ভাষার মাস বই-এর মাস ২০২২-২ : একলা মানুষ কবরী
ভাষার মাস বই-এর মাস ২০২২-১ : শর্টকাট প্রোগ্রামিং
আমাদের বাসায় একটা বড়সড় চার ব্যান্ডের রেডিও ছিল। স্বাধীনতার পর আমরা নানা বাড়ির দোতলাতে উঠে আসি। চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায়। নানা বাড়ির দোতলায় দুইটি ফ্ল্যাট। সেটির মধ্যে দক্ষিণ দিকের ফ্ল্যাটের দক্ষিণ দিকের রুমে আমি আর আমার বড় ভাই থাকি। রেডিওটা আমাদের সম্পত্তি। আমরা প্রথমে অভ্যস্ত হই ‘সৈনিক ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান দুর্বার’-এ। এটির সঞ্চালক ছিলেন হাবীবুর রহমান জালাল। এ্টি সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিটে হতো বলে নিয়মিত শোনা হতো।
মুসিলিম হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম এসএসসি পরীক্ষার একমাস বন্ধ পাওয়া গেল। তখন দুপুরে রেডিও শোনা হতো এবং সেই সুবাধে “রেডিও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক কার্যক্রম – বিজ্ঞাপন তরঙ্গ’ অনুষ্ঠানের শ্রোতা হয়ে গেলাম। রেডিও নিয়ে আরও গল্প আছে, সেটা অন্য প্রসঙ্গ।
তো, সেই বানিজ্যিক কার্যক্রমে প্রথমেই মন কাড়লো সিনেমা নিয়ে ১৫ মিনিটের একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। এটি অনেকটা সিনেমার ট্রেলার টাইপের। সঙ্গে থাকতো “মাজহার বা এরকম নামে”র কেউ একজন। যিনি ‘হ্যা, ভাই” বলে অনুষ্ঠানটি শুরু করতেন। তো সেই সুবাধে প্রথম একটি অনুষ্ঠান শুনি ‘গুন্ডা’ নামের একটা সিনেমা নিয়ে। সেই সিনেমার নায়ক নায়করাজ রাজ্জাক আর নায়িকা মিষ্টি মেয়ে কবরী। উপস্থাপক বলতেন কবরী ম্যাডাম। সেই প্রথম চিত্রনায়িকা কবরীর সঙ্গে পরিচয়, মানে তার সিনেমার সঙ্গে।
আন্দরকিল্লায় আমাদের বাসা থেকে মুসলিম হাইস্কুল যেতে সিনেমা প্যালেস, খুরশিদ মহল আর রঙ্গম সিনেমা হল পার হয়ে যেতে হয়। কাজে স্কুল খোলার সঙ্গে সঙ্গে তিন হলের কোনটিতে গুণ্ডা চলছে সেটাও জানা হয়ে গেল। বিশাল পোস্টারে জানা হয়ে গেল কবরী ম্যাডাম কেমন।
বাসায় শুনেছি কবরী চট্টগ্রামের মেয়ে (এটা মনে হয় আমরা গর্বও করতাম)। তারপর শুনেছি ‘জানতাম যদি শুভঙ্করের ফাঁকি’ নামে যে গানটি খুব প্রচলিত সেটা যেই সিনেমার সেটিতেও কবরী ছিলেন। তবে, কবরীকে সিনেমার পর্দায় দেখার জন্য আরও ‘বড়’ হতে হয়েছে। সম্ভবত টেলিভিশনে “সারেং বই’ সিনেমা দেখে তার অভিনয়ের সঙ্গে পরিচয়। ততোদিনে পত্রিকা পড়া – বিচিত্রা, ইত্তেফাক কিংবা পূর্বানী-চিত্রালীর খোঁজ পেয়ে গেছি। কাজে কবরী মোটামুটি মনিকোঠায় ঠাই পেয়ে গেছেন।
তারপর তো তিনি নির্বাচন করলেন, আরও সিনেমা করলেন। প্রথম আলো’র বিভিন্ন আয়োজনে আসতেন। সেখানে কাছে থেকে দেখেছি।
কিন্তু কখনো মনে হয়নি আমাদের হাসিখুশী প্রিয় এ নায়িকা একজন একলা মানুস। কাজে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানে নেওয়া তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাতকার পড়ে প্রথমবার খুবই চমকে যাই। মনে হয় সফল মানুষেরা কেন একলা হবেন!
