‘মেইলা-মেইলি নয়. মেশামেশি করুন’
“এই যে সারাদিন ইন্টারনেটে থাকো। একটু ঘুরতেও যেতে পারো। ক’দিন আগেই আমি এক চমৎকার ইকো রিসোর্ট থেকে বেড়িয়ে এসেছি”।
“আচ্ছা। ঐ রিসোর্টের লিংক দেন। একটু ভিজিট করে আসি।”
আমি যখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাই – দিনে কয় ঘন্টা তারা ফেসবুকে কাটায়? এক ঘন্টা, দুই ঘন্টা এভাবে জিজ্ঞাষা করার এক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী জানালো – আমরা স্যার কখনো লগ-আউটই করি না। আমাদের ফোনে সারাক্ষণই ফেসবুক ও মেসেঞ্জার লগ-ইন করা থাকে।!!!
পড়ানোর সুবাধে আমি দেখেছি একদল শিক্ষার্থী এখন আর খাতা কলম নিয়ে ক্যাম্পাসে আসে না। ওদের ভরসা এখন শিক্ষকের দেওয়া পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের কপি (কাগজের কপি নয়, কম্পিউটার ফাইল)। যে সমন্ত শিক্ষক পাওয়ার পয়েন্টের পরিবর্তে বোর্ডে লেখেন, তাদের বোর্ডের ছবি তুলে নেওয়া হয়, মোবাইল ফোনে।
কারণ খুবই সহজ – ও যখন ক্লাসে থাকে তখন ওর অন্য কেন বন্ধু হয়তো কোথাও খেতে গিয়েছে। সেখানে গিয়ে ‘চেক-ইন’ দিয়েছে, ছবি দিয়েছে কিংবা কোন মেসেজ দিয়েছে। ওর তখন ‘দায়িত্ব’ হয়ে পড়েছে সেখানে লাইক, কমেন্ট করা বা মেসেজের জবাব দেওয়া। ফলে, ক্লাসে মনোযোগ দেওয়াটা ওর জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। একই কথা প্রযোজ্য হয় এসাইনমেন্ট, হোমওয়ার্কের বেলায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, দলের একজন কাজটা করে বাকীরা কপি-পেস্ট করে চালিয়ে দেয়। কারণ তাদের অনেক ব্যস্ততা। ফেসবুকে লাইক দিতে হয়, কমেন্ট করতে হয়, চেক-ইন দিতে হয়, বন্ধুর কোন কিছু শেয়ার দিতে হয়।
আবার এখন বিশ্বকাপ ফুটবল হচ্ছে। আগে কেবল খেলা চলাকালীন সময়েই খেলার বিষয়টা থাকতো। বড়জোর নিজস্ব পরিমন্ডলে। কিন্তু এখন বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার সমর্থককে পর্তুগাল প্রবাসী ব্রাজিল সমর্থকের সমালোচনার জবাব দিতে হয়। সেজন্য পড়ালেখা করতে হচ্ছে, খেলার বিভিন্ন অংশ ইউটিউবে গিয়ে বারবার দেখতে হচ্ছে!!! এভাবে তার সময়ের একটা বড় অংশ নিজের অজান্তেই এসবেই চলে যায়। ফলে, এমনকী খাওয়ার টেবিলেও বাবা-মার সঙ্গে কথা বলার সময়ও অনেকেরই হয় না।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের এ পড়ুয়ারা মিলেনিয়াম প্রজন্ম বা ওয়াই প্রজন্মের (যাদের জন্ম ১৯৮১-২০০৫ সালের মধ্যে) শেষ দিককার সদস্য। ওদের বেড়ে ওঠার একটা বড় সময় জুড়ে তারা ইন্টারনেটের বিকাশ আর তার প্রত্যক্ষ সুফল আর কুফল দেখছে। ফলে, তারা যন্ত্র ব্যবহারের চেয়ে যন্ত্রের দাস হযে পড়ছে বেশিমাত্রায়।
এই প্রজন্মের শুরুর দিকের প্রতিনিধিরা এখন বাবা-মা হতে শুরু করেছেন। তাদের সন্তান-সন্ততি হলো ‘ডিজিটাল নেটিভ’ । এরা ডিজিটাল খায়, ডিজিটাল পড়ে আর ডিজিটাল খেলেই জীবন কাটাবে। আর এদের বাবা-মারা ডিজিটালের প্রেমে পড়েছে তাদের তারুণ্যে। ফলাফল কেমন হচ্ছে?
