হু ইজ মোহাম্মদ মিয়া?

Spread the love

১৯১১-১২ সাল। চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ, ইংরেজি পণ্ডিত। একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ইংরেজি পড়ান। খুবই রাশভারী। কিছুদিন পর একটা পরীক্ষাও হয়ে গেল। পরীক্ষার কয়েকদিন পর অধ্যক্ষ মহাশয় ক্লাসে আসলেন। রাগে গড় গড় করছেন, পারলে সবাইকে বেঞ্চির ওপর দাড় করান। কারণ – কেউ ভাল করে নাই।
এক সময় হুংকার ছাড়লেন – হু ইজ মোহাম্মদ মিয়া?
বেচারা মোহাম্মদ মিয়া বুঝলো তার আজকে দিন শেষ। কী কুক্ষনে যে শহরে পড়তে আসছে। সুলতানপুরে থাকলেই ভাল হতো। নিশ্চয়ই সাহেব তাকে আজকেই কলেজ থেকে বের করে দেবেন। শহরের কলেজিয়েট, মুসলিম হাইসহ সব নামকরা স্কুলের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে তার পড়তে আসা ঠিক হয়নি। বসে তো পেছনের দিকে।
মোহাম্মদ মিয়া কম্পিত হৃদয়ে উঠে দাড়ালেন। এমনিতে ছোট-খাটো। এখন ভয়ে আরো কুকড়ে গেছে। গ্যালারিতে তাকে বোঝা মুশ্কিল। তবুও অধ্যক্ষ তাকে খুঁজে পেলেন।
“কোন স্কুল?”
“রাউজান আর আর স্কুল।” (সেটির নামে তখনো আবদুল বারি চৌধুরী যুক্ত হয় নাই)।
“হোয়াট?” এবার বিস্ময়ের গলা। শহরের সব নামকরা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীকে পেছনে ফেলে ব্রিটিশ ব্যাটার পরীক্ষায় পাস করা একমাত্র শিক্ষার্থীটা কিনা গ্রামের তস্য স্কুল থেকে এসেছে!
অধ্যক্ষ হেটে মোহাম্মদ মিয়ার কাছে আসলেন। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরলেন।
সেই থেকে মোহাম্মদ মিয়া ক্লাসের সামনের সিটে বসেন। গ্রামের একটি ছেলে ইংরেজিতে ভাল এটা লক্ষ করে অধ্যক্ষ তখনই মোহাম্মদ মিয়ার জন্য কিছু একটা ভেবেছিলেন। কাজেই এক বছর পরে যখন ইন্টারমিডিয়েট পাস করে মোহাম্মদ মিয়া অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন তখন অধ্যক্ষ তাকে সরাসরি কোলকাতায় বেঙ্গল মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিলেন। তখন পর্যন্ত পূর্ববাংলার কোন মুসলিম ছেলে বা মেয়ে ঐ কলেজে ভর্তি হয় নাই।
দূরু দুরু বক্ষে মোহাম্মদ মিয়া একদিন হাজির হলেন কোলকাতায় এবং ১৯২৩ সালে সেই সময়কার পূর্ববাংলা মুলুকের প্রথম মুসলিম মেডিকেল এমবি ডাক্তার হিসাবে পাস করে বের হলেন।

সুলতানপুর গ্রামের এই ডাক্তার কিছুদিন কাটালেন রেঙ্গুনে। সেই সময় মহাত্মা গান্ধী একদিন সেখানে গেলেন বক্তব্য দেওয়ার জন্য। বেছে নিলেন বন্দর এলাকা। জনসভা শুরুর আগে দেখা গেল একটি জাহাজের মাস্তুলে ব্রিটিশ পতাকা। একটু ফিসফাস। তারপর দেখা গেল একটা খর্বকায় লোক মাস্তুল বেয়ে ওপরে উঠছে। লক্ষ্য ওই পতাকা নামিয়ে ফেলা। গান্ধীজি যতক্ষণ সেখানে ছিলেন ততক্ষণ ঔ পতাকা আর ওঠে নাই।
১৯২৮ সালে ডা. হাসেম (মোহাম্মদ মিয়া ততদিনে তার পোষাকী নাম মোহাম্মদ এম এ হাসেমে ফিরে এসেছেন) চট্টগ্রাম ফিরলেন। আন্দরকিল্লাহ শাহ জামে মসজিদের সামনে তার চেম্বার। নাম দিলেন – সুলতান মেডিকেল হল। কিছুদিনের মধ্যে সেটার নাম হয়ে গেল -সুলতান মেডিকেল হোটেল!!!
কেন?
কারণ ওখানে কেবল রোগীর ওষুধ জোটে না। ওষুধ দেওয়ার পর ডাক্তার সাহেব জিজ্ঞাষা করেন খাওয়া হয়েছে কি না? না হলে কম্পাউন্ডারকে দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দেন হাতি কোম্পানির কম্পাউন্ডের ভেতর দিকের নিজ বাসায়। সেখানে তার স্ত্রী কুলসুম খাতুন ঐ রোগীকে রেঁধে খাওয়ান।
দলে দলে লোক আসে। কেবল অসুখ নয়। কারো ছেলের স্কুলে ভর্তি, কারো হাসপাতালে। মুশকিল আসানের ডা. হাসেমতো আছেন।
সেরকম একদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের একজন ছাত্র আসে। বেচারা বলতে পারে না – স্টেথো কিনতে পারছে না বলে তার মেডিকেল ভর্তি বাতিল হয়ে যাচ্ছে। শেষে মিনমিন করে বললো। ডাক্তার সাহেব তাঁর গলার স্টেথোটা খুলে এমন একজনের হাতে দিলেন যিনি পরে বাংলাদেশের বিখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ হয়েছেন। চেম্বারে এক লোক জানতে চাইল – স্টেথো যে দিলেন, ওরে চেনেন।
“ওরে চেনার দরকার কি। ওর স্টেথো দরকার। সেটা ও পেয়েছে।”
এসবের ভিড়ের মধ্যে আরো কিছু তরুণ আসে। এদের যে দলনেতা তার নাম সূর্য। সেই ডাক্তার সাহেবকে বলে – তাদের শহরে দেখা, সভার জন্য একটা জায়গা দরকার। ডাক্তার সাহেবের চেম্বারের ভিতরের রুমটা হলে ভাল হয়। তা সই।

