ইনোসেন্টের শরবত-১: হোয়াট ইজ দি বিগ আইডিয়া
আগের পর্ব-এ বুক এবাউট ইনোসেন্ট : অবতরণিকা
উদ্যোক্তার জন্ম হয় নাকি উদ্যোক্তা তৈরি হয় – এটি অনেক পুরানো বিতর্ক। আমরা নিজেরাও খুব বেশি নিশ্চিত নই। তবে, আমাদের তিনজনই ছোটবেলাতে কোন না কোন সম্ভাবনার ব্যাপার প্রকাশ করেছি।। ১১ বছর বয়সের মধ্যে আমরা তিনজনই আলাদাভাবে নিজ নিজ প্রথম ব্যবসার কাজ করেছি। এডাম তার ক্লাসমেটদের গণিতের হোমওয়ার্ক করে দিত টাকার বিনিময়ে, সিগারেট লাইটার বেচার জন্য জনের কপালে জুটেছিল ডিটেনশন আর রিচার্ডের তো একটা সাইড ব্যবসা ছিল স্টিকার বেঁচার।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচয়ের পরপরই আমরা নিজেদের এই কমন উদ্যোক্তাসুলভ দিকগুলো খুঁজে পাই। সে সময় আমরা তিনজনই কেব্রিজের রাতটাকে আকর্ষনীয় করার চেষ্টা করছি। কাজটা অবশ্য মোটেই কঠিন ছিল না। কারণ আমরা খোঁজ নিয়ে দেখলাম আমাদের মতো অনেকেই আছে যারা কলেজের বারে বিয়ার খেয়ে আর রাগবী সংগীত গেয়ে রাত কাটাতে চায় না। তো, আমরা ভাবলাম আমরা একটা নাচের আয়োজন করি।
আমাদের তিনজনের মধ্যে শ্রমের বিভাজনটা ছিল পরিস্কার- এডাম এবং রিচার্ড ছিল আমাদের ডিজে এবং তারাই অনুষ্ঠানটিকে প্রমোট করতো। অন্যদিকে কলেজের একমাত্র কম্পিউটারটি ছিল জনের। কাজে ওর কাজ ছিল ফ্ল্যায়ার আর পোস্টার বানানো।
প্লিজ নামের আমাদের ঐ পাক্ষিক নাচের আসরে আমরা অনেক মজা করেছি। অচিরেই এটি খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং কলেজ কর্তৃপক্ষ সেটি বন্ধ করে দেন। অবশ্য আমাদের রুমে ডেক ছিল আর আমরা এটা দিয়ে মেয়েদের জন্য একটা ‘ডিজে লেসন’ কোর্স চালু করি। তবে, সেটা তেমন একটা জুতের হয়নি। প্লিজ আর ডিজে লেসন থেকে আমাদের শিক্ষা হল চারটি-
- যেখানে কোন ‘অভাব’ সেখানেই সম্ভাবনা,
- কোন রকম অভিজ্ঞতা ছাড়াই কিছু একটা শুরু করা ও সফল করা সম্ভব,
- আমরা তিনজন একত্রে কাজ করতে ভালবাসি এবং আমাদের টিম একটা ভাল টিম।
- ডিজে লেসনটি হালে তেমন একটা পানি পায়নি। কিন্তু প্লিজ খুবই সফল ছিল।
প্রথম তিনটি শিক্ষা আমাদেরকে একত্রিত করেছে এবং পরবর্তী দিনগুলোতে অনেকবার নিজেদের মধ্যে একটি বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনায় উৎসাহ যুগিয়েছে।
আচ্চা আমরা তিনজন মিলে যদি একদিন একটা ব্যবসা শুরু করি তাহলে কেমন হয়? চাকরি না করে?
কিন্তু দেখা গেল কলেজ শেষ হওয়ার পর আমরা তিনজনই চাকরিতে ঢুকে পড়েছি। এডাম প্রথমে গেল কনসাল্টেন্সি ফার্ম ম্যাক-কিনসেতে ও পরে ভার্জিন কোলায়, জন গেল আর একটি পরামর্শক ফার্ম রেইনে আর রিচার্ড গেল এডভার্টাইজিং-এ।এই সময় আমরা একই বাড়িতে থাকতাম, ড্রিংক-এর জন্য একত্রে ছুটতাম বা ছুটি কাটাতে যেতাম। তবে, একটা বিষয় রয়েই গেল – নিজেদের একটি ব্যবসা চালু করার চিন্তা।
চারবছর পরে সুইজরল্যান্ডের এক রিসোর্টে ছুটি কাটানোর সময় আমরা শেষমেষ বিরক্ত হয়ে বলি – হয় আমরা কোন ব্যবসা করবো অথবা ভেগে পড়বো। কাজে ওখানে আমরা ঠিক করলাম পরের সপ্তাহান্তে আমরা প্রত্যেকে কোন না কোন আইডিয়া নিয়ে আসবো যা আমাদেরকে কাজে নামাবে অথবা আমরা এই আলোচনা বন্ধ করে দিব।
ফলো দ্যা নীড
আইডিয়া পাবার জন্য আমরা চারিদিকে খুজতে থাকি, আশেপাশে কোন চ্যালেঞ্জ আছে কী না দেখার জন্য। এখন এটিকে আমরা বলি ফলো দ্যা নীড। আমরা এমন কিছু খুজছিলাম যা আমাদেরকে টাকাতো দেবেই কিন্তু তার সঙ্গে গর্বিতও করবে। কাজেই আমরা প্রত্যেকে নিজের জন্য একটা বার সেট করলাম – এমন কিছু যা জীবনকে একটু ভাল করবে। আমাদের প্রথম চিন্তা ছিল একটি ইরেকট্রিক বাথ-টাব বানানো। তবে, পরে দেখা গেল সেটি আসলে মোটেই কোন ভাল কিছু হবে না। যেখানে আমরা ভাবছিলাম মানুষের জীবন উন্নত করাবো সেখানে ইলেকট্রিক বাথ-টাব তার জীবনকে নিয়েই টানাটানি ফেলে দেবে। কারণ পানি আর বিদ্যুৎ একত্রে যায় না!!!
