ফিজিক্স কেমিস্ট্রি ম্যাথ!!!
দরজা বন্ধ করে বাতি নিভাবো কি নিভাবো না এমনটা ভাবছি। পরে ভাবলাম থাক, একা একা এই বিরানভুমিতে থাকবো, বাতি বরং জ্বলুক। শুয়ে শুয়ে ভাবছি বাদল ভাই-এর কথা। ওনার সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন – ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি. ম্যাথ !
মুসলিম হাই স্কুলে পড়ার সময় কখনো পাস করে কী পড়বো সেটা নিয়ে ভাবি নাই। কেও জানতেও চাইতো না। ভাবতো, ধুর পড়ে তো মুসলিম হাই স্কুলে। কী আর পড়বে। চট্টগ্রাম কলেজে বিএ পড়বে আরকী। ঝামেলাটা পাকায় এসএসসির ফলাফল। আমি ধুম করে স্টারমার্ক পেয়ে যাই। আমাদের সময় কুমিল্লা বোর্ডে প্রথম বিভাগই ছিল তিনশত কতোজন মাত্র। কাজে আমি তাদের একজন এটা তো আমার বাসা এবং পাড়ার লোকেরা বুঝে ফেললো। বাসায় অবশ্য বাবার একটা ইচ্ছে ছিল ছেলে ডাক্তারী পড়ুক। মা কিছু বলতেন না। ওনার কথা ছিল যা পড়বে নিজেই ঠিক করবে। দাদা মাঝে মধ্যে আলাপ করতেন ডাক্তার আর ইঞ্চিনিয়ার নিয়ে। ওনার পাল্লা কোনদিকে তা বোঝা যেত না।
পাড়ার সিনিয়ররও কিন্তু জানতে চাইতেন কী পড়বো। আমি কিছু বলতাম না কারণ কী পড়বো এটা নিয়ে কখনো ভাবা হয়নি।
তো, এসবের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন বাদল ভাই (প্রকৌশলী ড. শহিদুল ইসলাম বাদল, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী)। দেখা হলেই বলতেন – ফিজিক্স. কেমিস্ট্রি ম্যাথ।
মানে হলো বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় এই তিন বিষয় থেকে মাত্র ৬০টা প্রশ্ন থাকে আর ইন্টারে এই তিন বিষয়ের মোট মার্কের ভিত্তিতে প্রথম তিন হাজার জনকে ভর্তি পরিক্ষা দিতে দেওয়া হয়।
বাদল ভাই আমাদের কয়েক ব্যাচ সিনিয়র এবং পরপর দুইবার উনি ১/২ নম্বরের জন্য বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারেননি। পরে চট্টগ্রাম ইঞ্চিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হোন।
তো, তার কথা খুব সিম্পল কিন্তু পাওয়ারফুল। বাংলাদেশে পরীক্ষা একটাই – বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা। সেখানে যদি চান্স পাও তাহলে তোমাকে মেধাবী হিসাবে মেনে নেওয়া হবে। ওনার পড়ালেখার ডেপথও ভাল ছিল। উনি আমাদের সঙ্গে ক্যারমবোর্ড, তাস কিংবা মাঠের ফুটবল, ক্রিকেটও খেলতেন। যাই হোক বাদল ভাই ছিলেন আমাদের বন্ধু, ফিলসফার এবং গাইড। স্কুলে অঙ্ক নিয়ে কোন ঝামেলা হলে তার কাছেই যেতাম।
তো চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হওয়ার পর দেখলাম সবাই প্রাইভেট পড়ে। আমার তো অতো সময় নাই, তাই নিজেই পড়ি। বাদল ভাই বলে দিলেন সারা বছরের জন্য না হোক কিছু সময়ের জন্য প্রাইভেটে পড়ার দরকার আছে। তো, ততোদিনে ক্লাসে আমার সুনাম হয়ে গেছে আমি কেমিস্ট্রির লোক। রসায়ন পড়তে আমার খুব ভাল লাগে। আমি যখন দেখলাম পরমাণুর ইলেকট্রন কাঠামোর সঙ্গে তার রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের সম্পর্ক আছে তখন থেকেই আমি রসায়নের ভক্ত। কলেজে আমাদের রসায়ন পড়াতেন একগাঁদা স্যার। এর মধ্যে চৌধুরী মনজুরুল হক স্যার আমাকে প্রায়শ ব্ল্যাকবোর্ডে নিয়ে যেতেন। কিন্তু আমি ভাবলাম আমি কোন সেট স্যারের কাছে পড়বো না। ভাবলাম পড়বো – পালিত স্যারের কাছে। পালিত স্যার মানে গুরুপদ পালিত। স্যার প্রাইভেট পড়ান না তবে শেষ পর্যন্ত আমরা ৩/৪ জন স্যারকে রাজী করাতে পারলাম। পড়তে হবে ভোর বেলায়, সকাল ৭টা তেকে ৮টা উনি পড়াবেন সপ্তাহে তিন দিন। সযআর সকালে পুজা দেন। তারপর আমাদের ঘন্টাখানেক পড়াবেন। আমার তো কোন চিন্তা নাই, কারণ স্যারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে স্যার সিলেবাস ধরে পড়াবেন না কেবল আমার যেসব জায়গায় সমস্যা সেগুলো পড়াবেন।
তো, আমরা হাজির হতাম খুব ভোর বেলায়। থাকতাম ঘন্টা খানেক। এর মধ্যে স্যারের বাসায় সংবাদ পত্রিকা আমার পড়া হয়ে যেত। সে সময় আমার পরিচয় হয় গাছপাথর তথা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখার সঙ্গে। প্রতি মঙ্গলবার তিনি একটা কলাম লিখতেন। সেটা পড়ে পড়ে আমি মজদুর. মেহনতী মানুষ, সংস্কৃতি, জনমানুষ ইত্যাদি শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করি। বুঝতে পারি এরশাদশাহীর ব্যাপারটা মোটেই সুখকর কোন ব্যাপার না। আমার কারণে পালিত স্যার নানানভাবে কেমিস্ট্রি ব্যাখ্যা করতেন। আমি কোন রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলাফলে খুশী হতাম না। আমি যেহেতু মুখস্ত করতে পারি না, কাজে আমি স্যারকে বলতাম কেন ২ নম্বর বন্ডটা ভাঙ্গবে, ১ নম্বর কী দোষ করছে?
