মেঘনাদ সাহা : জ্যোতি:পদার্থবিজ্ঞানের জনক

Spread the love

বঙ্গভঙ্গ মানি না, বাতিল কর!

২০ এর দশকে মেঘনাদ সাহা

সকাল থেকে স্কুলে সাজ সাজ রব। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে আজ আসবেন পূর্ব বাংলার গভর্নর স্যার বাম্পফিল্ড ফুলার। স্কুলকে সাজানোও হয়েছে।স্কুলের সিনিয়র ক্লাসের কয়েকজন ছাত্র ঠিক করল, এই সুযোগটা তারা কাজে লাগাবে অন্য বিষয়ে। মাত্র কিছুদিন আগে ভারতের বড়লাট লর্ড কার্জন বাংলাকে ভেঙে দুই টুকরা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অর্থাৎ বাংলা পূর্ব ও পশ্চিম এই দুইভাগে ভাগ হবে ( এই ঘটনা ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত)। তার এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি বাংলার অভিজাত কিংবা সাধারণ জনগোষ্ঠী। বঙ্গভঙ্গ বাতিল করার জন্য বাংলার নানা স্থানে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ আয়োজন করা হচ্ছে।

কলেজিয়েট স্কুলের ওই ছাত্ররাও ঠিক করেছে ফুলার সাহেবের সামনে ‘বঙ্গভঙ্গ মানি না’ স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করবে। যে কথা সে কাজ। ঘোড়ায় টানা গাড়ি থেকে নেমে ফুলার সাহেব স্কুলে ঢোকার আগেই ছাত্রদের মিছিলে পড়লেন। ‘বঙ্গভঙ্গ মানি না, বঙ্গভঙ্গ বাতিল করো’ স্লোগান জোরদার হওয়ার আগেই শিক্ষক ও গভর্নরের নিরাপত্তা বাহিনীর কারণে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিল।

তবে ঐ মিছিলের পরিণতি কী হতে পারে, তা আঁচ করতে পারেনি ছাত্ররা। পারেনি মিছিলের সবচেয়ে বয়ঃকনিষ্ঠ ছাত্রটিও। মাত্র কিছুদিন আগে সরকারি জলপানি, বড় ভাইয়ের মাসিক পাঁচ টাকা আর বৈস্য সমিতির মাসিক দুইটাকা বৃত্তি সম্বল করে সেওড়াতলী থেকে ঢাকায় পড়তে এসেছে সে। কাজে পরদিন স্কুলের হেডমাস্টারের তলব এবং স্কুল থেকে বহিষ্কারের চিঠি পেয়ে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। শুধু বহিষ্কার নয়, সেই সঙ্গে বাতিল করা হয়েছে তার সরকারি বৃত্তিও।

কিশোরীলাল জুবিলি স্কুল এখন কে এল জুবিলি স্কুল

মনের দুঃখে গ্রামে ফিরে গিয়ে বাবার মুদির দোকানেই কাজে লেগে যাবে, এমনটা ভাবতে শুরু করল হালকা-পাতলা গড়নের ছেলেটি। টাকার অভাবে পায়ের স্যান্ডেল কেনা হয়নি বলে কয়েক দিন খালি পায়ে স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। এরই মধ্যে কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্রদের বীরত্বের কথা চাউর হয়েছে এলাকাজুড়ে। পাশের নর্থব্রুক স্ট্রিটের স্কুল কিশোরীলাল জুবিলি হাইস্কুল। সেই স্কুলের একজন শিক্ষক একদিন খালি পায়ের ছেলেটিকে নিয়ে এলেন নিজেদের স্কুলে। বলিয়াদির জমিদার প্রতিষ্ঠিত কিশোরীলাল স্কুলটি চলে পরিত্যক্ত নীলকুঠি ভবনে। স্কুল কর্তৃপক্ষ বিনা বেতনে ভর্তি করল ওই ছেলেটিকে। হেডমাস্টার এমনকী বৃত্তিরও ব্যবস্থা করলেন।