ডাক্তার সাহেবকে ঘিরে একটা আড্ডা মত তৈরি হয়। সেই আড্ডাতে এসে যোগ দেন একজন ইঞ্জিনিয়ার, এক জন শিক্ষক। ভাবেন পড়ালেখা না করলে চট্টগ্রামের লোকতো এগোতে পারবে না। ডাক্তারের পরামর্শে ইঞ্জিনিয়ার স্থাপন করেন কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস, শিক্ষক মহোদয় লেখেন ইংরেজি ব্যকরণ ও রচনার বই। সেই রচনার বইতে আমার ভিলেজ রচনায় লেখা হয় সুলতানপুর গ্রামের কথা। শিক্ষকের চেষ্টায় বেড়াতে আসেন কবি নজরুল, রাউজানে হয় অনুশীলন সংঘ।
এদিকে ডাক্তার সাহেব ঘুরে বেড়ান, রোগীর সেবায়। চট্টগ্রামের লোকেরা তখন তাদের নবজাত শিশুর নাম রাখতে শুরু করেন হাসেম। এমন কি গুণমুগ্ধ শিক্ষক তার তৃতীয় সন্তানের নাম রাখেন আবুল হাশেম। প্রকৌশলী হয়ে সেই হাশেম ১৯৯৮ সালে প্রচন্ড খরষ্রোতা বন্যার মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন চালু রাখেন, একদিনের জন্যও সেটি বন্ধ হয়নি। কেমন করে এই অসাধ্য সাধন করলেন? তিনি বলেন – এটাতো সিম্পল ম্যাথ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ডাক্তারের চেষ্টায় গড়ে ওঠে বেবিজ হাসপাতাল, বাদশা মিয়া চৌধুরীরা যুক্ত হয়ে গড়ে ওঠে মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি।
কিন্তু দেশভাগ হয়ে বাংলাদেশ হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তান। শোষন বঞ্চনার নতুন উপাখ্যান। ডাক্তারের মন ভাল থাকে না। এর মধ্যে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে হাজির হয় এক তরুণ। ইসকান্দর মির্জাকে সরিয়ে আয়ুব খান ক্ষমতা দখল করার পরের দিন একটি খোলা জিপে করে ঐ তরুণ আরো কয়েকজনকে নিয়ে হাজির হয় রাজাপুর লেনের ডাক্তার সাহেবের বাড়িতে।
আয়ুব খানকে নিন্দা জানানোর বিবৃতিকে কেউ সই করছে না, ভয়ে। এম এ আজিজের ধারণা ডাক্তার সাহেব যদি করেন তাহলেই বাকীরা করবে। কাগজ নিয়ে ডাক্তার সাহেব বিবৃতির নিচে লিখলেন

১। এম এ হাসেম।

সন্ধ্যার মধ্যে শ’খানেক স্বাক্ষর সংগ্রহ করে এম এ আজিজ ছুটলেন পত্রিকা অফিসে।

আজ ১১ আগস্ট ২০১৪। আমার নানা মানবতার সেবক ডা. এম এ হাসেমের ৪৫ তম মৃত্যুবাষিকী।

নানা,
আমি তোমার অধম নাতি। তোমার ২ শতাংশও গুণও যদি পেতাম, তাহলে আজকে সকালে এই লেখা লেখার সময় আমার চোখ ভিজে ওঠতো না।
ওপারে ভাল থেকো। একদিন তোমার স্বপ্নের স্বাস্থ্যবান শিক্ষিত জাতি আমাদের দেশে হবে। তবে সেজন্য আমাদের আরো অনেক রাস্তা পাড়ি দিতে হবে।
আল্লাহ তোমাকে বেহেস্ত নসীব করুন।

 

3 Replies to “হু ইজ মোহাম্মদ মিয়া?”

  1. আল্লাহ আপনার নানাকে বেহেস্ত নসীব করুন। তাঁর নাতিকেও দেশের মানুষের আরো বেশী সেবা করার তওফিক দিন। আমীন।

Leave a Reply