কমরেড রতন সেন কলেজিয়েট স্কুল
বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম- নারে মা, আমি তো কিছুই করি নাই।তোমরা সফল হয়েছো তোমাদের চেষ্টায়, অধ্যবসায়ে এবং ভালবাসায়!
আমি দ্রুত ওখান থেকে চলে এসেছি। আমার চোখের পানি ওরা না দেখলেই ভাল।
এর মধ্যে এই বছর আমাদের আলোর ঝিলিকের কর্মকাণ্ড শুরু হলে জুনায়েদ আর ইব্রাহিম একদিন সেখানে যায় আলোর ঝিলিক করতে। ফিরে আসার পর আমরা ওদের স্কুলের আর ছাত্রীদের অদম্য ইচ্ছাশক্তির কথা জানতে পারি। তখনই ঠিক করি সামার সায়েন্স ক্যাম্পের একটা সেখানে করার। সে কথা অনুসারে সামার সায়েন্স ক্যাম্পের জন্য সেখানে যায় ইব্রাহিম আর আবীর। এই দুই কর্মশালার প্রভাব কেমন হয়েছে সেটা অনেকেই হয়তো জেনে গেছেন।
খুলনা গেলেই ওই স্কুলে যাবো বলে ঠিক করেছিলাম। তাই লিয়াকত ভাইকে বললাম খুলনা থেকে বরিশাল যাওয়ার পথে ঐ স্কুলে যেতে চাই। যথারীতি লিয়াকত ভাই ২৪ তারিখ সকালেই আমাদের জয়োৎসবে চলে এসেছেন। জানালেন স্কুল ছুটি হবে পৌনে ৪টায়। তার আগে আমাদের পৌছুতে হবে। তথাস্তু।
যাওয়ার পথে আমি লিয়াকতভাই-এর গাড়িতে উঠেছি।যেতে যেতে জেনেছি স্কুলের বৃত্তান্ত।
কমরেড রতনসেনকে রূপসার ডোমরা গ্রামে থাকার জন্য কিছু জায়গা দিয়ে যান একজন। তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় ১০ বছর সেগুলো অযত্নে পড়ে থাকে। ১০ বছর পর লিয়াকত ভাই-এর নেতৃত্বে স্কুলের কাজ শুরু হয়।
রূপসা এলাকাটিতে একটি নীরব দারিদ্র আছে। যার কারণে মেয়েদের সর্বোচ্চ পড়াশোনা হয় ক্লাশ ফাইভ পর্যন্ত। তারপর বেশিরভাগ মেয়েরই বিয়ে হয়ে যায়! সেই সব ঝড়ে পড়া মেয়েদের নিয়ে কমরেড রতন সেন স্কুলের যাত্রা শুরু ২০১০ সালে। ৩৩ জন ছাত্রীকে একটি সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে ক্লাশ নেওয়া শুরু হয়। এর মধ্যে পুরো জায়গাটা উদ্ধার করা হয় দখলদারদের কবল থেকে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সহায়তা রতনসেনের নামের ৩ একর ৪৪ শতাংশ জমি লিখে দেওয়া হয় স্কুলের নামে। সেখানে একটা পুকুর আছে।
৩৩ জন ছাত্রীকে নিয়ে যাত্রা শুরু। দেখা গেল মেয়েরা সবাই অপুষ্টিতে ভোগে। ঠিক হল তাদের দুপুরে খাবার দেওয়া হবে। খাবার কই পাওয়া যাবে? শুরু হল স্কুলের জমিতে চাষাবাদ। সবিজি বাগান এবং নানান রকম ফল-পাকুড়ের গাছ লাগানো হল।
