শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ জন হর্টন কনওয়ে
জন হর্টন কনওয়ে একজন গণিত বেত্তা। গণিতের পাজল, রিডল আর গেম নিয়ে তাঁর অনেক কাজ। ১১ এপ্রিল ২০২০ তারিখে প্রিন্সটনে তিনি মারা যান। করোনাতেই গেলেন। ৮২ বছর বয়সে।
এই ইংরেজ গণিতবিদ ফাইনাইট গ্রুপ, নট থিউরি, সংখ্যাতত্ত্ব, কম্বিনেটোরিয়াল গেইম থিউরি আর কোডিং থিউরি নিয়ে কাজ করতেন। বিনোদন গণিতে তার বুৎপত্তি ছিল অনেক। তার হাতেই অনেক পাজল ও রিডলের সূচনা। পাজল-রিডল, বিশেষ করে গাণিতিক পাজলের অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর গুরত্বপূর্ণ অবদান আছে।
এই গণিত বেত্তা সবচেয়ে বেশি পরিচিত তার গেমস অব লাইফের জন্য।
ছুটির দিনে তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে মনে হলো তার কোন একটা বিখ্যাত পাজল নিয়ে লিখতে পারি। সেই হিসাবে এই লেখা।
তাঁর একটি বিখ্যাত সমস্যা, আমার বয়ানে নিচে দিলাম
———————————————
করোনাকালে সবাই দেখি জিলাপী খাচ্ছে। সেদিন আমারে কে জানি শুনায়ে গেল ওরা কেমন করে জিলাপী খাচ্ছে। মনের দু:খে একটু আগে জিলাপী কেনার বাসনা নিয়ে বাসা থেকে বের হলাম।
বের হতে গিয়েই দেখি রাস্তায় বাসার সামনে একটা বাস। একটু অবাক হলাম। গার্ড বললো, “স্যার এটাতে চলে যান।”
আমি উঠতে উঠতে বাস ছেড়ে দিল। কোন রকমে উঠে ভিতরে তাকিয়ে দেখি, ওমা, বাসে তো লোকজন নেই।
তারপর ভালমতো দেখলাম সামনের দিকে দুইটি মাথা দেখে যাচ্ছে। দুইজনের মাথায় দুইটি টুপিও আছে, লম্বা মতন। একটা লাল আর একটা নীল।
কী ভেবে, ওদের পেছনের সীটে গিয়ে বসলাম। তারপর ওদের দুইজনকে খেয়াল করলাম। টুপির মধ্যে তারা আছে। দুজনেই নীল আর লাল জোব্বা টাইপের একটা কিছু পরা এবং পরিস্কার বুঝতে পারলাম ঘাড়ের ওখান থেকে আলাদা একটা কাপড় আছে। বাজিকরদের জামার পেছনে যেমনটা আলাদা একটা কাপড় থাকে সেরকম। দুজনের হাতেই দেখলাম লাল আর নীল একটা করে কাঠি।
আরে বাবা। আমি তো দেখি দুই বাজিকরের পেছনে বসে আছি। ভয়ে ভয়ে ড্রাইভারের দিকে তাকালাম। সর্বোনাশ। এতো দেখি কালো আলখাল্লা পড়া একটা লোক। বাইরে তাকাতে গিয়ে দেখলাম এলাকাটা চিনতেও পারছি না।
যাক গে। যা আছে কপালে। বসে থাকি আর শুনি ঐ ব্যাটারা কী বলছে।
নীল জোব্বা বাজিকর : আমার ছেলেমেয়েদের প্রত্যেকের বয়স কিন্তু পূর্ণ সংখ্যা। ওদের বয়সের যোগফল হলো এই বাসের নম্বর আর গুণফল হলো আমার বয়স।
লাল জোব্বা বাজিকর : ইন্টারেস্টিং তো। তা তুমি যদি আমাকে তোমার বয়স আর ছেলে-মেয়ের সংখ্যা বলো, তাহলে আমি ওদের প্রত্যেকের বয়স বের করতে পারবো, বোধহয়।
