আমাদের আইসিটি , আমরা কোথায়?
আবার পলিসি লেবেলও কাজ হয়। ১৯৯৮ সালে সরকার জাতীয় টেলিযোগাযোগ নীতিমালা গ্রহণ করে। ফলে, টেলিকম খাত মুক্ত হয় একচেটিয়া বাণিজ্যের কবল থেকে। সেই সময়ে সরকার কালিয়াকৈরে ২৫২ একর জমি অধিগ্রহণ করে একটি হাই-টেক পার্ক বানানোর জন্য। উদ্যোগ নেওয়া হয় একটি আইসিটি নীতিমালা করার এবং টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন করার। জামিল স্যারের একটি অন্যতম সুপারশ ছিল বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলকে একট বিভাগ/মন্ত্রণালয়ের মর্যাদায় উন্নীত করা। এ সবই আমাদের আশাবাদী করে তোলে । কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আজ প্রায় দেড়যুগ পরে হিসাব করতে বসলে দেখা যায় এই খাতে আমাদের অগ্রগতি হলেও সেটি কাঙ্খিত মাত্রায় হয়নি। ফলে, শত কোটি ডলারের ব্যবসাও অধরা রয়ে গেছে।
কাঙ্খিত অগ্রগতি না হওয়া নিয়েও আমরা অনেক আলোচনা-আলাপ, সেমিনার-গোলটেবিল বৈঠক করেছি। তবে, তাতে কাজ হয়েছে এমনটা বলা যাচ্ছে না। মানে তথ্য প্রযুক্তি খাতে আমাদের সেই অর্থে কোন উলম্ফন হয়নি।
একটি দেশের তথ্য প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওযার জন্য দুইটি বিষয় খুব জরুরী। একট হল প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং অপরটি হল প্রশিক্ষিত জণগোষ্ঠি। প্রথমেই অবকাঠামোর কথাই ধরা যাক। বিগত বছর সমূহে আমাদের মোবাইল নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি হয়েছে পুরো দেশ জুড়ে। শুধু যে সারাদেশে এই নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়েছে তা নয়, সেলফোনও পৌছে গেছে সাধারণ মানুষের কাছে। বর্তমানে প্রায় ১১ কোটি লোকের হাতে মোবাইল ফোন আছে।
আমাদের দেশে ইন্টারনেটের বিকাশ অবশ্য মোবাইল ফোনের মত হয়নি। ১৯৯১-৯৬ সরকারের আমলে আমরা তথ্যের মহাসড়কে যুক্ত হওয়ার সুযোগ মিস করি। ফলে, ১৯৯৬-২০০১ আমলে ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও আমাদের দামী রাস্তায় হাটতে হয়েছে। ভিস্যাট উন্মুক্ত হওয়ায় তখন আমরা উপগ্রহ ব্যবস্থার মাধ্যমে ইন্টারনেটে যুক্ত হয়েছি। ফলে, ব্যান্ডউইথের দাম ছিল ভয়াবহ। ইন্টারনেট আর সাধারণ মানুষের কাছে পৌছাতে পারেনি। ২০০১-২০০৬ আমলে আমরা সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে ইন্টারনেটে যুক্ত হই বটে তবে সঠিক নীতিমালা না থাকায় আমরা বেশ কিছু গোলামাল করে ফেলি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কক্সবাজারের পরিবর্তে ঢাকা থেকে ব্যান্ডউইথ বিতরণের সিদ্ধান্ত। ফলে, চট্টগ্রামের ইন্টারনেট হল ঢাকা থেকে নেওয়া যা কিনা কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকায় আসে! দ্বিতীয় হল এটি বিতরণের কোন নিয়মকানুন না বানানো। ফলে, একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যার জন্য বাংলাদেশ তৈরি ছিল না। প্রযুক্তির বিকাশের ফলে সে সময় ডেটা এবং বার্তার মিলন ঘটে। অর্থাৎ ডেটা সার্কিট দিয়েই ভয়েস পাঠানো সম্ভব হয়। যেহেতু কোন নীতিমালা ছিল না, কাজেই অনেকই ডেটা সার্কিট দিয়ে ভয়েস আদান-প্রদান, যা ভয়েস ওভার আইপি নামে পরিচিত, -এর ব্যবসায় নেমে পড়ে যা আইন অনুযায়ী অবৈধ। নতুন এই সিনারিও আমাদের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে পুলিশী সংস্থায় পরিণত করে এবং সংবাদপত্রে আমরা ভিওআইপির সরঞ্জাম জব্দ করার খবর পেতে থাকি। ফলাফল হলো বিটিআরসির যা করার কথা ছিল সবই পিছিয়ে গেল। ২০০৬ সালের ব্রডব্যান্ড নীতিমালায় ডেটা-ভয়েসের একত্রিত করনের কথা থাকরেও ২০০৭-৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এক অভিনব তরিকা আবিস্কার করে যাতে ভয়েস এবং ডেটাকে আলাদা করা যায়। বিশ্বের একমাত্র ও অদ্বীতিয় আইএলডিটিএস নীতিমালা। এই নীতিমালায় নানান মারপ্যাচ করে ভয়েস ও ডেটাকে জোরপূর্বক আলাদা