কৌন বনেগা ক্রৌড়পতি – মাত্র পাঁচ মাসেই কোটিপতি
ইন্টারনেটে ঘুরতে ঘুরতে কয়েক বছর আগে আমি প্রথম আলেক্স টিউ এবং তাঁর গল্প জানতে পারি। ২০০৫ সালে ২১ বছর বয়সে আলেক্স এমন একটি কাজ করে যা তাকে কেবল মিলিওনিয়ার বানায়নি, একইসঙ্গে জায়গা করে দিয়েছে ইন্টারনেটের ইতিহাসেও। আলেক্সের উদ্যোগের বিশাল উইকিপিডিয়া পেজও আছে। ২০১৭ সালে আমার উদ্ভাবনের কলকব্জা সিরিজে তাঁর এই উদ্যোগ নিয়ে লিখেছি। স্টোরিটেলিং নিয়ে গবেষণার অংশ হিসেবে সম্প্রতি আমি আবার তার গল্পটা রি-ভিজিট করেছি। প্রথমে ছোট গল্পটা বলে নেওয়া যাক।
২০০৫ সালের আগস্ট মাসে আলেক্স টিউ এই ধারণা নিয়ে মাঠে নামে। এর কিছুদিন পরে তার ইউনিভার্সিটি অব নটিংহামে তিন বছর মেয়াদী বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কোর্সে ভর্তি হওয়ার কথা। তার চিন্তা হলো পাশ করতে করতে তার অনেক টাকা স্টুডেন্ট লোন হয়ে যাবে। কাজে সে একটা ভিন্ন চিন্তা করে। সে চেয়েছে এমনভাবে টাকাটা যোগাড় করতে সেটা যেন দীর্ঘমেয়াদী কোন ঋণ না হয়। আলেক্সের বাস ইংলন্ডে। এবং সালটা ২০০৫ সাল। তার মানে ফেসবুক তখনও আতুর ঘরে।
তার ‘সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস’ ধারণাটা সহজ। এতই সহজ যে আপনার মনে হতে পারে – আরে? এটা তো আমিও করতে পারতাম।
তো, ধারণাটা কী? আলেক্স milliondollarhomepage.com নামে একটা ওয়েবসাইট বানালো। এতে ১০ লক্ষ (১ মিলিয়ন) পিক্সেল আছে (১০০০ বাই ১০০০)। সে প্রতিটি পিক্সেল ১ ডলারে বিক্রি করবে ঠিক করে। ন্যূনতম ১০ বাই ১০ বা ১০০ পিক্সেলের একটি ব্লকে লোগো বসানো যায়। কাজে ১০০ ডলার দিলে আপনি ১০০ পিক্সেল কিনতে পারেন। এবং সেই ব্লকে আপনার ওয়েবসাইটকে লিংক করতে পারেন। খুব সহজ একটা বিজ্ঞাপনী সাইট। ওর হিসাব হলো এতে তার এক মিলিয়ন ডলার আয় হবে!
আলোক্স ৫০ ডলার (এখনকার হিসাবে ৪,২৫০ টাকা) খরচ করে ডোমেইন আর হোস্টিং কিনলো এবং ২ দিন খেটে ওয়েবসাইটটি তৈরি করলো।
কিন্তু কেমন করে পিক্সেল বিক্রি করবে?
কে তার এই ওয়াইল্ড আইডিয়া গ্রহণ করবে? ফেসবুক নাই যে সে একটা পো্স্ট দিবে আর মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়বে। অবশ্য তার কাছে বুস্ট করার টাকাও ছিল না।
এসব ক্ষেত্রে নবীন উদ্যোক্তারা যা করে আলেক্সও তাই করেছে। ও প্রথম তার বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয় স্বজনকে এপ্রোচ করে। সহজ হিসাব – আমার এই আইডিয়াতে তুমি যদি সাহায্য করো তাহলে আমি বিজ্ঞাপনের জন্য কিছু ফান্ড যোগাড় করতে পারি। আর সে কারও কাছে বেশি টাকা চায়নি – মাত্র ১০০ ডলার! এভাবে দুই সপ্তাহে সে ৪৭০০ ডলার যোগাড় করতে সক্ষম হলো।
মাত্র ৪৭০০ ডলার দিয়ে কী বা মার্কেটিং করা যাবে?
