মাঠে মাঠে ধানের বদলে যাওয়ার কাব্য
আমরা তখন বুঝলাম কমলাপুর থেকে আমাদের সঙ্গে একই কেবিনে যিনি চুপচাপ বসে ছিলেন এবং আমাদের হট্টগোল দেখছিলেন তিনি আর কেও নন, জিনবিজ্ঞানি আবেদ চৌধুরী! আমি অবশ্য এর মধ্যে তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে বসে আছি। (আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডের ৫ স্বপ্নের মধ্যে একটি হল ২০৩০ সালের মধ্যে পদার্থ, রসায়ন এ জীববিজ্ঞানের কোন একটিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া। এ জন্য সম্ভাব্য অনেকের একটি তালিকা আমার কাছে আছে। ড. আবেদ চৌধুরীর নাম আমার সে তালিকার সামনের দিকেই ছিল।)
তারপর থেকে দেশে আসলেই আবেদ স্যারের সঙ্গে আমার দেখা সাক্ষাৎ আর কথাবার্তা হতো। শুরু হলো তাকে দেশ ফিরিয়ে আনার আমার এডভোকেসী। যদিও এখন মনে হয় আমাকে খুব বেশি কিছু করতে হয়নি। উনি নিজেই ফিরে এসেছেন।
স্যারের কাছে আমার প্রথম ধানকে ভালবাসা শুরু। হাজার জাতের ধানের গরবিনী বাংলা কীভাবে তাঁর ঐতিহ্য খুয়ে ফেলছে। আবেদ স্যারের কাছেই জনলাম খাসালত ধান নিয়ে যখন ম্যানিলায় আন্তর্জাতিক ধান কংগ্রেসে আলাপ হয় তখন আমাদের বিরির মহাপরিচালক খালি বাইরে চলে যান, কংগ্রেসে থাকবেন কী! ইন্ডিকো আর জাপানিকোর পর খাসালত যে আর একটি আলাদা প্রজাতি এটার পক্ষে লড়তে হয় আবেদ স্যারকে।
স্যারের ভাবনার একটি অংশের সঙ্গে আমার একটি ভাবনা খুবই মিলে যায়। কাজে শুরু হয় আমাদেনর একসঙ্গে পথচলা। এবং আমরা বাংলাদেশে বিজ্ঞান গবেষণার একটি নতুন উদাহণ সৃষ্টি করি হরি ধানের বিশ্লেষন করার কাজে। কাজটি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জেবা ইসলাম সেরাজের নেতৃত্বে একদল তরুন বিজ্ঞানী, সেই ধানের নমুনা যোগাড় করেছে গণিত অলিম্পিয়াডের স্বেচ্ছাসেবকরা, আর পুরো ব্যাপারটাতে যুক্ত থাকেন ড. আবেদ চৌধুরী। (হরি আর স্বর্না ধানের নমুনা দুইটিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর সময় নাম দেওয়া হয় রাউজান১ আর রাউজান-২ কারণ রাউজান আমার গ্রামের বাড়ি (স্বজনপ্রীতি আর কি)।
এর মধ্যে দেশে ফেরার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় স্যারের। একদিন দেখা করতে যান কৃষি সচিবের সঙ্গে। সাড়ে তিনঘন্টা বসিয়ে রেখে দেখা না করে স্যারকে ফিরিয়ে দেন মহাশক্তিধর কৃষি সচিব শওকত আলী (ইদানিং কৃষি কৃষক নিয়ে অনেক জ্ঞান দেন!)। অথচ মরিশাস, তানজানিয়া বা সিঙ্গাপুরে, যেখানে আবেদ চৌধুরী কাজ করেন সেখানকার প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে তিনি অবলীলায় দেখা করতে পারেন, চা.কফি খেতে পারেন!
২০০৮ সালে তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টার সচিবের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেন। ৪০ মিনিটের আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা তাঁকে বলেন অস্ট্রেলিয়ার শান্তিময় নিশ্চিত জীবন ছেড়ে তাঁর এই অনিশ্চিত জীবনে আসার দরকার কী!!!
দেশে এসে গবেষণা করতে হলে টাকা দরকার। সরকার দেবে না। তাহলে?
কিছু ধনী ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা করলেন। সবাই প্রথমে রাজি হলেন কিন্তু যখন কাগজ পত্র করার সময় আসলো তখন দেখা গেল নানান বাহানা। এই হবে এই হবে না। ফলে সেখানেও তেমন অগ্রগতি নেই।
ঠিক করলেন যা করবেন নিজেই করবেন।
কাজের ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নিলেন নিজের গ্রাম।
মৌলভীবাজার জেলার কানিহাটি পরগনার (অধুনা শমশেরনগর ইউনিয়ন) হাজিপুর গ্রাম। সেখানে তিনি শুরু করলেন তার কাজ। তা কী কাজ?