সেই সময় দশম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে হতো। ১৯০৯ সালের পরীক্ষায় ফলাফলে তাক লাগিয়ে দিল খালি পায়ের সেই ছেলেটি। সমগ্র পূর্ববাংলা থেকে তার অবস্থান তৃতীয়। সে বছর ম্যাট্রিকুলেশনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রথম স্থান অধিকার করেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু (পরে বিজ্ঞানী ও বোসন কণার জনক)। দুই বছর পরে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসিতে পুরো বাংলায় দ্বিতীয় স্থান দখল করে সেওড়াতলীর সেই ছেলেটি প্রমাণ করল, একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় থাকলে দুনিয়াতে কিছুই অসম্ভব নয়।

সেওড়াতলীর এই ছেলেটিকেই এখন বলা হয় জ্যোতি:পদার্থবিজ্ঞানের (Astrophysics) জনক। ১৯৩৫ ও ১৯৩৬ সালে পর পর দুবার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম প্রস্তাব হলেও তিনি অবশ্য নোবেল পুরস্কার পাননি। যদিও এখন বিজ্ঞানীরা স্বীকার করেন তাঁর কাজ নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মতই। নোবেল পুরস্কার না পেলেও ঐ বিজ্ঞানী কিন্তু অমর হয়ে থাকবেন বিজ্ঞানের ইতিহাসে, স্বনামে। কারণ যে সমীকরণ দিয়ে নক্ষত্রের বর্ণালী ব্যাখ্যা করা হয় সেটির নাম ‘সাহা সমীকরণ’। আর সেওড়াতলীর ও ছেলেটির নাম মেঘনাদ সাহা।

পড়ার জন্য সব কাজ

বংশাই নদীর পাড়ের গ্রাম সেওড়াতলী। গ্রামের ছোট্ট মুদির দোকান চালিয়ে সংসার চালান জগন্নাথ সাহা। ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর জগন্নাথ সাহার স্ত্রী ভুবনেশ্বরী দেবীর কোল আলো করে জন্ম নেন মেঘনাদ সাহা। টানাটানির সংসারে মেঘনাদ পঞ্চম সন্তান। গ্রামের টোলে মেঘনাদের পড়ালেখার সূচনা। এই গ্রামে তৃতীয় শ্রেণির ওপরে পড়ার মতো কোনো স্কুল নেই। কিন্তু মেঘনাদের ইতিহাস আর গণিতের সাফল্যে তাঁর শিক্ষকরা তাকে একটি ইংরেজি স্কুলে পাঠাোনর জন্য সুপারিশ করেন। সেরকম কাছের মিডল স্কুল (ব্রিটিশ আমলে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি পড়ার স্কুল) হলো ১০ মাইল দূরে সিমুলিয়া গ্রামে। টোলে মেঘনাদ ছাত্র ভালো হলেও সিমুলিয়ায় কোথাও রেখে ছেলেকে বিদ্যার্জনে সহায়তা করার সামর্থ্য জগন্নাথ সাহার ছিল না। আবার মেঘনাদের বড় ভাই জয়নাথের ম্যাট্রিকুলেশনে উত্তীর্ণ হতে না পারায় অভিজ্ঞতাও ওই পরিবারের আছে। তার পরও জয়নাথ খুঁজে পেলেন সিমুলিয়া গ্রামের চিকিত্সক অচিঅনন্ত কুমার দাসকে। অনন্ত বাবু নিজ বাড়িতে মেঘনাদকে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে রাজি হলেন। শর্ত ছিল, মেঘনাদকে তার থালা-বাসন নিজেই ধুতে হবে এবং সময় পেলে বাড়ির গরুগুলোকে দেখভাল করতে হবে।

সে সময়ে শেওড়াতলী আর সিমুলিয়ার গ্রামবাসীর প্রতি রোববার একটি দৃশ্য দেখতেন। সকালে গরুদের যত্ন নিয়ে মেঘনাদ রওনা হয়েছে বাড়ির উদ্দেশে, হেঁটে হেঁটে। আবার সন্ধ্যায় হেঁটে হেঁটে মেঘনাদ ফিরতেন সিমুলিয়ায়। এসবের মধ্যেও মেঘনাদ তাঁর শিক্ষাকে এগিয়ে নেন। কাজেই প্রাথমিক পরীক্ষায় সিমুলিয়া স্কুলের মেঘনাদ তত্কালীন ঢাকা জেলার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পেয়ে যান মাসিক চার টাকার সরকারি বৃত্তি। এর সঙ্গে পাটকলের কর্মী জয়নাথের পাঠানো পাঁচ টাকা সম্বল করে একদিন সকালে নৌকা করে মেঘনাদ আসলেন ঢাকা শহরে। সদরঘাট থেকে সরকারি কলেজিয়েট স্কুল খুব দূরে নয়। ভর্তি হতে কোন সমস্যা হলো না। কয়েকদিনের মধ্যে পেয়ে গেলেন বাংলা বৈষ্য সমিতির মাসিক দুই টাকা বৃত্তি। একুনে মাসিক ১১ টাকা। কাজে শুরু হলো ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে মেঘনাদের পড়াশোনা। পরের ঘটনা তো আমরা আগেই পড়েছি।