কোন পত্রিকা বা টিভিতে বিজ্ঞাপন দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আলেক্স বুঝেছে তার এই আইডিয়াটা একটি ইউনিক আইডিয়া এবং এজন্য মিডিয়া তার ব্যাপারে আগ্রহী হতে পারে। কাজে সে একটি পিআর কোম্পানি হায়ার করলো। ওরাই তার হয়ে তার আইডিয়ার কথা লিখে-লিখে লন্ডনের সব মিডিয়াতে পাঠিয়ে দিল। সেই পিআর নজরে পড়লো বিবিসি এবং গার্ডিয়ানের। তারা নিউজ করলো। ব্যাস, নিউজের সঙ্গে সঙ্গে তিন হাজার পিক্সেল বিক্রি।
আগেই বলেছি, সেই সময় ফেসবুক বা টিকটক নাই। কিন্তু গার্ডিয়ান আর বিবিসি থেকে ব্লগার আর তখনকার স্যোসাল মিডিয়া সেটা পিক করলো। ফলাফল?
দুই মাসের মধ্যে আলেক্স অর্ধেক পিক্সেল বিক্রি করে ফেললো। ওয়েবসাইট মেইনটেইন করার জন্য দুইজন ইঞ্জিনিয়ার আর মুখপাত্র হিসাবে একজন মিডিয়ার লোককে নিয়োগ দিল। আলোক্স শুধু খেয়াল রাখলো কোন পর্ন কোম্পানি যেন বিজ্ঞাপন দিতে না পারে।
শুরু করার ১৩৮ দিন পর, ৩১ ডিসেম্বর ৯ লক্ষ ৯৯ হাজারে পৌছে যায় সে। বাকী ১০০০ পিক্সেল বিক্রির জন্য আলেক্স ই-বেতে নিলামের ব্যবস্থা করে। ১১ দিন পর MillionDollarWeightLoss.com ঐ ১০০০ পিক্সেল কিনে নেয় ৩৮ হাজার ডলারে। তার মানে আলেক্সের মোট বিক্রি হলো ১,০৩৭,০০০ ডলার (১০ লক্ষ ৩৭ হাজার ডলার)। এখনকার বাজার মূল্যে এটি মাত্র সাড়ে আট কোটি টাকা!!!
গল্প শেষ। সিম্পল আইডিয়া, দুর্দান্ত এক্সিকিউশন এবং দারুন সমাপ্তি।
আলেক্সের এই সাফল্যের কারণ কী?
বলাবাহুল্য, প্রথম কৃতিত্বটা দিতে হবে তার আইডিয়াকে। কারণ এরকম ইউনিক আইডিয়া তার আগে কেউ আনতে পারেনি। ওয়েবসাইটের নাম ও ট্যাগলাইন – ইন্টারনেট ইতিহাসের এক অংশের মালিক হোন (Own a Piece of Internet History) –ও অনেক দৃষ্ট নন্দন। কিন্তু, এরকম অনেক আইডিয়া মাঠে মারা গেছে এবং প্রতিদিন যাচ্ছে। তাহলে আলেক্স কেন সফল হলো?
