গার্লফ্রেন্ডের পরামর্শে ২ বছরেই বিলিয়ন ডলার কোম্পানি
১৯৮৩ সালে চট্টগ্রাম শহরে আমার দিনকাল কেটেছে। চট্টগ্রাম কলেজে পড়ি। কলেজের করিডরে মিছিল করি, গুরুপদ পালিত স্যারের বাসায় সকালে কেমেস্ট্রি আর মোজাম্মেল হক স্যারের বাসায় রাতে ফিজিক্স পড়ি। আর প্যারেড গ্রাউন্ডে বসে রাজা-উজির মারি। ঠিক ঐ সময়ে আমেরিকার ম্যাসাচুসেট অঙ্গরাজ্যের হলিস্টন শহরে বাস করেন জিপকারের মার্কেটার ডায়ানা ও তার পতি টিজেএক্স কোম্পানির এইচআরের ভাইস প্রেসিডেন্ট ডগলাস সিসট্রম। জায়া ও পতির কথা লিখেছি মানে হলো তাদের ছেলে-মেয়ের কথা এসে পড়বে। ঠিক তাই।, এই দম্পতির ছেলে কেভিন সিসট্রমের জন্ম সেই ১৯৮৩ সালে। স্কুলে পড়ার সময়েই কেভিনের কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এ হাতেখড়ি হয়। তারপর স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স এণ্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিগ্রী ২০০৬ সালে। এবং সঙ্গে সঙ্গে গুগলে চাকরি, প্রোডাক্ট মার্কেটার হিসাবে। প্রায় তিন বছর পরে কেভিন ভাবলো তার প্রমোশন হবে এসোসিয়েট হিসেবে কিন্তু সেটা হলো না। হতাশ আর মনের দু:খে চাকরি ছেড়ে কেভিন চলে গেল নেকস্টস্টপ নামে একটা স্টার্টআপে। এটি হলো একটি লোকেশন সুপারিশের এপ। সে সময় অবশ্য ফোর-স্কোয়ারের উদ্যম অনেক। কেভিনের ধারণা ছিল ছোট টিমে অনেক রেসপন্সিবিলি আর কাজের সুযোগ পাওয়া যাবে। হলোও তাই। এক বছরে নিজের প্রোগ্রামিং আর স্টার্টআপ স্কিল শানিত করে কেভিন ভাবলো নিজেই একটা স্টার্টআপ দেবে, ‘চেক-ইন এপ’।“আমার তেমন কোন বিশেষ আইডিয়া ছিল না। মানে, আমরা জাস্ট একটি চেক-ইন এপ বানাবো ভেবেছি।” ওর ভাবনা ছিল চেক-ইন এপের সঙ্গে স্যোসাল গেমের সমন্বয় করা। একটা প্রোটোটাইপ বানিয়ে তার আইডিয়ার কথা সে পিচ করে দুইটি ভেঞ্চার ক্যাপিটালে। ওরা আগ্রহ দেখায়। কেভিন চাকরি ছেড়ে দেয়। মাইক ক্রেইজারের সঙ্গে মিলি Burbn বানাতে শুরু করে। দুই সপ্তাহের মধ্যে ওরা পাঁচ লাখ ডলার সীড মানি পেয়ে যায়। তাদের এই চেক-ইন এপ যা যা করব যেতো – লোকেশন জানান দেওয়া (চেক-ইন), ভবিষ্যতে কই থাকবো সেটা জানান দেওয়া (ফিউচার চেক-ইন), বন্ধুদের সঙ্গে হ্যাংআউটে গিয়ে পয়েন্ট লাভ করা, ছবি পোস্ট করতে পারাসহ ম্যালা কিছু। কেভিন ও মাইকের স্থির বিশ্বাস লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়বে। কাজে প্রায় ৬০ হাজার ডলার খরচ করে তারা Burbn লঞ্চ করলো। তারপর থেকে প্রতিদিন গুণতে শুরু করলো কতোজন সাইনআপ করে!
কী মনে হয়? নয় মাস পরে তাদের গ্রাহক সংখ্যা কতো হবে?
- ১ লক্ষ? ১ মিলিয়ন?
না। এতো কম নয়। ৯ মাসে তাদের গ্রাহক হলো মাত্র ৮০ জন। জি। মাত্র ৮০ জন। এর বেশিরভাগই কেভিন আর মাইকের বন্ধু। যারা কিনা না করতে পারে না। ওদের গার্ল ফ্রেন্ডরাও ছিল।
শান্তির জন্য কেভিন মেক্সিকোর একটি হোস্টেলে ছুটি কাটাতে যাওয়ার কথা ভাবলো এবং নিজের আর গার্লফ্রেন্ডের জন্য ২টা টিকেট কাটলো। টপটক অনুষ্ঠানে আমি আমার অতিথিদের কাছে জানতে চাই – আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ কোনটি? এই প্রশ্ন যদি আমি কেভিনকে করি তাহলে সে জবাব দিবে – গার্ল ফ্রেন্ডের জন্য কেনা ঐ টিকেটটা!!!