বঙ্গভঙ্গ বাতিল

১৯১১ সালেই ব্রিটিশরা বঙ্গভঙ্গ বাতিল করে দুই বাংলাকে আবার এক করতে বাধ্য হল। কাজে হৃষ্টচিত্তেই মেঘনাদ গেলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখানে তাঁর সতীর্থ সত্যেন্দ্রনাথ বসু। এক বছরের সিনিয়র প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। আর শিক্ষকদের মধ্যে আছেন জগদীশ চন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রমূখ। গণিতে সম্মানসহ সাহা বিএসসি করলেন ১৯১৩ সালে আর ফলিত গণিতে মাস্টার্স হলো ১৯১৫ সালে। দুটো পরীক্ষাতে তিনি সত্যেন বসুর এক ধাপ পেছনে থেকে দ্বিতীয় হয়েছেন।

এর মধ্যে ম্যার আশুতোষ চালু করেছেন বিজ্ঞান কলেজ। বসু ও সাহা দুজনেই বিজ্ঞান কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন গণিত বিভাগে। পরে দুজনই চলে যান পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে, যেখানে তাঁদের পরপরই চন্দ্রশেখর ভেস্কটরামন (পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার ১৯৩০) যোগ দেন পালিত অধ্যাপক হিসেবে।

কলেজে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে শুরু করেন সাহা। বিষয়, হাইড্রোস্ট্যাটিকস, বর্ণালিবিদ্যা ও তাপগতিবিদ্যা। নিজের স্নাতকোত্তর ক্লাসে সাহার বিষয়বস্তু ছিল গণিত। কাজে মাস্টার্স ক্লাসে পদার্থবিজ্ঞান পড়ানোর জন্য নিজেরই অনেক পড়াশোনা করতে হচ্ছিল সাহাকে। তবে, কাজটি খুব আনন্দের সঙ্গে করতে থাকলেন।

সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রথম অনুবাদ

ছাত্র পড়ানোর পাশাপাশি গবেষণাও শুরু করেন তিনি। সে সময় বিজ্ঞান কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে গবেষণাগারে উচ্চতর গবেষণার কোনো উপকরণই ছিল না।  ‘ল্যাবরেটরি’ বলত প্রেসিডেন্সি কলেজের সমৃদ্ধ লাইব্রেরি! বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই সাহা জার্মান ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। কাজে, লাইব্রেরির জার্মান জার্নালগুলোও তিনি পড়তে শুরু করেন। আলবার্ট আইনস্টাইন সে সময়ে তাঁর আপেক্ষিতার সাধারণ তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন। সব নিবন্ধ জার্মান ভাষায়। সত্যেন বসু ও মেঘনাদ সাহা মিলে জার্মান ভাষায় লেখা আইনস্টাইনের বিভিন্ন নিবন্ধ ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন এবং বই আকারে প্রকাশ করেন। এটিই আইনস্টাইনের জার্মান নিবন্ধের প্রথম ইংরেজি অনুবাদ। ঐ বই-এর একটি জেরক্স কপি এখন রয়েছে আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনস্টাইন আর্কাইভে রয়েছে।

নিজে নিজে ডক্টরেট

ঐ সময় মেঘনাদ সাহার বেশ কিছু গবেষণা নিবন্ধ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হয়। তাঁর এরকম নিবন্ধ ও গবেষণা ফলাফলগুলো একত্রিত করে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টর অব সায়েন্স (ডিএসসি) ডিগ্রির জন্য আবেদন করেন! সে সময় এখনকার মত আনুষ্ঠানিক ডিএসসি গবেসণা ছিল না। তাঁর সকল গবেষণা বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে ১৯১৯ সালে ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে।

