আবেগীয় বুদ্ধিমান এবং কলিন পাওয়েলের ১৩টি নিয়ম
কিছুদিন আগে মারা গেছেন আমেরিকার এক সময়কার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জেনারেল কলিন পাওয়েল। যুদ্ধবাজ এই জেনারেলকে মানুষ নানা কারণে মনে রাখবে, যেমন ইরাকের অসম যুদ্ধ। কিন্তু ইমোশনালি ইন্টেলিজেন্ট বা আবেগীয় বুদ্ধিমানরা তাকে মনে রাখবে ‘নেতৃত্বের ১৩টি নিয়ম’এর জন্য। কলিন পাওয়েল আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ সেনা কর্মকর্তা যিনি ৪-তারকা জেনারেল, জয়েন্ট চীফ অব স্টাফ ও বুশের আমলে সেক্রেটারি অব স্টেট হয়েছেন।
তার মৃত্যুর পর তার নেতৃত্বের ১৩টি নিয়ম নিয়ে আবারও অনেক লেখালেখি হয়েছে সেখানকার ও বিশ্বের কয়েকটি গণমাধ্যমে। এরকম লেখাতে আমিও নিয়মগুলো পড়েছি। ভেবেছি কেন আবেগীয় বুদ্ধিমানরা এই নিয়মগুলো মেনে চলতে চায়।
উত্তরটা পেলাম বিল মার্ফি জুনিয়রের একটি নিবন্ধে। ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্ট নিয়ে বিল নিজেই একটি ইনস্টিটিউট। বিল লিখেছন, “তার (কলিন পাওয়েল) মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর আমি নিয়মগুলো আবার পড়েছি। আমি বুঝতে পেরেছি নিয়মগুলো সফল হওয়ার অন্যতম কারণ হলো এগুলোর প্রত্যেকটি ‘কাজ (Action)’ থেকে আবেগ(Emotion)কে আলাদা করেছে। এটি আসলে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সের প্রধান বৈশিষ্ট্য”।
নিয়ম ১ : আধার রাতের শেষে ভোরের আলোর দেখা মেলে
শুরু করার জন্য চমৎকার একটি নিয়ম। পড়তে পড়তে আমার মনে পড়েছে ছোট বেলায় পড়া “রুশ দেশের উপকথা’ -এর কথা। সেখানে যাদুকরী ভাসিলিসা, তীরন্দাজ আন্দ্রের সুন্দরী স্ত্রী মারিয়া কিংবা খুদে ইভানের মুখে এই কথাটা আমরা প্রায়শ শুনেছি। কোন কঠিন সিদ্ধান্তহীনতার সময় তারা বলতেন – এখন ঘুমাতে যাও। রাত পোহালে বুদ্ধি বাড়ে। কলিন পাওয়েলও বলছেন – যত কঠিন সমস্যা হোক না কেন সকালে কোন না কোন আলোর খো্ঁজ পাওয়া যাবে। মোদ্দা কথা হলো খারাপের চিন্তায় অস্থির হওয়া যাবে না কারণ তাতে কোনো লাভ নেই। ২০১২ সালে প্রকাশিত কলিন পাওয়েল তাঁর ইট ওয়ার্কড ফর মি বইতে লিখেছন – নিয়মগুলো মনোভাবের প্রতিফলন, ভবিষ্যদ্বানীর নয়।
নিয়ম ২: রাগ ঝেড়ে ফেলুন
রাগ কিন্তু জীবনের অংশ। কাজে রাগাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা পুষে রাখা যাবে না। তাতে কাজেরই ক্ষতি হবে। কাজ শুরুর আগে নিজের রাগ ঝেড়ে ফেলুন যাতে তা আপনার সিদ্ধান্ত গ্রহণে খারাপ প্রভাব ফেলতে না পারে।
নিয়ম ৩: যুক্তিকে আবেগের উর্ধে থাকুন
