জয় পরীক্ষা! জয় সার্টিফিকেট!
এবারের পিএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে ২১ নভেম্বর থেকে। পরদিনের পত্রিকার পাতা খুলে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি, প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার প্রথম দিনে অনুপস্থিত ছিল দুই লাখ ১৪ হাজার ৩১ জন শিক্ষার্থী। (প্রথম আলো, ২২ নভেম্বর, পৃষ্ঠা-৩)। অনুপস্থিতির সংখ্যাটা চমকে দেওয়ার মতো। শতকরা হিসাব বের করতে গিয়ে দেখা গেল, অনুপস্থিতির এই হার প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ। কোনো পরীক্ষার প্রথম দিনে একযোগে এত অনুপস্থিতি কখনো লক্ষ করিনি। এর একটা কারণ পরীক্ষাভীতি, সে কথা চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়। অন্যান্য কারণ হয়তো গবেষণার বিষয়। আমাদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা খুব বেশি জোরদার নয়, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এবং সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায়। অর্থাৎ, বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে প্রাক-প্রাথমিক ছাড়াই সরাসরি প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই তাদের অন্য স্কুলে গিয়ে পুলিশি ব্যবস্থায় পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। কোনো এক সময়ে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাভীতি কাটাতে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক বার্ষিক পরীক্ষাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে এই রীতি চালু। দেশের অনেক ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়েও এই ব্যবস্থা আছে। তবে, বেশির ভাগ বিদ্যালয়ই পরীক্ষাপ্রেমী। শ্রেণী পরীক্ষা, প্রথম সাময়িক, দ্বিতীয় সাময়িক, বার্ষিক—এ রকম নানা পরীক্ষার ব্যবস্থা করে শিক্ষার্থীদের এসব পাবলিক পরীক্ষার জন্য তৈরি করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সদা সচেষ্ট। জোর দিয়ে বলতে পারি, এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানের আগ্রহ বাড়ে না। তারা কেবল অধিক জিপিএ পাওয়ার জন্য মুখস্থ করতে থাকে। পরীক্ষাভীতি কাটিয়ে ওঠার আগেই বেচারা ১০ বছর বয়সে অন্য একটি স্কুলে পরীক্ষা দিতে যায়, যেখানকার পরিদর্শকদের সে জীবনে হয়তো দেখেওনি! পরীক্ষার হলে কেমন আচরণ করতে হয়, সম্ভবত সেটিও সে জানে না। অন্যদিকে আমরা ধরে নিয়েছি, ডিগ্রি পরীক্ষা যেমন করে হয়, পিএসসিও সেভাবে হতে হবে। কাজেই প্রতিদিনের পরীক্ষার পর পত্রিকায় যে খবর প্রকাশিত হয়, তাতে অবশ্যই এমন বাক্য চোখে পড়ে, ‘এ ছাড়া প্রাথমিকে আটজন ও ইবতেদায়িতে চারজন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’
আমাদের শিক্ষা প্রশাসকেরা যেন যত বেশি পরীক্ষা চাপাতে পারেন, ততই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। অথচ শিক্ষার উদ্দেশ্য কখনো সার্টিফিকেট অর্জন নয়। দেশে এখন ১২ বছরের শিক্ষাজীবনে মোট চারটি পাবলিক পরীক্ষা দিতে হয়। এটি বিশ্বের বিরলতম ঘটনা। পৃথিবীর কোথাও শিক্ষাজীবনের পাঁচ বা আট বছরের মাথায় কোনো পাবলিক পরীক্ষা দিতে হয় না। শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর অগ্রগতি মূল্যায়নের একমাত্র উপায় পরীক্ষা নয়। একজন শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত শিখন ফল অর্জন করছে কি না, বস্তাপচা জিনিস মুখস্থ না করিয়েও সেটা যাচাই করা যায়, আনন্দের সঙ্গেও সেটা করা যায়।
স্কুলজীবনে এক শিক্ষক আমাদের ক্লাসে পরীক্ষা নিতেন এবং সেই পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আমরা সবাই উন্মুখ হয়ে থাকতাম! তিনি যেদিন পরীক্ষা নিতেন, সেদিন ক্লাসে এসে তাঁর হাতের দুই পাশের শিক্ষার্থীদের বাঁ ও ডান—এভাবে ভাগ করতেন। তারপর তিনি প্রশ্ন করতেন আর বাঁ ও ডান দল উত্তর দেওয়ার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতো। যারা শুদ্ধ উত্তর দিত, বোর্ডে তাদের ১০ পয়েন্ট দেওয়া হতো। প্রশ্ন কঠিন হলে স্যার বোনাস নম্বরও দিতেন! পুরো ব্যাপারটি এত আকর্ষণীয় ও মজাদার ছিল যে, কোনো সপ্তাহে ডান-বাঁয়ের লড়াই না হলে আমাদের মন খারাপ হতো!