সাহা সমীকরণ

গবেষণাগারে

সেই সময় জার্মান ভাষায় প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক জার্নালে ‘নক্ষত্রের বর্ণালিবিদ্যা’র একটি নিবন্ধের প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। সূর্যের বর্নালী বিশ্লেষন করলে সেখানে কতগুলি রেখা দেখা যায়। এই রেখাগুলোর উৎস তখনও কেও বের করতে পারেননি। সময় পেলে মেঘনাদ ঐ বিষয় নিয়ে ভাবতেন। ঐ নিবন্ধটি লিখেছেন বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী ওয়াল্টার নার্নস্টের এক ছাত্র। নক্ষত্রের বাতাবরণে উচ্চ তাপমাত্রায় গ্যাসের অণুর আয়নিত হওয়া ছিল সেই নিবন্ধের বিষয়। কিন্তু, আয়নায়নের জন্য নার্নস্টের ছাত্রের ব্যবহূত বিভব নিয়ে মেঘনাদের খুবই সমস্যা হচ্ছিল। এমনকি ওই নিবন্ধে বিভবটি কোথা থেকে এসেছে, তা-ও সুস্পষ্ট করা হয়নি। তখন তিনি অনেক গবেষণা করে শেষ পর্যন্ত ওই বিভব নির্ণয়ের সূত্রটি বের করেন। ১৯১৯ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ বিষয়ে চারটি নিবন্ধ লেখেন। কিন্তু লেখা ছাপানোর মত টাকা তাঁর কাছে ছিল না। পরে এই নিবন্ধ চারটি ১৯২০ সালে ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাতটি হলো ‘আয়োনাইজেশন অব সোলার ক্রোমোস্ফিয়ার’। এই নিবন্ধে তিনি প্রথম তাঁর সূত্রটি ব্যবহার করেন, যা এখন ‘সাহা সমীকরণ’ নামে পরিচিত। এই সমীকরণ ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো সূর্যের বর্ণমণ্ডলে ফ্রনহোফার রেখাগুলোর উত্পত্তি ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হোন। সাহার এই সমীকরণটি নক্ষত্রজগতের নানা কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণে প্রায় সবাই ব্যবহার করতে শুরু করেন। বিখ্যাত জ্যোতিবিজ্ঞানী স্যার আর্থার এডিংটন তাঁর একটি লেখায় সাহার এই সমীকরণকে জ্যোতিবিজ্ঞানের শীর্ষ ১২তম আবিষ্কার হিসেবে স্বীকৃতি দেন। পরবর্তী প্রায় দুই দশক ধরে সাহার এই সমীকরণটি কোন না কোনভাবে জ্যোতি:পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণায় ব্যবহৃত হয়েছে। বলতে গেলে ঐ সমীকরণকে কেন্দ্র করেই ক্রমান্বয়ে গড়ে উঠেছে জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানের ভূবন। এ জন্য অনেক বিজ্ঞানীই মেঘনাদ সাহাকে জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানের জনক (Father of Astrophysics) হিসাবে বর্ননা করেন। ১৯২০ সালেই গবেষণার জন্য কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রিফিত পুরস্কার লাভ করেন।

বিজ্ঞানীদের সংগঠন

বাংলার বিজ্ঞানীরা – বাঁ থেকে বসা – মেঘনাদ সাহা, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু, জ্ঞান চন্দ্র ঘোষ (রসায়নবিদ)। বাঁ থেকে দাড়ানো – স্নেহময় দত্ত (পদার্ধবিজ্ঞানী), সত্যেন্দ্র নাথ বসু, দেবেন্দ্র মোহন বসু (পদার্থবিজ্ঞানী), নিখিল রঞ্জন সেন (পদার্থবিজ্ঞানী), জ্ঞানেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায় (পদার্থবিজ্ঞানী), নগেন্দ্র চন্দ্র নাথ (রসায়নবিদ)