করা হল সপ্তাহের পাঁচদিনের দুপুরের খাবারের রুটিন – দুইদিন সবজি ভাত, দুইদিন ডাল ভাত এবং একদিন মাছভাত। মাংস খাওয়ানোর সামর্থ নেই, তাই সেটা রুটিনে নেই। তবে, কখনো কখনো প্রশাসন বা কোন ধনাঢ্য ব্যক্তি এ কাজটা করেন। মাছটা পাওয়া যায় স্কুলের পুকুর থেকে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানও মাঝে মধ্যে দেয়।
স্কুল থেকেই মেয়েদর স্কুলের পোষাক বানিয়ে দেওয়া হয়। রোটারী ক্লাবের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় প্রয়োজনীয় খাতা।
স্কুলে বিজ্ঞানাগার আছে, আছে ছোট একটা লাইব্রেরি।
স্কুল কমপ্লেক্সের একটি ডিটেইল ম্যাপ করা হয়েছে। দুজন স্থপতি এটি করে দিয়েছেন বিনে পয়সায়।
সেই প্ল্যান অনুসারে একটা একাডেমিক ভবনের কাজ শুরু করেছেন শহীদুল্লাহ এসোসিয়েটসের প্রধানপুরুষ প্রকৌশলী শহিদুল্লাহ। তিন তলার কাঠামো হয়েছে। কিন্তু চারদিকের দেওয়াল হয়নি। সেখানেই এখন তিনটা ক্লাশ শিফট করা হয়েছে। এছাড়া বাকী দু্টি ঘর কো হয়েছে – একটি বেড়ার আর একটি গোলপাতার ছাউনি! ওখানেই ওরা পড়ে।
রতনসেনের মূলবাড়িটাতে স্কুলের অফিস, স্যার/ম্যাডামদের বসায় জায়গা, লাইব্রেরি আর বিজ্ঞানাগার। একটি দোচালা ঘর আছে, কয়েকজন শিক্ষক সেখানে থাকেন। স্কুলের কর্মচারীদের জন্য কয়েকটি বেড়া-ছনের বাড়িও আছে। ড্যানিডা থেকে পাকা ল্যাট্রিনও করে দেওয়া হয়েছে।
রানানাঘরটি স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরি করা হয়েছে। প্রতিদিন দুপুরে মেয়েরা লাইন ধরে দাড়িয়ে নিজ নিজ প্লেটে খাবার নিয়ে শ্রেণীকক্ষে চলে যায়। সেখানেই খাওয়া। ওদের স্কুল শুরু হয় দুপুর সাড়ে দশটায়। তবে, যারা পড়ালেখায় কিছুটা দু্র্বল তাদের জন্য বাড়তি কোচিং-এর ব্যবস্থা করা হয় সকাল থেকে। ১৩ জন শিক্ষক রয়েছেন একজন অধ্যক্ষ সহ। আশেপাশের স্কুলগুলোর তুলনায় পাবলিক পরীক্ষায় ওদের ফলাফল বেশ ভাল। তাই প্রশাসনও সুনজরে দেখে। স্কুলটি এমপিও ভুক্ত নয়, কারণ সুপারিশ বা তদবির করার মত স্ট্রং কেও নাই!
বোঝায় যাচ্ছে, স্কুলের ছাত্রীরা সম্পূর্ণ বিনে পয়সায় সেখানে পড়ে খরচ আর স্যারদের বেতন দেওয়া হয় ডোনেশনের টাকায়। তবে, প্রশাসনের সুনজরে থাকায় শিক্ষকরা প্রশিক্ষণের সুযোগ পায় এবং যথারীতি প্রশিক্ষণ হয়ে যাবার পর এমপিওভুক্ত স্কুল/মাদ্রাসায় চলে যান! ওদের ধরে রাখার সামর্থ এই স্কুলের নেই। আমরা থাকতে থাকতে শুনেছি ইংরেজির শিক্ষকের চাকরি হয়েছে পাশের এমপিও ভুক্ত মাদ্রাসায়। কাজে উনি চলে যাবেন। লিয়াকত ভাই চিন্তিত কারণ জেএসসির আগে আগে আর একজন এই মানের শিক্ষক কই পাবেন?