পিএসসি পরীক্ষা শেষে একজন শিক্ষার্থীর অর্জন একটি এ-ফোর পেপারের কাগজ। সেটি দিয়ে তার কী হবে, আমি জানি না। মহাবিশ্বের কোথাও এই সার্টিফিকেট তার দেখাতে হবে বলে আমার প্রত্যয় হয় না। একটি অনুষ্ঠানে একজন নীতিনির্ধারক আমাকে বলেছেন, ক্লাস ফাইভের পর অনেকে আর পড়ালেখা করে না। কাজেই তার কাছেও একটা সার্টিফিকেট থাকলে তার অর্জন সম্পর্কে সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারে। বটে!!! তিনি আমাকে আরও ব্যাখ্যা করলেন, যেসব চাকরির, বিশেষ করে সরকারি চাকরির যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণী পাস, সেগুলোতে কোনো অথেনটিক সার্টিফিকেট পাওয়া যায় না। সে জন্য জেএসসির মাধ্যমে অষ্টম শ্রেণী পাসের একটি অথেনটিক সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে। যেন-বা ইন্টারভিউ বোর্ডের লোকেরা ইন্টারভিউ নিয়ে একজন প্রকৃত অষ্টম শ্রেণী পাসকে চিনতে পারেন না!
প্রতিটি দেশেই স্কুলজীবন শেষে একটা পরীক্ষা নেওয়া হয়, যাতে উচ্চশিক্ষার প্রাক-যোগ্যতা যাচাই করা যায়। হাইস্কুল বা দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু সার্টিফিকেট দেওয়া নয়। এ সময় শিক্ষার্থী যেন কয়েকটি বিশেষ গুণ অর্জন করতে পারে, সেগুলো নিশ্চিত করাই হচ্ছে এই পর্যায়ের কাজ। যেমন: পড়া, লেখা, শোনা, অনুধাবন কিংবা গণনার কাজগুলোতে দক্ষতা অর্জন প্রাথমিকের শিখন ফল। উচ্চমাধ্যমিকে আরেকটি কাজ হলো, তাকে উচ্চশিক্ষার জন্য তৈরি করা। কাজেই বিশ্বব্যাপী এখন একটি সাধারণ প্রবণতা হলো, ১২ বছর শিক্ষাজীবন শেষে এমন একটা পরীক্ষা নেওয়া। এর ফলের ভিত্তিতে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে। যেসব দেশে সবার জন্য শিক্ষার ব্যাপারটা নিশ্চিত, তারা তাই আর কোনো ঝামেলায় যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এসএটি (SAT) পরীক্ষা তার একটি উদাহরণ। এই পরীক্ষা কিন্তু ১০-১২ দিন ধরে হয় না, এক-দুই দিনে শেষ হয়ে যায়। পরীক্ষাটি হয় বিশদ জানার ওপর; কে কতটা মুখস্থ করতে পারে, তার ওপর নয়। অন্যদিকে যেসব দেশে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা একটি প্রান্তিক যোগ্যতা, তারা সেখানে দুটি পরীক্ষা রেখেছে। একটি দ্বাদশ শ্রেণী শেষে পরীক্ষা। এই পরীক্ষার সনদ কারও কারও প্রান্তিক যোগ্যতা হিসেবে কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগে। আর এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করে। ব্রিটিশ ও-এ লেভেল, ভারত কিংবা বাংলাদেশের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা হচ্ছে এর একটি উদাহরণ। এসব দেশে যেহেতু কোনো একটি বিষয়ে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীর সংখ্যা আসনসংখ্যার চেয়ে বেশি, কাজেই এ রকম পরীক্ষা একটি প্রাথমিক ছাঁকনির কাজ করে। বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে বা ভারতের সব আইআইটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য একটি মাত্র পরীক্ষা দিলেই চলে।
একুশ শতকের শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য শিক্ষার্থীকে বিশ্বমানব হিসেবে গড়ে তোলা। ১২ বছরে চারখান এ-ফোর সাইজের কাগজ দিয়ে দিলেই যে সেটা হয় না, এটা আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কবে বুঝবেন, তা আলেমুল গায়েবই জানেন।
আমি কেবল আগ বাড়িয়ে এসব কোমলমতি শিশুর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে রাখতে পারি, তারা যেন আমাদের এই অবিমৃশ্যকারিতাকে ক্ষমা করে দেয়।