১৯১৯ সালেই মেঘনাদ সাহা প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন, যা তাঁকে ইংল্যান্ড ও জার্মানিতে গবেষণা করার সুযোগ দেয়। তিনি প্রথমে পাঁচ মাস লন্ডনে বিজ্ঞানী আলফ্রেড ফাউলারের ল্যাবরেটরিতে এবং পরে বার্লিনে ওয়াস্টার নার্নস্টের সঙ্গে কাজ করেন। ১৯২১ সালে দেশে ফিরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহা যোগ দেন খয়রা অধ্যাপক হিসেবে। কিন্তু ১৯২৩ সালে তিনি চলে যান এলাহাবাদে। কারণ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য কোন বরাদ্দ সে সময় ছিল না। এলাহাবাদে তিনি ছিলেন ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত। এ সময় তিনি কেবল তাঁর বিভাগটিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করেননি, পাশাপাশি তিনি উপমহাদেশে বিজ্ঞানীদের প্ল্যাটফরমগুলোও তৈরি করেন। ১৯২৭ সালে তিনি ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন।

সাহা উপলব্ধি করেন বিজ্ঞান গবেষণার মানোন্নয়ন এবং বিজ্ঞানকে আরো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য দরকার বিজ্ঞানীদের সংগঠন। তখন পর্যন্ত ভারতে বিজ্ঞান সংগঠন বলতে  সোসাইটি ফর দি কালটিভেশন অব সায়েন্স, ইন্ডিয়া। তবে, সেই অর্থে সেটি কেবল বিজ্ঞানীদের সংগঠন নয়। ১৯৩১ সালে এলাহাবাদে তিনি শুরু করেন উত্তর প্রদেশ একাডেমি অব সায়েন্স। পরের বছরই এটি ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স, ইন্ডিয়া নামে কাজ শুরু করে। সাহা হন সেটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৩৩ সালে কোলকাতায় তাঁর হাতে সূচিত হয় ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি, ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানীদের সংগঠন। এই সংগঠন থেকে প্রকাশিত হয় ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স। এই জার্নালে নিয়মিত লিখতে শুরু করেন চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরামন, সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ। সাহার উদ্যোগেই যাত্রা করে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স (আইআইএস)। যার সাফল্য স্বাধীনতার পর ভারতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সৃষ্টি করে।

পাশাপাশি সোসাইটি ফর দি কালটিভশন অব সায়েন্স-এর সঙ্গেও সাহার সম্পৃক্তি ছিল। উনি এই সমিতির সভাপতি ছিলেন ১৯৪৬-৫০ মেয়াদে। ১৯৫০ সালেই সাহা প্রতিষ্ঠা করেন ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স যা এখন সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ায় ফিজিক্স নামে বিখ্যাত।

সংসদ সদস্য মেঘনাদ সাহা

সংসদ সদস্য হিসাবে শপথ গ্রহণ

কেবল গবেষণা এবং শিক্ষা প্রসার নয়। মেঘনাদ সাহা মনে করতেন বিজ্ঞানীদের বেশি বেশি করে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণীর সঙ্গেও যুক্ত থাকা প্রয়োজন। তার এ কারণে তিনি শেষজীবনে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এলাহাবাদে থাকার সময় থেকে তিনি পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুকে বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ দিতেন। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় স্বাধীনতার পর তিনি রাস্ট্রীয় নীতি নির্ধারনীতে আরো বেশি সময় দেওয়ার জন্য মনস্থির করেন। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৫২ সালে ভারতীয় লোকসভার নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন এবং উত্তর-পশ্চিম কোলকাতা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মেঘনাদ সাহা মনে করতেন বড় আকারের শিল্প কারখানা তৈরি করতে না পারলে ভারতের উন্নতি হবে না। আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন না হলে ভারত ব্যর্থ হবে। ভারতের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতির জন্য তাঁর নিজের অনেক পরিকল্পনা ছিল। কিন্ত মাত্র ৫৯ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনের একটি সভায় যাওয়ার সময় হৃদাঘাতে এই বরেণ্য বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়।

আশ্চর্য ব্যাপার হল কিশোরীলাল জুবিলি (এখন কে এল জুবিলি) হাই স্কুলে একটি বিজ্ঞানাগারের নাম ভিন্ন ঢাকার এই বিজ্ঞানীকে স্মরণ রাখার কোন বন্দোবস্ত আমরা করি নাই। কিন্তু, যে ফুলারের বিরুদ্ধে শ্লোগানের কারণে মেঘনাদের বৃত্তি বাতিল হয়েছিল তার নামে ঠিকই একটি রাস্তা রয়েছে এই ঢাকা শহরে। কী আশ্চর্য!

 

Leave a Reply Cancel reply

Exit mobile version