নিজের গ্রাহককে জানো
সে সময় রিচার্ডের বস ছিল ক্যাথি। ক্যাথি বলতো, একটি ব্যবসা শুরু করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল উদ্দিষ্ট গ্রাহককে চেনা এবং তার সম্পর্কে জানা। রিচার্ড সেসময় ক্যাথির প্রায় সব কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস আর অনুসরণ করতো। ফলে আমরা ক্যাথির এই বাক্যটিও আপ্তবাক্য হিসেবে নিলাম।
এই সময় আমাদের পক্ষে কোন কাস্টোমারকে সবচেয়ে ভালভাবে স্টাডি করা সম্ভব নিজেরা ছাড়া?
কাজেই আমরা ভাবতে শুরু করলাম কি হলে পর তা আমাদের জীবনকে সামান্য হলেও সহজ এবং উন্নত করবে।
২৬ বছরের আমরা তিনজন লন্ডনে থাকি আর কাজ করি। লন্ডনের মত শহরে সারাক্ষনই কিছু না কিছু হচ্ছে। এর সারমর্ম হচ্ছে এই শহরটি মোটেই আমাদের জন্য স্বাস্থ্যকর কিছু নয়। অনেক রাত পর্যন্ত কাজ, তারপর নাইট লাইফ – ব্যায়ামের জন্য কোন সময় নাই, খাওয়া বলতে পিৎজা আর বিয়ার, এমনকী বাবা-মাকে দেখতে যাওয়ার সময়ও নাই। আমরা বুঝলাম আমাদের মত অনেক লোক এই শহরে আছে যাদের স্বাস্থ্যকর থাকার পেছনে এই শহুরে জীবন সারাক্ষণই ষড়যন্ত্র করে চলেছে।
কাজে আমরা যে সমস্যা সমাধান করতে চাইলাম তা হল এই ধরণের লোকদের জীবনে একটু স্বাস্থ্যকর ও একটু উন্নত করা। এই ‘চাহিদা” পূরণ করতে গিয়ে আমরা ভাবলাম স্মুথি হলে কেমন হয়। স্মুথি (পরের দিকে আমি শরবত/স্মুথি দুইটাই বলবো, যদিও স্মুথি ঠিক শরবৎ নয়। আবার এটি ঠিক প্রচলিত জুসও নয়)। সুস্বাদু, স্বাস্থ্যকর, চমৎকার ফলের রস এবং তা বোতলে করে দেওয়া। এটি যদি মানুসের অভ্যাস হয় তাহলে সেটি হবে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস।
আমাদের ধারণাটা তাই খুব সহজ – বোতলের মধ্যে ফল আর তা মানুষকে পৌছানো। স্মুথি প্রায় আমরা সবাই বানাতে পারি। এবং সবচেয়ে বড় কথা আমরা তিনজনই কিন্তু এটা কিনতে রাজী!
বেটার, নট ডিফারেন্ট
আমরা বুঝলাম আমারা এমন একটা ধারণার জন্ম দিয়েছি তা একটা বাস্তব সমস্যাকে সমাধান করবে। কিন্তু তারপরও অন্যদের থেকে আলাদাভাবে আমাদের এটা করতে হবে। অবশ্য শুরুতেই আমাদের মনটা একটু খারাপ হল। কারণ এটি কোন বৈপ্লবিক ধারণাতো নয়ই, এমন কি নতুন কোন ধারণাও নয়। যুক্তরাজ্যেও অনেক বৈপ্লবিক ধারণার জন্ম হচ্ছে কিন্তু আমাদেরটা সেরকম কিছু নয়। কী দু;খ!!!
