কুমির, কুমির তোমার জলে নেমেছি
“এতো যে উপদেশ দাও, নিজে কেমন ছাত্র ছিলা”।
সুবিন –“আমি খুবই ভাল ছাত্র ছিলাম। আমি যে কোন বিষয়ে রচনা লিখতে পারতাম।”
আমি ভাবলাম তাহলে ওকে একটা কঠিন বিষয়ে রচনা বলতে বলি। আমি ওকে বললাম পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে রচনা বলতে।
সুবিন- কোন পলাশীর যুদ্ধ? আশির দশকের বুয়েটের হলে যে পলাশীর যুদ্ধ হয় সেটা?
আমি দেখলাম কমন পড়ে গেছে। তাই তাড়াতাড়ি বললাম- না, না, বুয়েটের পলাশী হবে কেন। এটা পলাশীর প্রান্তর যেখানে নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ হয়েছে।
সুবিন- ও আচ্চা। বাচ্চারা, তোমরা জানো পলাশীর প্রান্তরে বেশি সৈন্য নিয়েও নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ইংরেজদের কাছে হেরে যান কারণ তিনি তার সেনাপতি হিসাবে মীরজাফরকে নিয়োগ দেন। মীরজাফর আলী খানকে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে তিনি আসলে খাল কেটে কুমির নিয়ে আসেন। আর কুমির একটা হিংস্র প্রাণী। এর আছে ধারালো দাঁত, বড় বড় চোখ আর ইয়া লম্বা একটা লেজ। আর সেই লেজ হলো খাঁজকাটা, খাঁজকাটা, খাঁজকাটা…
১০ নভেম্বর বইটি প্রকাশিত হয়েছে। সেদিনই আমার যাওয়ার কথা ছিল মোড়ক উন্মোচনে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি। ১২ নভেম্বর ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টার্টআপ ফেয়ারে বই-এর প্রকাশক স্বরে অ প্রকাশনীর রাজু আমাকে বইটি উপহার দেয়। তারপর থেকে বই ব্যাগে নিয়ে ঘুরেছি যাতে মোশতাক ভাই-এর সঙ্গে দেখা হলে অটোগ্রাফ নেওয়া যায়। সেই সুযোগও পেয়ে গেছি ১৪ নভেম্বর। সেদিন ঐ ড্যাফোডিলে গ্রোথ হ্যাকিং মার্কেটিং নিয়ে একটা মাস্টার ক্লাসে আমি, মোশতাক আহমেদ ও কাজী এম মুর্শেদ ছিলাম। সেদিনই অটোগ্রাফ নিয়েছি। একটা ছোট্ট ইন্টারভিউও নিয়েছি।
আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা তাদের গল্প লেখে না। হয়তো এ কারণে আমাদের উদ্যোগী তরুণেরা বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গের মধ্যে নিজেদের অনুপ্রেরণা খোঁজে। অথচ আমাদের সকল উদ্যোক্তার গল্পই এক একটি অনুপ্রেরণার গল্প। অসম্ভব সাহসের নাম।
মোশতাক আহমেদ কুমির চাষীর ডায়েরিতে তার কুমির চাষের শুরু থেকে প্রথম বাণিজ্যক কুমির রপ্তানি পর্যন্ত খুঁটিনাটি তুলে ধরেছেন। খুবই ডিটেইলে লিখেছেন। জানতে চেয়েছিলাম কেমন করে সম্ভব হয়েছে – “শুরু থেকে সব লিখে রেখেছি। নোট রেখেছি। এবং কাগজ সংরক্ষণ করেছি”।