আমরা স্কুলের সবটা জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখেছি। তারপর ২৭৬ জন ছাত্রীর যারা উপস্থিত ছিল তারা সবাই একত্রিত হয়েছে। যারা জয়োৎসবে গিয়েছিল, তারাও আমরা যাবো বলে স্কুলে ফিরে গিয়েছে। আমরা ওদের কথা শুনেছি। আমাদের মধ্যে জুণায়েদছাড়াও ফারহানা আর ফারসীমও ওদের উদ্দেশ্যে কথা বলেছে। আমিও ম্যালা বববক করেছি। বলেছি জেন মুলম্যানের কথা। বলেছি প্লেটোর ওস্তাদের কথা। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের মানচিত্রের গল্পটাও বলে এসেছি।
কাল সেখান থেকে বরিশাল আর আজকে বরিশাল থেকে ফেরার সময় ভাবছিলাম, আচ্ছা আমরা কী কোনভাবে ওদের লড়াই-এ যুক্ত হতে পারি? আমার তো টাকা কড়ি নাই কাজে সে লাইনে চিন্তা করে লাভ নাই। বরং নিচের কাজগুলো যদি করা যায় তাহরে হয়তো ওদের পামে আমরা দাড়াতে পারবো-
- ওদের লাইব্রেরিটা সমদ্ধ করে দেওয়া। এটা খুবই সহজ হবে। আমার নিজের সব বই, ২/১জন প্রকাশককে আমি চিনি, বললে নিশ্চয়ই কিছু বই ওনারা দেবেন। আর আমার নেটওয়ার্কের বন্ধুরা? তারা যদি কয়েকটা বই দেয় তাহরেই আমরা ওদের লাইব্রেরিটা গুছিয়ে দিতে পারবো
- ও এলাকায় সব নেটওয়ার্কই খারাপ। ওখানে ইন্টারনেট নেওয়া খুব একটা সহজ হবে না। তারপরও রবিকে অনুরোধ করবো যাতে ওদের নেটওয়ার্কটা আরো একটু কার্যকর করে। তাহলে ইন্টারনেট ডট অর্গ থেকে তাদের জন্য বেসিক ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করা যাবে্। দরকার হবে মাত্র দুইটা স্মার্টফোন।
- গোটা কথক পুরোনো ল্যাপটপ যোগাড় করতে পারলেই ওদের জন্য একটা কম্পিউটার ল্যাব বানিয়ে ফেলা যাবে।
এগুলো আপনারা আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেই আমরা করে ফেলতে পারবো। আমি আমার নেটওয়ার্কের শক্তিশালীদের বলবো নিচের দুইটা কাজে সহায়তা করতে-
- স্কুলটাকে এমপিওভুক্ত করা,
- আইসিটি ডিভিশন থেকে একটি কম্পিউটার ল্যাব করে দেওয়া
আর নিজের কাজগুলো মনে হয় আমরাই করে ফেলতে পারবো-
- ছাত্রীদের গণিত আর বিজ্ঞান পড়ায় সাহায্য করার জন্য ভলান্টিয়ারদের পাঠানো। শুরু হবে গণিত অলিম্পিয়াডের ভলান্টিয়ারদের দিয়ে।
দেখা যাক আদৌ কিছু করতে পারি কী না!
আমাদের কাছ থেকে ওরা কী পেয়েছে আমি জানি না। তবে, এদের দেখে, ওদের বড় আব্বুর (লিয়াকত ভাই) কাজকর্মের কথা শুনে সর্বোপরি ওদের আত্মবিশ্বাস দেখে আমি অনেক কিছু শিখেছি, মনের জোর অনেক বেড়েছে। নিজের ক্ষুদ্রত্বও নতুন করে বুঝতে পেরেছি।
আমাদেরকে ওরা বিদায় দিয়েছে সবাই মিলে গান গেয়ে। আমরা করবো জয় একদিন।
সেই থেকে আমার মনের গভীরে একদল মেয়ের আত্মবিশ্বাসী মুখ ভাসছে, যারা কীনা বুকে হাত দিয়ে গলা উচিয়ে গায়তে পারে-
বুকের গভীরে আমরা জেনেছি, আমরা করবো জয় একদিন।