বীজের ব্যাপারেও আমরা আগালামনা। ষাটের দশকে বিআরআরআই ব্রিডিং এ চমৎকার সাফল্য দেখালো। কিন্তু মাঠের ব্রিডিং ছাড়িয়ে ধান ঢুকে পড়েছে ডিএনএ, হাইব্রিডের জড়তে। আমাদের বিরি সেদিকে গেল না। আমরা চীন থেকে নিয়ে আসলাম ঝলক ধান!!! হায়রে হাইব্রিড। (প্রথম আলোর বিজ্ঞান প্রজন্ম পাতায় আমরা একবার লিখলাম – হাইব্রিড বনাম ব্রি ধান, ব্রি ধানই চ্যাম্পিয়ন)। কিন্তু বীজ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কে পারবে। তৃতীয় শ্রেণীর পচা বীজ আনলে শুধু কৃষকের এককালীন ক্ষতি হয় না, কৃষক ক্রমাগত বীজশূন্যও হয়ে পড়ে।
এই নিয়ে ভাবেন আবেদ চৌধুরী।
ছোটবেলায় আমরা পড়েছি একবার ফসল হলে যে উদ্ভিদের মৃত্যু হয় তার নাম ঔষধী। ধান হল তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ধানগাছে একবারই ফসল হয়।
কিন্তু আমাদের দেশে এমন ধান ছিল যা কিনা একবার লাগালে তিনবার ফসল দিতো। সেই ধানের পাত্তা লাগান তিনি। কীভাবে সেটা আবার ফিরে পাওয়া যায় সেটিও বের করে ফেলেন। হাজিপুর গ্রামে গেল বছর গিয়ে দেখে এসেছি এই ধান!!! ফিরে এসে প্রথম আলোতে লিখেছিলাম “মাঠে মাঠে ধানের বদলে যাওয়ার কাব্য” ।
প্রথমবার ফসল হওয়ার পর ৫০ দিন পর দ্বিতীয় বার ৫০% আর পরে আবার ৫০%। পানি ইত্যাদি দেওয়ার কায়দা আছে। কিন্তু সেটি সম্ভব। গেল বছরের মাঠ পরীক্ষার পর এবছর আবার সে পরীক্ষা করা হলো। পাওয়া গেল উদ্দিষ্ট ফলাফল! এখন এটিকে নিতে হবে আরো কৃষকের কাছে।
কৃষকের কাছে এই বিজ্ঞানটা পৌছাতে হলে তাকে যুক্ত করতে হবে আন্তর্জাতিক জ্ঞানের সঙ্গে। ইংরেজী আর ইন্টারনেট তাই আবেদ চৌধুরীর বাকী দুই কাজের অংশ। এরই মধ্যে নিজের এলাকার স্কুলগুলোতে ইংরেজির মান কীভাবে বাড়ানো যায়, নিয়মিত ইংরেজি অলিম্পিয়াড করা যায় কী না, শিক্ষকদের জন্য কী করা যায় তা ভাবছেন তিনি।
গ্রামের এক পাশে একটি পরিত্যক্ত চালকলে চালু করেছেন ইন্টারনেট সেন্টার । সেখানে এখন মেয়েরা ছেলেদের থেকে বেশি আসে কম্পিউটার আর ইন্টারনেট শিখতে। সেখানে একটি লাইব্রেরিও গড়ে তোলা হয়েছে।
[ধানের মানুষ, গানের মানুষ কবি দেলওয়ারের গানের একটি কলি। এই শিরোনামে কয়েকবছর আগে একটি লেখা লিখেছিলাম প্রথম আলোতে। আজকে সেটার লিংকটা পেলাম না। এই পোস্টের সঙ্গে সেটিও খুব দরকারী]
হাজিপুর গ্রামের আবেদ চৌধুরীদের ধানের মাঠগুলো এখন হয়ে উঠেছে পরীক্ষাগার। সেখানে নতুন জাতের ধান সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সফলও হচ্ছেন। [ সরাসরি তাঁর নিজের আপডেট পাওয়া যাবে এখানে]
গ্রামের তরুনদের কর্মসংস্থানের জন্য সেই ইন্টারনেটের কথা ভাবছেন। ফ্রিল্যান্সিং-এর মাধ্যমে এর হয়তো কিছুটা সমাধান হতে পারে। সেজন্য বাপ্পীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। আলামিন চৌধুরী বিডিওএসএনের মাধ্যমে এসসিওর যে কোর্স করাচ্ছেন সেটি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ভিন্ন মানুষ হয়ে এখন কানিহাটি ফিরেছে বাপ্পী। এর মধ্যে কয়েকটি বিডও সফলভাবে করতে সক্ষম হয়েছ!!! বাপ্পীর মতো আরো কয়েকজন হলে আমরা শমশের নগরে/কানিহাটিকে ফ্রিল্যান্সিং-এর একটি কর্মশালা করে ফেলবো।
তবে, যতো কাজকর্মের পরিকল্পনা করেছেন সেগুলো করতে হলে আবেদ চৌধুরীর অনেক টাকা দরকার। সরকার বা বড়লোকেরা সেখানে কিছু করবে বলে মনে হচ্ছে না। আমরা ভাবছি আমরা “বিন্দু বিন্দু জলে সাগর গড়ে তোলার” একটা আনন্দময় উদ্যোগ নেবো। আমরা ১০ হাজার জন পাগল যোগাড় করবো যারা আমাদের ১০ হাজার টাকা করে দেবেন। সেই টাকা দিয়ে অনায়াসে করে ফেলা যাবে এমন কিছু কাজ যা হাজিপুর গ্রামের মাঠে মাঠে ধানের বদলে যাওয়াকে আমাদের সব মাঠের বদলের গানে পরিণত করতে সহায়তা করবে।
আমি জানি আবেদ চৌধুরী তাঁর স্বপ্নগুলো একদিন পূরণ করতে পারবেন। সেটি ত্বরান্বিত হবে যদি আমরা সকলে তার পাশে দাড়াই।
সবার সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক।
One Reply to “মাঠে মাঠে ধানের বদলে যাওয়ার কাব্য”
Leave a Reply Cancel reply
You must be logged in to post a comment.
This inredoucts a pleasingly rational point of view.