নীল জোব্বা বাজিকর : না, সেটি তুমি পারবে না।
লাল জোব্বা বাজিকর : যাক, এতোদিনে আমি তোমার বয়স বের করতে পারলাম।
বোঝা যাচ্ছে, লাল জোব্বা নীল জোব্বার বয়স বের করার চেষ্টা করছে।
সময় কেটে যাচ্ছে দেখে, আমি ড্রাইভারকে বললাম, “ভাই, আমার জিলাপী খাওয়ার শখ মিটে গেছে। আমাকে বাসার সামনে নামিয়ে দেন।”
ড্রাইভার আমার দিকে তাকালো। হায় হায়। এতো দেখি একটা কংকাল। আমার দিকে কঠিন দৃষ্টি দিয়ে বললো – এ বাসের নম্বর কতো? সেটা বলতে পারলে তোমাকে নামিয়ে দেবো।
হায় হায় বাসে ওঠার সময়তো এটা কতো নম্বর বাস সেটা খেয়াল করি নাই।
——–=—–
এবার এর সমাধানের চেষ্টা করা যাক।
লাল জোব্বা নিশ্চয় আমার মতো বোকা না। সে নিশ্চয়ই বাসের নম্বর দেখেই বাসে উঠেছে। কিন্তু নীল জোব্বা যখন বলছে সে যদি তার বয়স কিংবা ছেলে-মেয়েদের সংখ্যা বলেও দে, তাও নাকি তাদের আলাদা আলাদা বয়স বের করা সম্ভব হবে না। তার মানে বাচ্চাদের বয়স ভিন্ন ভিন্ন হলেও তাদের যোগফল বাসের নম্বরের সমান আর গুণফল তাদের বাজিকর বাবার বয়সের সমান হবে এমন কেস একাধিক।
আরও একটা তথ্য দেওয়া আছে কিন্তু। সেটা হলো বাচ্চা-কাচ্চা কমপক্ষে কয়টা?
যদি একটা মাত্র বাচ্চা হয় তাহলে বাচ্চার বয়স, বাসের নম্বর আর নীল জোব্বা বাজিকরের বয়স একই হয়ে যাবে! (যেহেতু বাজিকর আর জাদুর জগৎ কাজে এমনটা হলেও হতে পারে।)
আবার দেখি, নীল জোব্বার বাচ্চার সংখ্যা কিন্তু দুইও হতে পারবে না!!!
কেন?
ছোটবেলার বীজগণিতের কথা মনে আছে তো? দুইটি সংখ্যার যোগফল আর গুণফল জানলেই কিন্তু দুইটি সংখ্যাকেই বের করে ফেলা যায়। কিন্তু নীল জোব্বা তো বলেই দিল যে তার বয়স ও বাচ্চাদের সংখ্যা জানলেও বাচ্চাদের আলাদা আলাদা বয়স বের করা যাবে না। তার মানে বাচ্চার সংখ্যা দুই এর বেশি। কমপক্ষে তিন জন। কিংবা তার চেয়েও বেশি।
এখন আমরা দেখি এখানে আমাদের কী কী ভ্যারিয়েবল নিয়ে কাজ করতে হবে। মোট ৪টি।
নীল জোববা বাজিকরের বয়স (A), বাচ্চাদের সংখ্যা (N), বাসের নম্বর(B) এবং বাচ্চাদের আলাদা আলাদা বয়স (C)।
এখন আমরা বলতে পারি –
বাজিকরের বয়স (A), বাচ্চাদের সংখ্যা (N) এবং বাসের নম্বর(B) থেকে বাচ্চাদের বয়স বের করা সম্ভব নয়। এর মানে হলো বাচ্চাদের সংখ্যা (N) ও বাচ্চাদের বয়সের (C) একাধিক সম্ভাবনা রয়েছে যেখানে গুণফল বাজিকরের বয়সের(A) সমান হবো
আমরা বিভিন্ন সংখ্যা নিয়ে ট্রায়াল এন্ড এরর করতে পারি। ধরা যাক বাসের নম্বর ৫। সে ক্ষেত্রে একটা সম্ভাবনা হলো নীল জোব্বার বয়স ১! এবং তার পাঁচটি বাচ্চার প্রত্যেকের বয়সও ১!
