ক্ষুধার্ত থাকো, বোকা থাকো-১ : প্রস্তাবনা
১৯৭৪ সাল। ওয়াটারগেট কেলেংকারি আর ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ। বাবা-মার বাড়িতে বসে হিপ্পি ছেলেটা সময় কাটায়। সে সময় পঙ নামের একটা গেম খুবই জনপ্রিয় হওয়ায় সেটার মালিক প্রতিষ্ঠান আটারিও যথেষ্ট মর্যাদাবান হয়ে উঠেছ। হিপ্পিটা একদিন সান জোসে মারকারি নিউজে একটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে খুবই উৎসাহী হয়ে উঠল। আটারি ইলেকট্রনিক্স টেকনিশিয়ান নেবে। হিপ্পি আবেদন করলো।
সে সময়ের আটারির চিফ ইঞ্জিনিয়ার আল এলকর্ন প্রায়শ তার অফিসে একঝাঁক ছেলমেয়েকে পেতেন যারা সেখানে চাকরি করতে চায়। কেও কেও চাকরি পেত আর কেও কেও পেত না। সেরকম একদিন পার্সোনেল ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার এসে এলকর্নে জানালো একটা হিপ্পি এসে বসে আছে। হিপ্পিটা বলছে – তাকে চাকরি দেওয়া না হলে সে আটারির অফিস থেকে যাবে না। পার্সোনেল হেড আসলে জানতে চাচ্ছে পুলিশ ডেকে ঐ হিপ্পিকে বের করবে কি না। তবে এলকর্ন তাকে ডাকতে বললেন। আঠারো বছর বয়সী হিপ্পিকে দেখে এলকর্ন কী ভাবলেন কে জানে তবে হিপ্পিটার চাকরি সেখানে হয়ে গেল। সারাজীবনে হিপ্পিটা কেবল ঐ একটা চাকরিই করেছে। তার কারণ এই নয় যে, সে আটারিতেই চিরস্থায়ী হয়ে প্রমোশন পেয়েছে। কারণ এই যে, পরে ঐ হিপ্পিটা আর “চাকরি খুঁজে নাই, চাকরি দিয়েছে”।
পত্রিকায় ঈগল কম্পিউটারের মৃত্যুর খবর ছাপা হয়েছে!
এই স্টার্টআপ কোম্পানি যেদিন গণ-প্রস্তাব (আইপিও, শেয়ার বাজারে প্রাথমিক শেয়ার ছাড়া) ছাড়ে সেদিনই এর শীর্ষনির্বাহী কোটিপতি বনে যায়। সহ-প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে নিয়ে সে যায় খানা-পিনা করতে। সেখান থেকে যায় নিজের জন্য একটি ফেরারী গাড়ি কিনতে! টেস্ট ট্রায়াল দিতে বের হয়ে দূর্ঘটনায় পড়ে এবং মারা যায়। শীর্ষ নির্বাহীর মৃত্যুতে কোম্পানিও মারা যায়। সে সঙ্গে জে যে কাজের জন্য চাকরি ছেড়েছেন, সেটিতে আর যোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি।
একই রুমে ২৫ বছর বয়সী এক তরুনও অপেক্ষারত ছিল। তাদের আলাপের মাঝখানে তারা দু’জন আবিস্কার করে দুজনেরই দাড়ি আছে আর দুজনেই কম্পিউটার পছন্দ করে। যুবকটি নিজেকে স্টিভ জবস নামে পরিচয় দিয়ে বলে সে এপল কম্পিউটার নামে একটি কোম্পানির বোর্ড চেয়ারম্যান। জে তখনো সেভাবে এপলের নাম শোনেনি। শোনার কথাও নয়। কাজে ২৫ বছর বয়সী জবসের কোম্পানি নিয়ে তেমন আগ্রহও তার হয়নি।
অন্যদিকে জবস দেখেছে ৪৪ বছর জে’র মধ্যে এমন কিছু আছে যা সে খুঁজছে কিছু দিন ধরে। জে’র কাছ থেকে জেনেছে সে নতুন কিছু করতে আগ্রহী এবং আইবিএমের ধীরে চলা নীতি তার পছন্দ নয়। কাজে জবস জে কে এপল যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানায়!