তর্ক-বিতর্কের সময় আপনি নানা যুক্ত সাজাবেন। কিন্তু যুক্তিতে নিজের মন-প্রাণ একেবারেই সঁপে দেবেন না। কারণ আপনার যুক্তি শেষ পর্যন্ত ধোপে নাও টিকতে পারে। কিন্তু যদি এর সঙ্গে আপনি যদি আবেগ যুক্ত করে ফেলেন, তাহলে যুক্তির পরাজয় আপনার পরাজয় হয়ে উঠবে। এটা শুধু নিজের জন্য মনে রাখলে হবে না। যাদের সঙ্গে আপনার কাজ তাদের বেলায়ও সত্য হতে পারে্। বুদ্ধিমান লোককে যথেস্ট জায়গা দিন যেন যুক্তিতে হেরে গেলেও সে জেন এটা মেনে নিতে পারে। তার যেন মূখরক্ষা হয়। মনে রাখবেন বোকারা মেনে নেয়, বুদ্ধিমানরা তর্ক করে কিন্তু প্রতিভাবানরা এগিয়ে যায়।
নিয়ম ৪ – পারবো
নেগেটিভ চিন্তা থেকে আমরা অনেক সময় ফলাফল খারাপ হবেই এমনটা ভেবে নেই। তারপর আর ঐ কাজ করতে উৎসাহ পাই না। তারপর না করার পক্ষে যুক্তি সাজাই। এ থেকে বের হতে হবে। পাওয়েল বলছেন যতক্ষণ পর্যন্ত তথ্য ও পরিস্থিতি একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত পজিটিভ এবং উদ্দীপ্ত থাকতে হবে।
নিয়ম ৫ – সতর্কতার সঙ্গে বাছাই (পেয়েও যেতে পারেন)
সামরিক বাহিনীর একটি চালু উক্তি হলো – “ধীর হলো মসৃন আর মসৃন হলো দ্রুত (Slow is smooth, and smooth is fast)” অর্থ সোজা। কাজ শুরুর আগে পদ্ধতিগত চিন্তা করলে ভুল কম হবে। ফলে লক্ষ্যের কাছে পৌছানো সহজ হবে। পাওয়েলের ভাষায় – তাড়াহুড়া করতে নেই।
নিয়ম ৬ : সিদ্ধান্তের সময় প্রতিকুল তথ্যকে ‘না’ বলুন
পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যতো ভাল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তার কোনটাই “সকল তথ্য ও উপাত্তের” ভিত্তিতে নেওয়া হয়নি। কারণ সকল তথ্যের জন্য অপেক্ষা করলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আর দরকার হয় না। মর্ত্যের মানুষ মাত্রই ভুল করবে। এটা মেনে নিয়েই এই অনিশ্চয়তা মেনে চলতে হয়। কাজে নিজের ভাল প্রবৃত্তির ওপরও ভরসা রাখতে শিখুন। আপনার অভিজ্ঞতা আপনার ‘গাট ফিলিং’ তৈরি করে।
নিয়ম ৭ : অন্যের সিদ্ধান্ত আপনি নিতে পারবেন না
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীগিরি শেষ হওয়ার অনেক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরির অফার পান কলিন পাওয়েল। পাওয়েলের ভাষায়, “তারা আমার পছন্দের জন্য কঠিন পরিশ্রমও করেছে। কিন্তু শেষমেষ আমি আমার পছন্দে স্থির ছিলাম”। এই নিয়মে আসলে সেটাই বলা হয়েছে। পথ চলতে অনেক সুযোগ পাওয়া যাবে, অনেকেই সুযোগের পসরা সাজিয়ে বসে থাকবে। এর মধ্যে কিছু কিছু দারুন মনে হবে, সম্ভাবনাময়ও থাকবে। কিন্তু সেগুলো আপনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিলে না। তখন কঠিন সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে হবে।