শুরুতে সে একটি ওয়েবসাইট বানিয়েছে যেটি দারুণভাবে কাজ করে। ম্যানেজমেন্টও সহজ করে। মাত্র এক পাতার ওয়েবসাইট হলেও সেটা বানাতে সে দুইদিন-রাত খেটেছে।
আলেক্স জানতো তার এই আইডিয়া দ্রুত ক্যাশ করতে হবে। কারণ জানাজানি হলে অনেক জায়ান্ট কোম্পানি দ্রুত কপি করে ফেলবে আইডিয়া। কাজে তার একটা বড় বাজ দরকার। এবং সেটা দিতে পারে মিডিয়া। কিন্তু আলেক্স প্রথমেই মিডিয়াতে যায়নি। ধার দেনা করে যেতে পারতো। কিন্তু যায়নি। ও ভেবেছে যদি শুরুতেই মিডিয়া কাভারেজ পায় তাহলে সবাই সাইটে এসে দেখবে সেটা খালি । ওর প্রুফ দরকার। কাজে ওর দরকার সাইটের একটা অংশ ভরা।
সেটা কার কাছে বেচা যায়?
এমন লোকের কাছে যারা ওকে চিনে এবং এমনিতেই হয়তো ওকে ১০০ ডলার দিতে পারে। আলেক্স তাই তার বন্ধু, আত্মীয় স্বজনের কাছে গেছে। এবং ৪৭০০ পিক্সেল তাদেরকাছে বেচেছে। এই বেচার সময় কিন্তু সে তাদেরকে ফান্ডরাইজিং-এর কথাই বলেছে। বলেছে কিছু টাকা আর বিক্রি দেখাতে পারলে ও আরও বিক্রি করতে পারবে। এক মিলিয়ন পিক্সেল বেচাটা তার স্বপ্ন। যারা কিনেছে তারা তার স্বপ্নের পাশে দাড়িয়েছে।
এরকম একটা উদাহরণ আমাদের দেশেও আছে। খুলনাতে তিন বন্ধু মিলে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, ২০০৭-২০০৮ সালে। শুরুতে তাদের দরকার ছিল এক লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। এই টাকা তারা ৮০ জন বন্ধু বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে নিয়েছে। মাথাপিছু ২০০০ টাকা। বেশি নেয়নি। বলেছে – এই টাকা দিয়ে তারা তাদের প্রতিষ্ঠান চালু করবে। সবাই খুশি মনে দিয়েছে।
অন্যদিকে ৪৭০০ ডলার পাওয়ার পর আলেক্স তার মার্কেটিং প্ল্যান করেছে। এবং এখানে সে প্রচলিত ভুল করে নাই। প্রথম সে মিডিয়াতে আসতে চেয়েছে এবং সেজন্য তার পরিচিত মিডিয়া লোকদের কোন তালিকা করে নাই। সেই হেটে একটি পিআর কোম্পানির কাছে গেছে এবং টাকা দিয়ে তাদের হায়ার করেছে। যদি সে নিজে নিজে মিডিয়ার দ্বরে দ্বারে ঘুরতো তাহলে সে কখনো বিবিসি আর গার্ডিয়ানের দৃষ্টি আকর্ষন করতে পারতো না। পিআর কোম্পানি জানে কীভাবে মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষন করতে হয়। বিবিসি আর গার্ডিয়ানের কারণে পরেরটুকু ইতিহাস। উইকিপিয়া জানাচ্ছে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে মিলিয়ন ডলার হোমপেজের ৪০% লিংক আর কাজ করে না।
মাত্র ৫০ ডলার খরচ করে বিশ্বের ইতিহাসে মাত্র পাঁচ মাসে মিলিওনিয়ার হওয়ার গল্প খুব একটা আছে বলে আমার জানা নেই।
আলেক্সের গল্প থেকে আমাদের কেউ কেউ কিছু একটা শিখতে পারবে। তবে বেশিরভাগই এই লেখা পড়ে বলবে – এই গল্প আমরা আগেই জানি। এ আর এমন কী! বাংলাদেশে তো আর এটা সম্ভব না!!!
One Reply to “কৌন বনেগা ক্রৌড়পতি – মাত্র পাঁচ মাসেই কোটিপতি”
Leave a Reply Cancel reply
You must be logged in to post a comment.
দারুণ! দারুণ!!