তবে, অচিরে বোজা গেল উদ্ভাবনই সব নয়। একটি প্রচলিত কাজও যদি সুন্দর করে, ভাল করে করা যায তাহলে সেটাও একটা ভাল ব্যবসা হতে পারে। আমরা স্মুথির উদ্ভাবক নয়, যদিও অনেকেই আমাদের সে ক্রেডিট দিতে চায়। বরং সে সময় ইউকেতে পেটে এন্ড জনি নামে বোতল স্মুথি পাওয়া যায়। এর মানে হল, একটা বাজার এখানে রয়েছে। আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হল ওদের চেয়ে ভাল জিনিস বাজারে দেওয়া।
সেটা করার জন্য আমরা খুব সহজ পথে এগোলাম। পেটে’র স্মুথি তারা বানাতো ফলের কনসেনট্রেশন থেকে। ফলের কনসেট্রেশন আসলে খুব কমদামী ফলের ঘনরস। নি:সন্দেহে কনসেন্ট্রেশন থেকে জুস বানানোটা অনেক লাভজনক কিন্তু এতে স্বাদ এং পুস্টি দুইটিরই নিশ্চয়তা কমে যায়।
আমাদেরটা হবে প্রাকৃতিক, নিশ্চিতভাবে। কিছুই আমরা তাতে যোগ করবো না, কিছুই আমরা সেখান থেকে তুলে নেব না।
দাদীমার টেস্ট
কীপ দ্য মেইন থিং মেইন থিং
========================================
আইডিয়া থেকে ব্যবসা দাড় করানোর চেকলিস্ট
১. ফলো দ্যা নীড
নিজের পারপাশে তাকাও। মানুষের চাহিদা আর প্রাপ্যতার মধ্যে কী কোন গ্যাপ আছে? প্রতিদিনকার জীবনের কোন সমস্যাটির সমাধান করা যায়?
২. তোমার গ্রাহককে জানো
উদ্দিষ্ট গ্রাহককে চেনো। ভাল হয় যদি সেটি তুমি নিজে বা তোমার বন্ধু-বান্ধব হয়।
৩. থিংক বেটার, নট ডিফারেন্ট
নতুন করে চাকা আবিস্কার করার দরকার নাই। কেবল একটু ভাল করে কর।
৪. দাদীমার কথা মনে রেখ
যে ব্যবসা ধারণা তুমি তোমার দাদীমাকে বোঝাতে পারো না, সেটা নিয়ে চেষ্টা করার দরকার নাই। (আমাদের উদ্যোক্তাদের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমাদের অনেক উদ্যোক্তা তাদের বাসাকে বোঝাতে পারে না। )
৫. ফোকাসে থাকো – কীপ দ্যা মেইন থিং মেইন থিং
নিজের ব্যবসা বা ধারণার মূল বিষয়টি চিহ্নিত কর এবং সেটিতে লেগে থাক। সব সিদ্ধান্তের ফল যেন কোন না কোনভাবে তোমার লক্ষ্যাভিসারী হয় সে চেস্টা কর।
====
সবার জীবন পাই-এর মত সুন্দর হোক।
পরের পর্ব – ছোট হোক, তবুও শুরু কর
11 Replies to “ইনোসেন্টের শরবত-১: হোয়াট ইজ দি বিগ আইডিয়া”
Leave a Reply Cancel reply
You must be logged in to post a comment.
সবার জন্যই অনেক কাজের >>>>>”আইডিয়া থেকে ব্যবসা দাড় করানোর চেকলিস্ট”
এক কথায় অসাধারণ!
অসাধারণ !!! 🙂
স্যার, ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠা এরকম কিছু উদ্যোক্তার নাম খুজছিলাম। কিন্তু পাচ্ছি না। আপনি এরকম কয়েকজনের নাম সাজেশন করলে আমার জন্য খুব ভালো হত।
ভাই অনেক ভালো লাগলো লেখাটি পড়ে।
এই ধরনের লেখা এক বসাতে না শেষ করতে পারলে শান্তি পাই না, পরের পোষ্টের জন্য অপেক্ষায় রইলাম। আর আমার ব্লগে আপনার লেখা শেয়ার করলাম।
শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ। তবে, আমি একটা অলস লোক। আলসেমির জন্য অনেক কিচুই করতে পারি না। কাজে আস্তে ধীরেই পড়তে হবে। আর এক সঙ্গে পড়তে চাইলে সাজ্জাতকে একটা পরামর্শ দিয়েছি উপরে, সেটা মানা যাবে। ধন্যবাদ।
সাজ্জাত ভাইর সাথে সহমত
পরের অংশের জন্য অপেক্ষা করছি 🙂
ভাই, ১০ টা পর্ব আগামী ১০ দিনে শেষ করে ফেলেন না। ৩/৪ দিন পরপর হলে পড়ে আরাম পাচ্ছিনা।
তাইলে ১০ পর্ব পর্যন্ত প্রকাশ হওয়ার অপেক্ষা করে তারপর একসঙ্গে পড় :পি
আমার তো আগামী ১০ দিনে নিজের পড়াই শেষ হবে না।