মেক্সিকোতে কেভিন তার গার্লফ্রেন্ডের কাছে জানতে চাইলো – আচ্ছা, তুমি কেন Burbn এ ছবি পোস্ট করছো না? জবাবে বান্ধবীর সরল জবাব – আমার আইফোন-৪ এ তোলা ছবিগুলো বন্ধুদের মতো সুন্দর নয়। বন্ধুরা ফিল্টার ব্যবহার করছে। তুমিও হয়তো ফিল্টার ব্যবহার করতে পারো।
“সেদিন বাইরে থেকে হোস্টেলে ফেরার পর আমি সরাসরি আমার ল্যাপটপে ঝাপিয়ে পড়লাম এবং আমি আমাদের প্রথম ফিল্টার X-ProII তৈরি করলাম”।
মেক্সিকো থেকে ফেরার পর মাইকের সঙ্গে আলাপ করে তারা ঠিক করলো – তাদের এপে হাজার হাজার অপশন থাকার দরকার নাই। একটিই যথেষ্ঠ। কাজে তারা Burbn থেকে ফটো শেয়ারিং অপশন রেখে বাকি সব কিছু ফেলে দিল।
একমাসের মধ্যে ওদের ব্যবহারকারীর সংখ্যা হয় ১০ লক্ষ, এক বছরেই ১ কোটি। ২০১২ সালের এপ্রিলে ফেসবুক ইনস্টাগ্রামকে কিনে নিল ১ বিলিয়ন ডলারে! শেয়ারের হিসেবে কেভিনের ভাগে পড়লো ৪০০ মিলিয়ন ডলার! ২০১৮ সালে রিজাইন করার আগ পর্যন্ত কেভিন ইনস্টাগ্রামের সিইও ছিল। এখন নতুন কিছু করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তার একটি ওয়েবসাইট আছে যেখানে মেশিন লার্নিংসহ নানাবিধ নতুন জিনিষ নিয়ে তার জানাশোনা শেয়ার করছে নিয়মিত। ২০১৬ সালেই কেভিন আমেরিকার ৪০ বছরের কম বয়সী বিলিওনিয়ারদের তালিকায় নিজের নাম লিখিয়ে ফেলে। সেই বছরই কেভিন বিয়ে করে।
২০১৪ সালে সিলিকন ভ্যালির স্টার্টআপ স্কুল কেভিনের নিচের সাক্ষাকারটি প্রচার করে।
সেখান থকে কেয়েকটা লাইন
- “The hardest part is finding the problem to solve; solutions come pretty easy.” — সমাধানের জন্য একটি সমস্যা খুঁজে পাওয়াটাই হচ্ছে আসল। তারপর এটার সমাধান পাওয়া যাবেই। সমাধান এমনকি খুব সহজ হতে পারে। উবার, এয়ার বিএনবির কথা ভাবেন তো।
- “You’re never ready, but that’s the fun part.” —সবকিছু শিখে, জেনে-বুঝে তারপর কাজে নামবো – এই বুদ্ধি কিন্তু খুব একটা কাজে লাগবে না। এ হচ্ছে আমাদের চাকরি খুঁজব না চাকরি দো-এর ট্যাগ লাইন – পথে নামলেই পথ চেনা যায়। ২৬ বছর বয়সে একটা বিলিয়ন ডলার কোম্পানি তৈরি করতে হলে পথে নামতে হবে, বেশি অপেক্ষা করতে হবে না।
- “One day on the job is more than one year in a book.” — প্রচুর পড়তে হবে কিন্তু তার চেয়ে বেশি হল যা পড়া হবে সেটা কাজে লাগাতে হবে। ২০১৪-১৫ সালে আমি কয়েকজনকে দেখেছি যারা অধিকাংশ সেশনে যোগ দিয়ে জানাতো তারা অন্ট্রাপ্রিনিয়র হতে চায় সে জন্য সভা-সমিতিতে করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তাদের আমি কখনো কাজে নেমে পড়তে দেখি নাই। ফলে তারা এখনও সেই অবস্থাতেই আছে। কেভিনের প্রিয় দুইটি বই হলো রে ডবলিও-এর প্রিন্সিপল ও এরিক রাইসের দ্যা লিন স্টার্টআপ। লিস স্টার্টআপের বাংলা অনুবাদও হয়েছে।
ইনস্টাগ্রাম কেন সফল এপ সেটার কয়েকটি সহজ কারণ আমার পাঠকরা সহজে বের করতে পারবেন বলে আমার ধারণা। কাজে আমি আমার পন্ডিতি ফলাতে গেলাম না। সেই কারণগুলোর একটি হতে পারে কোন গার্ল ফ্রেন্ডের কোন পরামর্শটা নিতে হবে আর কোনটা নিতে হবে না সেটা সম্পর্কে দারুণ একটা বোধ থাকা।
যাদের গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক তাদের জন্য শুভ কামনা।