যে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে আমি মিলেনিয়াম বাবা-মা ও তাদের ডিজিটাল ছেলে-মেয়েদের লক্ষ করি। এই ঈদে দেখলাম যখনই কোন ছোট বাচ্চা কান্নাকাটি করে তখনই তার বাবা বা মা তাকে একটা স্মার্টফোন ধরিয়ে কোথাও বসিয়ে দিচ্ছে। মিলেনিয়াম বাচ্চাদের টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন চিত্র দেখিয়ে খাওয়ানোর যে ভুল রীতিটি আমরা সামলাতে পারি নাই সেটি এখন আরও বিকশিত হয়েছে। শুধু পর্দা হয়ে গেছে ছোট আর টিভি চ্যানেলের জায়গা দখল করেছে ইউটিউবের চ্যানেল।
কাজটা কী ভাল হচ্ছে? আমার জন্য এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া কঠিন। কারণ আমি সমাজবিজ্ঞানী নই। কাজের কারণে আমি এমনকি নিজেও প্রচুর সময় ইন্টারনেট আর ফেসবুকে কাটাই। তবে, আমি লক্ষ করছি যে সিলিকন ভ্যালি, যেখানে এই নতুন প্রযুক্তির বিকাশ হচ্ছে, সেখানকার বাবা-মা’রা কেমন।
বিপদজনক কেন বলছি? কারণ আমেরকিার গবেষকরা বলছেন অষ্টম শ্রেণীর যে সব শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোরাফেরা করে তাদের মধ্যে হতাশার হার অন্যান্যদের চেয়ে ২৭% বেশি। দিনে তিন ঘন্টার বেশি স্মার্টফোন ব্যহারকারী কিশোরদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেড়ে গেছে অনেকখানি! এখনকার বাবা-মারা বাড়িতে ফিরে মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারে ব্যস্ত হয়ে যান। নিজেদের সময় নিরঙ্কুশ করতে তারা সন্তানদের ব্যস্ত রাখেন ইলেকট্রনিক গ্যাজেট দিয়ে। অথচ শিশুর বিকাশ নিয়ে কাজ করেন এমন বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে বাসায় বেশি হইচই হয় সেখানেই তিন বছরের কম বয়সীরা সবচেয়ে বেশি শব্দ শেখে!
আমেরিকার মতো দেশে এখনও ছেলে-মেয়েদের গড় বয়স কমপক্ষে ১০ বছর না হলে তাদেরকে ফোন দেওয়া হয় না। ক্লিমেন্ট ও মাইলস তাদের বই-এ সিলিকন ভ্যালির বেশ কয়েকটি স্কুলের কথা বলেছেন। এমন একটা স্কুলের নাম ওয়ালড্রফ স্কুল (Waldrof school)। সেখানে এখনও শিক্ষকরা ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লিখেন এবং শিক্ষার্থীরা ২নম্বর(2B) পেনসিল ব্যবহার করে। তাদের শিক্ষার বড় অংশ জুড়ে থাকে পরস্পরকে শ্রদ্ধা ও সহযোগিতা শেখানোর পদ্ধতি।
প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হবে সর্বত্র, কারণ সেটাই সত্য এবং সেটাই বাস্তব। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে তা যেন আমাদের মৌলিক গুণাবলী ও বেড়ে ওঠার সৌন্দর্য, আনন্দ কিংবা ভালবাসাকে দখল করে না ফেলে। ফেসবুক, ই-মেইল এখন জীবনের অংশ। ব্যক্তি ও কর্মজীবনে এদেরকে অস্বীকার করা যাবে না। কিন্ত, তার ব্যবহারের বাড়াবাড়ি কাম্য নয়।
আমাদের সহকর্মী লাজ্জাদ এনাম মসিহ, প্রায়শ সবাইকে এ কথাটি মনে করিয়ে দেন। তার উক্তিটিই আমার আজকের লেখার শিরোনাম। যন্ত্রের ওপর মানুষের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য এ যুগে এর চেয়ে ভাল কোন হিতোপদেশ আমার জানা নেই।
[দৈনিক প্রথম আলোতে ৪ জুলাই ২০১৮ প্রকাশিত]
2 Replies to “‘মেইলা-মেইলি নয়. মেশামেশি করুন’”
Leave a Reply Cancel reply
You must be logged in to post a comment.
অনেক ভাল লাগল পড়ে । ধন্যবাদ স্যার
অনেক কিছু জানা হলো,স্যার।