রাখার প্রস্তাব এবং তা কার্যকর করা হয়। ফলে ভিওআইপি ব্যবসার বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। অন্যদিকে তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল, ওয়্যারলেস ব্রডব্যান্ড একসেস এসব নিয়ে যে কাজগুলোর করার কথা সেগুরো পিছিয়ে যায়। সাবমেরিন ক্যাবলের সুবিধাও আমরা নিতে পারলাম না কারণ ব্যান্ডউইথ বিতরনের কোন নীতিমালাও আমরা করলাম না। ফলে, কোন লক্ষ্যও থাকলো না। এডহকইজমই হলো ভরসা। একমাত্র কাজের কাজ যা এই সময়ে হয়েছে তা হল মোবাইল কোম্পানিগুলোকে ভয়েসের পাশাপাশি ইন্টারনেট সেবা বা ডেটা সেবা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া। ফলে, যে সব স্থানে মোবাইল ফোন পৌচেছে সেখানেই ইন্টারনেট সেবা পৌছানো সম্ভব হল। যদিও গতির আলোচনা এখানে স্থানই পেল না।
২০০৯ সালের ডিজিটাল বাংলাদেশের সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশে নতুন করে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এক ধরণের জোয়ার সৃষ্টি হয়। আর তারই কারণে দেশে এখন প্রায় সাড়ে তিনকোটি লোক জীবনে একবার হলেও ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগ পায়। এই সবের মাধ্যমে দেশের ইন্টারনেট ব্যান্ডইউথের সক্ষমতা ২৫০ গিগাবিটের মধ্যে ৪২ গিগাবিট ব্যবহারের যোগ্যতা আমাদের হয়েছে।
তবে, মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাই কিন্তু একমাত্র নিয়ামক নয়।
আমাদের দেশে নতুন মোবাইল ফোন সেটের বাজার মাসে প্রায় ১৮ লক্ষ। কিন্তু এর নগন্য অংশও বাংলাদেশে এসেমব্লি হয না। একইভাবে তিনকোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর জন্য ইন্টারনেটে যথেষ্ট কনটেন্টও আমাদের নেই। ঘুরে ফিরে মনে হতে পারে আমরা নিজেরাই তথ্যপ্রযুক্তির একটি বড় বাজারে পরিণত হয়েছি। অন্যদিকে সক্ষমতার ২০% ব্যান্ডউইথ ব্যবহারের কারণে এখন ব্যান্ডউইথ রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অথচ খোদ রাজধানীসহ সারাদেশেই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের বিশাল চাহিদা রয়েছে। ঢাকার বাইরের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, উদ্যোক্তা, মুক্ত পেশাজীবী (ফ্রিল্যান্সার) এমনকী প্রবাসী সন্তানের মাতা-পিতারাও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের জন্য চাতক পাখির মত অপেক্ষা করছেন। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বড় বড়বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের অবস্থা তথৈবচ।এবং অদূর ভবিষ্যতে দেখানে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযুক্তির কোন দৃশ্যমান উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। যোগানের অভাবে চাহিদাও পূরণ হচ্ছে না। আর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের অভাব থাকায় প্রায় সকলেই উচ্চমূল্যর মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।
২০০৬ সালে এক মেগাবিট ব্যান্ডউইথের দাম ছিল ৮৪ হাজার টাকা। এটি এখন কমে এসেছে মাত্র ২-৩ হাজার টাকায়। কিন্তু, কারো কারো মতো মোবাইল ইন্টারনেটে প্রতি মেগাবিট ব্যান্ডউইথ নাকি ৫০ হাজারের বেশি টাকায় বিক্রি হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ২০০৭ সারে যে প্যাকেজের দাম ছিল ৩০০ টাকা। এখনো সেটা তাই আছে।
কেবল ইন্টারনেট নয়। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ এবং কোন কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষার অবকাঠামো চূড়ান্ত রকমের খারাপ। এখনো অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় ল্যাব নাই। যদিও সেই প্রতিষ্ঠানগুলো তথ্য প্রযুক্তিতে ডিপ্লোমা বা ডিগ্রী প্রদান করে। একজন শিক্ষার্থী আমাকে লিখেছে যে, তারা কাগজে লিখে এবং মুখস্ত করে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিখছে!