পড়ার সময় আমার বার বার শরবতে বাজিমাতের কথা মনে পড়েছে। ইংলন্ডের তিন উদ্যোক্তা যেভাবে পদে পদে ঠেকেঠেকে শিখেছেন, আমাদের ‘কুমির ভাই’-ও সেরকম পদে পদে ঠেকেছেন. ঠকেছেন এবং শিখেছেন। তার ভাষায় “যেহেতু আমি এই ক্ষেত্রে নতুন, তাই আমাকে হাইকোর্ট দেখানো সহজ ছিল”।
এটি আমাদের সব উদ্যোক্তারই গল্প। কারণ এদেশের ব্যাংকগুলো, “ক্যাননট ফাইন্যান্স এ ক্রোকোডাইল ফার্ম উইথ এ চিকেন হার্ট”। সে সময়
কুমির খামার বাংলাদেশে কেন, দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নতুন ঘটনা ছিল। বইটি পড়লে বোঝা যায়, এ জন্য মোশতাক আহমদকে কতো পড়াশোনা করতে হয়ছে। এ যেন সারাক্ষণই ‘পড়ো পড়ো পড়ো” আর “জানো জানো জানো”।
কারিগরী জ্ঞান, নেটওয়ার্কিং আর অর্থায়ন। ব্যাংকের দোরে দোরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক একটা সাপোর্ট তিনি পান সাউথ ইস্ট ব্যাংক থেকে। যদিও প্রথম কর্মচারীদের বেতন দিয়েছেন বাবার কাছ থেকে টাকা ধার করে। তারপর জানতে পারেন ইইএফের কথা। এসইডিএফ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ইইএফের জনয্প্রস্তাব তৈরি করে অর্থায়ন যোগার করেছেন।
কেমন কষ্ট করেছন?
“দুই বছরে সব মিলিয়ে বত্রিশটি টেবিল ঘুরে ২০০৪ সালের ৫ মে আমরা মন্ত্রণালয় থেকে বাণিজ্যিক খামার করার অনুমতি পাই”। সে সময়ে লিটারেলি তার জুতার তলা ফুটো হয়েছে। ঐ জুতা জোড়াটি আমরা দেশের প্রথম উদ্যোক্তা মিউজিয়ামে রাখবো।
কুমিরের খামার একটা দেখার জায়গা। সেটা থেকেও যে আয় করা যায় সে গল্প অবশ্য মোশতাক ভাই বই-এ বলেননি। ১৪ তারিখের অনুষ্ঠানে বলেছেন। তবে, এরাকাবাসীর ঝামেলা ছাড়াও বড়ো হয়ে দেখা দেয় ফরেস্ট গার্ডদের অত্যাচার। শেষ পর্যন্ত “বাবারও বাবা আছে “ থিউরি দিয়ে সে সমস্যার সমাধান করার কথা লিখেছেন আমাদের কুমির ভাই।
বইটিতে দুইটি অংশ। একটি অংশ মোশতাক আহমেদ ও তার রেপটাইল ফার্মের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশের গল্প। অন্য অংশে মোশতাক আহমেদ লিখেছেন কীভাবে কুমির চাষী হয়ে ওঠা যায় তার বিস্তারিত।
লেখনী ও ডেটার কারণে এই বইটি সকল উদ্যোক্তা ও উদ্যোক্তা হতে চাওয়াদের অবশ্য পাঠ্য।
মোশতাক আহমদে তার উদ্যোকআ জীবনের গল্পকরার সময় নতুনদের জন্য পরামর্শও দিযে গেছেন নিরন্তর। ফলে, এটি কেবল একটি এডভেঞ্চারের গল্প হয়ে উঠেনি পাশাপাশি হয়ে উঠেছে উদ্যোক্তাদের জন্য একটি গাইড লাইনও।
পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে, আমাদের ব উদ্যোক্তার গল্পই আসলে খাঁজকাটা কুমিরের গল্প। কারণ প্রশাসন, ব্যাংক-বীমা সবাই তাদেরকে কেবল খাঁজকাটা কুমিরের গল্প শুনিয়ে হয়রানি করতে থাকে।
মোশতাক আহমেদ ও তার কুমির চাষির ডায়েরির জন্য অনেক ভালবাসা।