জে বিনীতভাবে জানায়,”আমাকে এফোর্ড করা তোমাদের দ্বারা সম্ভব নয়।”
এ ঘটনার মাত্র কয়েকদিন পরে পূজিবাজারে আত্মপ্রকাশ করে এপল। এপলের বাজার মূল্য হয় ২৫০ মিলিয়ন ডলার! কোম্পানি আর স্টিভের পক্ষে জে কে কেনা সম্ভব হয়।
দুই সপ্তাহ পরের শুক্রবারে জে এলিয়ট এপলে কাজ করতে শুরু করেন, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে। বেতন সামান্য বেড়েছে, স্টক অপশনও বেড়েছে। এবং সঙ্গে ইন্টেল গুরুর আশীর্বাদ, “এপল কোথাও যাবে না। তুমি একটা মস্ত বড় ভুল করছো”।
কম্পিউটার জগতের অন্যান্যদের সঙ্গে জবসের পার্থক্য তার শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত নিশ্চুপ থাকা। স্পাই থ্রিলারের ভিলেনদের সঙ্গেও পার্থক্য এখানে। যোগদানের প্রথম দিন আলাপ আলোচনায় জে নিজের কাজ কী হবে সে সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতে পারলো না! খালি জানলো স্টিভ পরদিন সকালে তাকে কোথাও নিয়ে যাবে।
পরদিন জবস তাকে পিএআরসি, জেরক্সের রিসার্চ সেন্টারে নিয়ে যায়। সঙ্গে এপলের আরো কয়েকজন সেখানে ছিল। সেখানে এমন কিছু তারা দেখেন যা পরে মাউস নামে পরিচিত হয়। তারা সেখানে দেখেন কী-বোর্ডে না লিখেও কম্পিউটারে কাজ করা যায়, কম্পিউটারের পর্দায় গ্রাফিক্স! এমন কিছু যার নাম পরে হয়েছে গ্রাফিকাল ইউজার ইন্টারফেস। সে সময় পিএআরসি এমন মেইন ফ্রেম কম্পিউটার ডিজাইন করার চেষ্টা করছিল যার দাম হবে দশ থেকে বিশ হাজার ডলার! কারণ আইবিএমের সঙ্গে লড়তে হবে!
পিএআরসির যে লোকটি এপলের টিমকে সবকিছু দেখাচ্ছিল সে বুঝেছে যে অন্য দর্শকদের সঙ্গে এদের ভাল রকমের পার্থক্য আছে। কারণ এরাই “সম্ভবত প্রথম দর্শক” যারা কিনা ব্যাপারগুলো বিশ্বাস করেছে। ঐ দলের দলনেতাকে খালি দেখলো কিছুক্ষণ পর পর লাফাতে, চিৎকার করতে।
“ওয়াও। হোয়াট এ গ্রেট থিংক ব্লা ব্লা ব্লা।”
জেরক্সের চিন্তায় ছিল নতুন মেইন ফ্রেম কম্পিউটার বানিয়ে আইবিএমের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া। তবে, ঐদিন ঐ রুমে ২৫ বছর বয়সী স্টিভের মাথায় এমন কোন চিন্তা ছিল না। তার মাথায় ছিল “সবার জন্য কম্পিউটার”।
এখন আমরা জানি, পার্কে ঐদিন স্টিভ জবস কম্পিউটারের ভবিষ্যত দেখেছেন। দেখেছেন কীভাবে এই যন্ত্র দিয়ে মানুষের তিন ‘সি’কে (Connect, Consume and Communication) বদলে দেওয়া যাবে।
সেদিন থেকে আসলে স্টিভ জবস ঠিক সে কাজটি করছেন!!!