কিছুদিনের মধ্যে স্যারের খুব পছন্দের ছাত্র হয়ে যাই আমি কারণ বাকীরা সবাই নোটের কথা বলতো আর আমি খালি প্যাচাল পাড়তাম! কেমিস্ট্রি ছাড়াও প্রতি মঙ্গরবার অবধারিতভাতে গাছপাথরের কলামের কথা চলে আসতো।
কেমিস্ট্রিতো গেল। ফিজিক্সে আমি নিলাম মোজাম্মেল হক স্যারকে। স্যারও তেমন টিউশনি করেন না। কিন্তু আমি, আবদুল্লাহ হিল বাকীসহ দুই একজন স্যারকে পটালাম এই শর্তে যে, আমাদের নোট লাগবে না। স্যারের বাসায় যেতাম সন্ধ্যা বেলায়। পারসিভাল হরের দুইটা বাসা আমার জন্য নতুন ছিল না কারণ আমি এসএসসির সময় বাংলা ব্যাকরণ পড়াম তাহের স্যারের কাছে।
যাইহোক কেমিস্ট্রি আর ফিজিক্সের হেনস্তা হওয়ার পর আমি আর আলী (প্রফেসর ড. আলি নেওয়াজ) বাদল ভাইকে ধরলাম তার কাছেই আমরা অঙ্কটা পড়বো। উদ্দেশ্য দুইটা – বাসার কাছেই পড়া। কাজে রিক্সাভাড়া সেভ। আর শেষে যখন ওখানে টাকা দিবো তখনতো ইনি আমাদেরকেও খাওয়াবেন!
তো, আগেই বলেছি বাদল ভাই-এর কাছে জীবনের লক্ষ্য ছিল একটা- বুয়েটে ভর্তি হওয়া। কিন্তু তিন হাজারের গ্যাড়াকলে (তখন পদার্থ, রসায়ন আর গণিতের নম্বরের ভিত্তিতে প্রথম তিনহাজার জনকে বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিতে দেওয়া হত) তিনি বুয়েটে পরীক্ষা দিতে পারেননি, পড়েছেন চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। সেই থেকে আমরা যারা তার ছোট তাদেরকে দেখা হলেই তিনি একটি মন্ত্র দিতেন – ফার্স্ট ডিভিশন বা স্টার কিংবা স্ট্যান্ড করাটা কোন কাজের কাজ না, যদি তুমি বুয়েটে ভর্তি হতে না পারো!!! আর বুয়েটে ভর্তি হওয়ার জন্য কেবল দরকার ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি আর ম্যাথ!
বাদল ভাই-এর পাল্লায় পড়ে আমার এমন অবস্থা হল যে, আমি বাংলা আর ইংরেজি পড়া বাদই দিলাম। খালি ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি আর ম্যাথ। এমনকি সাজেশনের তোয়াক্কা না করে বইগুলোর সব কাল কাল অংশ পড়ে ফেলেছি। বাদল ভাই দেখা হলেই স্মরণ করিয়ে দিতেন – আর মাত্র কয়েক মাস।
এর মধ্যে চট্টগ্রাম কলেজ কর্তৃপক্ষ ঠিক করলো তারা ইন্টারে প্রি-টেস্ট চালু করবে। আমাদের তো মাথায় বাজ। আমরা মিছিল করে হাজির হলাম প্রিন্সিপালের রুমে। প্রিন্সিপাল স্যারের নামও মোজাম্মেল হক। তবে কলেজ চালান ভাইস প্রিন্সিপাল শামসুর রহমান স্যার। তো, দুই স্যারের সঙ্গে আমাদের ম্যালা তক্কাতক্কি হলো এবং এক সময় আমি আবিস্কার করলাম – কথাগুলো কেবল আমিই বলছি। অন্যরা চুপ। যা হোক কলেজ কর্তৃপক্ষকে আমরা রাজী করাতে পারলাম না। আমরা পরেরদিনও ক্লাশ করবো না ঠিক করলাম। কলেজ কর্তৃপক্ষ রুটিন দিয়ে দিল। আমরা ঠিক করলাম কলেজের সব গেট বন্ধ করে, দরকার হরে পরীক্ষার দিন বড়ো আওয়াজের ব্যবস্থা করবো।
বড়ো আওয়াজের কথার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম আমি অনেক আওয়াজ শুনছি। সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখলাম কেয়ারটেকার দরজা ধাক্কায়।
[আমার বুয়েট জীবনের খন্ডিত স্মৃতিচারণটা কমপ্লিট করছি। ডিসেম্বরে প্রকাশ হবে। তারই কিছু অংশ যা আগে শেয়ার করিনি তাই ভাবছি মাছে মধ্যে শেয়ার করবো যাতে কোন ভুল ত্রুটি থাকরে কেই সেটা ধরিযে দেবে)। আগের প্রকাশিত অংশের লিংক
One Reply to “ফিজিক্স কেমিস্ট্রি ম্যাথ!!!”
Leave a Reply Cancel reply
You must be logged in to post a comment.
Weired!! But that was awesome one