এইসব কারণে আইটি ইন্ডান্ট্রির লোকেরা দীর্ঘদিন যাবৎ আইটি শিক্ষার মান সন্তোষজনক নয় বলে অভিযোগ করে যাচ্ছেন। তাদের কনসার্ণ হলো, পাস করা আইটি গ্র্যাজুয়েটদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই বাজারের জন্য উপযোগী নয়। এবং ইন্ডাস্ট্রির সক্ষমতাও এমন নয় যে, এই বিপুল পরিমাণ গ্র্যাজুয়েটদের শিক্ষানবিশীর সুযোগ দিয়ে তাদের গড়ে তুলবেন। দু:খজনক হলেও সত্য যে, এই বাস্তবতা স্বত্তেও দেশে আইটি প্রশিক্ষণের সুযোগ নাই বললেই চলে। এক দশক আগে ভারতীয় এনআইআইটি ও এপটেক দেশের তথ্য প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ বাজারের বারোটা বাজিয়ে চলে গেছে। বলতে গেলে এরপর তথ্য প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ খাতের তেমন কোন অগ্রগতিই হয়নি। ফলে তত্ত্বীয় জ্ঞান নিয়ে এবং কখণো কখনো মুখস্ত করা প্রোগ্রামারদের হাত কলমে দেখিয়ে দেওযার সুযোগ হচ্ছে না। হচ্ছে না তাদেরকে ফিনিশিং স্কুলে পাঠানোর কাজ। মজার ব্যাপার হলো এসবের মধ্যেও অনেক তথ্য প্রযুক্তি প্রথমে কৌতুহলে এবং পরে টাকা কামানোর নেশায় ফ্রিল্যান্সিং-এ ঢুকে পড়ছে। সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে এই আয় ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির এই সুযোগটাও আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। ফলে, দেখা যাচ্ছে যে তরুন ভাল ওয়েব প্রোগ্রামার হতে পারতো সে নিছক ওয়েব ডিজাইনের কিছু মামুলী কাজের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ করে ফেলছে। যার কিনা ঘন্টায় ১০ ডলার কামানোর কথা সে দিনে ৫ ডলার কামিয়ে নিজেকে অত্যন্ত সুখী ভাবছে।
সর্বোপরি, রাজধানীর বাইরে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ শিক্ষকের অভাব প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটসহ বিবিধ সুবিধার অভাবে মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষকরা ঢাকার বাইরে যেত চান না। অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রি নিবিড় যোগাযোগ না থাকায় শিক্ষকরাও ক্রমাগত বাজারের চাহিদা সম্পর্কে ধারণা হারিয়ে ফেলছেন। আমার বিশ্বাস কেবল উন্নত ল্যাব ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের নিশ্চয়তা দিতে পারলে আমরা কিছু হরেও যোগ্য শিক্ষককে ঢাকার বাইরে দেখতে পেতাম।
২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার জন্য আমাদের যে অভিযাত্রা সেটাকে সফল করতে হলে আমাদের নানানমূখী কর্মকাণ্ডে জোর দিতে হবে। তবে, সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত তরুন জনগোষ্ঠী এবং তাদের জন্য নাগালের মধ্যে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড নিশ্চিত করতে পারলেই অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।