড়ো। কারণ সেটি বই পড়ে আমার নিজেকে খুঁজে পাওয়ারই কাহিনী। এই বই-এর শেষে আমি আমাকে বদলে দেওয়ার বই-এর একটা তালিকাও দিয়ে দিয়েছি।
এ বছর থেকে বইমেলার সময় প্রতিদিন একটা বই পড়ে সেটি রিভিউ করে আমার সাইটে প্রকাশ করতে শুরু করেছি, মোটামুটি গোটা বিশেক করতে পেরেছি।
আমি যখন এক শহর থেকে অন্য শহরে যাই তখন এয়ারপোর্ট থেকে আমি ফেসবুকে যে পোস্ট দেই সেটা একটা বই-এর ছবি। আমার পড়ার তালিকায় একটি বই থাকে যেটি আমি কেবল প্লেনেই পড়ি। এখন Frugal Innovation নিয়ে বইটা পড়ছি।
এসবই আমার আশে পাশের মানুষকে বই পড়াতে উদ্বুত্ত করার চেষ্টা মাত্র। যদিও সমুদ্রে এক ফোঁটা জল কিছুই করতে পারে না। 

এসবই আমি করি কারণ আমি জানি, যে জাতি যতো বেশি পড়ে তারা ততো বেশি এগিয়ে যায়। আর যারা পড়ে না তারা দৌড় দিয়ে রাস্তা পার হয়, ওভারব্রিজের উল্টো দিক দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেয়, মোটর সাইকেল তুলে দেয় ফুটপাতে!

মহামানবের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার প্রথম নির্দেশও কিন্তু তাই ইকরা, পড়ো।

আমরা যদি না পড়ি আমরা কেমন করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মোকাবেলা করবো?

 

সবার জন্য শুভ কামনা।
 
 
 
 

Leave a Reply