২০২১ সালে কবরীর ওপারে চলে যাওয়ার পর মতি ভাই কবরীকে নিয়ে একটি স্মৃতিচারণও করেন। সেটাও তখন তখন পড়েছি। আবারও মনে হয়েছে রূপালী পর্দার লোকজন কেমন যেন। ঠিক আমাদের মতো তো তাদের হওয়ার কথা না। কিন্তু তারা তো দেখি আমাদের মতোই। দুর্দান্ত সফল একজনও কেমন একা।
অথচ কবরী বলছেন, “জীবন তো এ রকমই। প্রত্যেকের জীবনেই আলাদা বিষয়বস্তু, দু:খ-কষ্ট আর আলাদা ঘটনা থাকে। আমার জীবনও সেইভাবে গড়ে উঠেছে”।
সাক্ষাতকারে একজন সাধারণ মেয়েকে আপনি খুজে পাবেন যিনি অবলীলায় বলছেন, “ভালো মানুষের সঙ্গে যেমন মিশেছি ; আবার চলার পথে অনেক মন্দ মানুষেরও পরিচয় পেয়েছি।“ যেটি কিনা আমাদের সবার বেলাতেই হয়। বলেছেন , “মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষের জন্য কাজ করে যেতে চাই’।
কবরী কেবল একজন চিত্রনায়িকা ছিলেন না। তিনি রাজনীতি করেছেন, সংসদ সদস্য ছিলেন আবার সামাজিক কাজেও করেছেন। তার বর্ণাঢ্য জীবন। সেই জীবনের নানা ঘাত উপঘাত, সুখ দু:খের কথা তিনি মতিউর রহমানের কাছে তুলে ধরেছেন।
এই সাক্ষাতকারের একটা বড় সৌন্দর্য হলো মতি ভাই-করা প্রশ্নগুলো। কবরীর ভেতরের কথাগুলো বের করে আনার জন্য সেগুলো খুবই থট-প্রভোকেটিভ।
নায়ক রাজের সঙ্গে কবরীর সম্পর্ক নিয়ে আমাদের স্কুল জীবনে নানা মুখরোচক কথা ছিল কিন্তু কবরী জানাচ্ছেন, “রাজ্জাক ছিলেন বিবাহিত। তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের কোন প্রশ্নই আসে না। তিনি আমার সহশিল্পী এবং খুব ভাল একজন বন্ধু”।
কারও কারও কথার সঙ্গে সম্মতি জানিয়ে তিনি বলছেন – আমার ভিতরে কিছু অহংবোধ আছে। এবং বলেছেন যারা তাকে ভালবাসার কথা বলার চেষ্টা করেছেন ‘আমাকে নাকি তারা ভয় পায়’।
আমাদের মিষ্টি মেয়ে শিক্ষক হতে চেয়েছেন কিন্তু হয়েছেন বাংলাদেশের প্রথম সুপারস্টার। তার জীবনের অকপটে বলা সব সত্য ঘটনা কিংবা বলা ভাল সেগুলো নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্লেষনটা বরং অনেক বেশি উঠে এসেছে এই সাক্ষাতকারে।
দেশের প্রথম সুপারস্টার নায়িকা সম্পর্ক জানার জন্য এ্ই বই-এর কোন বিকল্প নেই। কিনতে পারেন প্রথমা থেকে।
একলা মানুষ কবরী
মতিউর রহমান
প্রথমা
শাদা কাগজ, ৬৪ পৃষ্ঠা
মূল্য ১২০ টাকা