===আমার কথা====
জেফরি এস ইয়ং আর উইলিয়াম এল সিমনের আইকন পড়ছি কয়েকদিন ধরে। স্টিভ জবসের ব্যাপারে প্রথম আমার আগ্রহ হয় ভোরের কাগজে একুশ শতক করার সময়। একবার সিলিকন ভ্যালির ওপর মূল রচনা করার জন্য অনেক কিছু পড়তে হয়েছে। তখন আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল প্রযুক্তি, প্রযুক্তির পেছনের মানুষেরা নয়! কাজে সিলিকন ভ্যালিতে আমি কেবল চিপস আর সার্কিটের ব্যাপারই দেখতাম।
বছর কয়েক আগে আবার সিলিকন ভ্যালির খোঁজে নামি। ততদিনে জেনেছি –
হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, হিউম্যানওয়্যার
এই তিন মিললে হয় বিজয়
মানুষই আসল তবু
নইলে সবই পরাজয়।
কাজে আমার কাজ হয় ভ্যালির সফল (এবং ব্যর্থ) মানুষগুলোকে জানা। এর মধ্যে কয়েকজনকে বেছে নিয়ে পড়তে শুরু করি। উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেটে নানান ব্লগ ইত্যাদি। পরে মনে হল বইই পড়তে হবে। দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে জে এলিয়ট আর উইলিয়াম এল সিমনের স্টিভ জবস’স ওয়ে বইটা কিনেএনে পড়তে শুরু করি। তখনও স্টিভ বেঁচে।
২০১০ সালে এটিএন নিউজে টেকনিউজ নামে একটা টেক অনুষ্ঠান করতে শুরু করি। সেখানে আমি, আশা আর মোস্তফা নসীব মিলে ঠিক করি জবসকে নিয়ে একটা তিন পর্বের সিরিজ করবো। আবার পড়াশোনা শুরু করলাম এবং কী আশ্চর্য আমাদের প্রথম পর্ব প্রচারের কয়েকদিন পরেই স্টিভ এই দুনিয়া ছাড়লেন। সেই সময়ে স্টিভকে নিয়ে আবার কিছু পড়তে হয়েছে।
এবার ঠিক করেছি আইকন পড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্টিভকে আমার চেনার অংশটা সবার সঙ্গে শেয়ার করবো।
এই সিরিজটা সেই চেষ্টারই প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাদের জন্য “আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না” কবিতাটা লিখেছেন সেই অলস লোকদের মধ্যে আমার নাম সবার শীর্ষে আছে। তারপরও আমি এই কাজটা শুরু করেছি। লেখাটা একটা নতুন স্টাইলে লিখবো ঠিক করেছি। অনেকটা সিনেমার মত। কখনো সামনে চলে যাবো তারপর ফ্ল্যাশ ব্যাকে পিছনে আসবো। কখনো ঘটনা থেকে বিশ্লেষনে চলে আসবো। আমার কখনো শাদামাটাভাবে যা মনে হবে তাই লিখবো। তবে, অনেক সময় যা ভাবি তা লেখা হয় না। কী বোর্ড অনেক কিছু উল্টাপাল্টা লিখিয়ে নেয়। কাজে এখানেও আগ বাড়িয়ে কিছু বলাটা ঠিক হবে না। আল্লাহ ভরসা করে নেমে পড়লাম।
মহান আল্লাহতায়ালা যেন আমাকে লেখাটা শেষ করার তৌফিক দেন।
সবার সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক।
5 Replies to “ক্ষুধার্ত থাকো, বোকা থাকো-১ : প্রস্তাবনা”
Leave a Reply Cancel reply
You must be logged in to post a comment.
স্যার, একই কথাই তো মনে হয় সামুতে লিখেছিলেন
হ্যা। তবে, আধাআধি যাওয়ার পর মনে হয়েছে এক বইতে এতবড় লোককে লিখে ফেলা ঠিক হচ্ছে না। তাই আইকনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এখন সব কিছু মিলিয়ে একটা সমন্বিত কিছু লেখার চেষ্টা করবো।
যদিও কী হবে তা কেবল আলেমুল গায়েবই জানেন।
সবার সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক।
Munir Vi
arektu sohoj vasha hole valo hoi…..
ধন্যবাদ স্যার, এমন একটি লেখা আমাদের মত নবীনদের উপহার দেয়ার জন্য।