হাহাহা, এটা সম্মভব যেহেতু জাদুর ব্যাপার স্যাপার।
কিন্ত বাস নম্বর ৫ হলে আরও সম্ভাবনাও থাকে।
বাচ্চার সংখ্যা (N) | বাজিকরের বয়স (A) | বাচ্চাদের বয়স (C) | ||||||
৫ | ১ | ১ | ১ | ১ | ১ | ১ | ||
৪ | ২ | ১ | ১ | ১ | ২ | |||
৩ | ৩ | ১ | ১ | ৩ | ||||
৩ | ৪ | ১ | ২ | ২ | ||||
২ | ৪ | ১ | ৪ | |||||
২ | ৬ | ২ | ৩ | |||||
১ | ৫ | ৫ |
বোঝায় যাচ্ছে বাসার নম্বর ৫ নয়।
এরকম করে হয়তো হবে না, বরং বড় সংখ্যা নিয়ে কাজ করতে পারি। ধরি বাসের নম্বর ২১।
এটা এমন হতে পারে
বাচ্চার সংখ্যা (N) | বাজিকরের বয়স (A) | বাচ্চাদের বয়স (C) | ||||
৩ | ৯৬ | ১ | ৮ | ১২ | ||
৩ | ৯৬ | ২ | ৩ | ১৬ |
আবার এমনও হতে পারে
বাচ্চার সংখ্যা (N) | বাজিকরের বয়স (A) | বাচ্চাদের বয়স (C) | ||||
৩ | ২৪০ | ৪ | ৫ | ১২ | ||
৩ | ২৪০ | ৩ | ৮ | ১০ |
দেখা যাচ্ছে ৩টি বাচ্চার ক্ষেত্রে তাদের বয়সের বিভিন্ন কম্বিনেশন যেমন সম্ভব তেমনি আবার জটিলতা হচ্ছে নীল বাজিকরের বয়স। তার বয়স নিশ্চিত করা যাচ্ছে না (হয় ৯৬ বা ২৪০)! তার মানে বাসের নম্বর ২১ নয়!
আচ্ছা ২২ নিলে কী হবে? তখন একটা ইন্টারেস্টিং বিষয় আমরা দেখতে পাই-
বাচ্চার সংখ্যা (N) | বাজিকরের বয়স (A) | বাচ্চাদের বয়স (C) | |||||
৪ | ৯৬ | ১ | ১ | ৮ | ১২ | ||
৪ | ৯৬ | ১ | ২ | ৩ | ১৬ |
অথবা সেটি এমনও হতে পারে
বাচ্চার সংখ্যা (N) | বাজিকরের বয়স (A) | বাচ্চাদের বয়স (C) | |||||
৪ | ২৪০ | ১ | ৪ | ৫ | ১২ | ||
৪ | ২৪০ | ১ | ৩ | ৮ | ১০ |
মজাটা সবাই হয়তো ধরতে পেরেছেন। হ্যা, একটি ১ বছরের বাচ্চা জুড়ে দিলেই হিসাবটা ঠিক থাকে। এর একটাই অর্থ যে, বাস নম্বর ২২ হলে, নীল বাজিকরের বয়স নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না। এভাবে এখন আমি ১ করে বাড়াতে পারি, তাতে আমার নিশ্চয়তা কমে না। তারমানে বাসের নম্বর ২১ বা তার চেয়ে বেশি হতেই পারে না।
আগে আমরা দেখেছি এটি ৫-এর কমও হতে পারবে না। তার মানে বাসের নম্বর ৫ আর ২১ এর মাঝখানে হবে।
এখন ধাপে ধাপে চেষ্টা করে আমরা উত্তরটা বের করতে পারি। সেটা হলো ১২। এ ক্ষেত্রে নীল জোব্বা বাজিকরের মাত্র একটা বয়সই থাকে এবং তার সন্তানদের বয়স হতে পারে ২,২,২ ও ৬ কিংবা ১,৩,৪ ও ৪। আর নীল বাজিকরের বয়স ৪৮।
বাচ্চার সংখ্যা (N) | বাজিকরের বয়স (A) | বাচ্চাদের বয়স (C) | |||||
৪ | ৪৮ | ২ | ২ | ২ | ৬ |
বাচ্চার সংখ্যা (N) | বাজিকরের বয়স (A) | বাচ্চাদের বয়স (C) | |||||
৪ | ৪৮ | ১ | ৩ | ৪ | ৪ |
এভাবে চেষ্টা করে করে এই সমস্যার সমঅদান করতে হবে।
হ্যাপি প্রবলেম সলভিং