নিয়ম ৮- ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালু কনা, বিন্দু বিন্দু জল
আবেগীয় বুদ্ধিমানরা খুটিনাটি জিনিষের প্রতি মনোযোগ হারায় না। এতে তাদের উৎসাহ, আশাবাদ ও উত্তেজনা কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বজায় থাকে। ছোট ছোট সাফল্যের যোগফলে কিন্তু বড় কাজটা শেষ হয়।
নিয়ম ৯- সাফল্যের ভাগ দিন
দুই কারণে এই নিয়ম মেনে চলুন। প্রথম এটি আপনার অহংকারকে নিয়ন্ত্রণ করবে। দ্বিতীয় কারণ হলো আপনাকে মনে রাখতে হবে আপনার আশেপাশে যারা আছে তারাও আবেগের অনুসারী। তাদেরকে মোটিভেটেড রাখার জন্য আপনাকে সাফল্যের স্বীকৃতি তাদের দিতে হবে। পাওয়েলের ভাষায় – খাবার ও পানি যেমন দরকার তেমনি দরকার স্বীকৃতি ও মূল্যবোধ।
নিয়ম ১০ শান্ত ও বিনয়ী থাকুন
উৎকন্ঠা উৎকণ্ঠাকে, দুশ্চিন্তা আরও দুশ্চিন্তাকেই ডেকে আনে। আখেরে কোন লাভ হয় না। শান্ত থাকলেই শান্তি। মানুষের সঙ্গে সদ্ব্যবহার, সহানুভূতির প্রকাশ এবং তাদের প্রতি বিনয়ী থাকাই হচ্ছে আবেগীয় বুদ্ধির চমৎকার প্রয়োগ। আবেগের যথাযথ ব্যবহারে কাজ সম্পন্ন করাটাই লক্ষ্যভিসারী।
নিয়ম ১১ : রূপকল্প তৈরি করুণ
আমাদের সবার স্বপ্ন আছে। কিন্তু অনেকে সে স্বপ্নকে রূপকল্পে নামিয়ে আনতে পারে না। স্বপ্ন হচ্ছে ডানা মেলা ইচ্ছে। রূপকল্প তাকে মাটিতে নামিয়ে আনে। স্বপ্ন যখন রূপকল্পে নেমে আসে তখন মিশন, লক্ষ্য এগুলো ঠিক করা যায়। সবচেয়ে বড় কথা তখন জীবনের, কাজের একটা উদ্দেশ্যও পাওয়া যায়।
নিয়ম ১২ : ভয় দেখানো পরামর্শ শোনার দরকার নাই
ভয় মানবিক এবং কখনো কখনো কার্যকরী। এই নিয়মের উদ্দেশ্য হলো যারা বলে – তোমারে দিয়ে হবে না, এই কাজ আগে কেউ পারে নাই ইত্যাদি, তাদের কথা শোনার দরকার নেই। নি:সন্দেহে এরকম কারও কারও কথাতে যুক্তি থাকতে পারে। সেই যুক্তিগুলো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে। কিন্তু ভয়কে প্রাধান্য দেওয়া যাবে না।
নিয়ম ১৩ : আশা ধন্য, কুহকিনী নয়
আশাবাদী হওয়ার মানেই হলো নানা কাজে উৎসাহ, উদ্দীপনা বেড়ে যাওয়া। এই নিয়মের মূল কথা হলো “আমি পারবো” এই বিশ্বাস যথেষ্ট নয়। এই আশাবাদ, বিশ্বাস সবখানে প্রকাশিত হতে হবে। আপনি যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদেরকে আশা দেখান। মনে রাখবেন শুধু কথাতে কিন্তু চিড়ে ভিজবে না। আপনাকে কাজেও সেই আশাবাদ দেখাতে হবে। হাসিও কিন্ত সংক্রামক। নিজেকে এবং আশেপাশের সবাইকে বলতে হবে – হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে।
ইরাক আক্রমনসহ নানা কারণে কলিন পাওয়েল ইতিহাসে খুব একটা সুবিধাজনক জায়গাতে থাকবেন না। কিন্ত মাত্র ১৩টি নিয়মের এই সংকলনের জন্য আবেগীয় বুদ্ধিমানরা তাকে অনেককাল মনে রাখবেন।