আইএমও ২০১৭ : কেমন করে আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে?
তবে কেবল দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষস্থান নয়, এবারের ফলাফলে বাংলাদেশ আইএমওর অনেক ঐতিহ্যবাহী দলকেও পেছনে ফেলেছে। এর মধ্যে কানাডা ও জার্মানির কথা আলাদা করে বলা যায়। এই দুটি দেশ কেবল একাধিকবার আইএমওর আয়োজন করেছে তা নয়, বরং তাদের দলে এমন খুদে গণিতবিদও থাকে, যারা অতীতে শতভাগ নম্বর পেয়েছে। গণিতবিশ্ব তাদের সম্মানের চোখেই দেখে। কানাডা ও জার্মানির এবারের অবস্থান যথাক্রমে ২৯তম ও ৩৩তম। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার কোনো দেশ আমাদের ওপরে স্থান পায়নি। ২০১৪ সালে গণিতের ফিল্ডস মেডেল বিজয়ী এবারের স্বাগতিক দেশ ব্রাজিলের অবস্থান ছিল ৩৭তম।
লক্ষ্য স্থির রেখে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ফসল হিসেবে এবারের ফলাফলকে বিবেচনা করা যায়। অনেকেই জানেন, ২০০১ সালে প্রথম আলোর সে সময়কার সাপ্তাহিক আয়োজন ‘বিজ্ঞান প্রজন্ম’–এর পাতায় ‘নিউরনে অনুরণন’ নামে গণিতের একটি আয়োজন পথপরিক্রমায় বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডে পরিণত হয়েছে। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, অধ্যাপক মুনিবুর রহমান চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি দেশে গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজনের দায়িত্ব পালন করছে। এ কমিটিকে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক আর এই আয়োজনে থাকে প্রথম আলো। গুণী শিক্ষকদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রথম আলো বন্ধুসভা এবং গণিত অলিম্পিয়াড স্বেচ্ছাসেবক, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী যাদের নাম দিয়েছেন মুভার্স। সেই সঙ্গে শিক্ষক ও অভিভাবকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। এসবের একটি ধারাবাহিক অগ্রগতির প্রকাশ আইএমওর ওয়েবসাইটে দেখা যায়।
আইএমওতে ছয়টি গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে হয় এবং সব কটি শুদ্ধ করে একজন সর্বোচ্চ ৪২ নম্বর পেতে পারে। ২০০৫ সালে মেক্সিকোতে আমাদের ছয়জন খুদে গণিতবিদের মোট অর্জন ছিল মাত্র ৩ নম্বর। ৯১টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ছিল ৮৫তম। সে সময় অনেকেরই বক্তব্য ছিল, বাংলাদেশের আইএমওতে যাওয়া উচিত নয়। আমরা হাল ছাড়িনি। তবে একবারেই বড় কোনো লক্ষ্যের পেছনে আমরা ছুটিনি। আমরা জোর দিয়েছি ধারাবাহিক উন্নতির প্রতি। কাজে আমি এবং আমাদের কোচ ড. মাহবুব মজুমদার এভাবে আমাদের লক্ষ্য স্থির করতাম—কমপক্ষে একজনের একটি সমস্যার সমাধান, কয়েকজনের একটি সমাধান, দ্বিতীয় সমাধান থেকে আংশিক নম্বর প্রাপ্তি, একটি ব্রোঞ্জ, একটি রুপা, দলের মোট নম্বর ১০০ ছাড়ানো, ইত্যাদি।
এই লক্ষ্য ঠিক করার সময় আমরা আমাদের পৃষ্ঠপোষক ডাচ বাংলা ব্যাংকের ব্যাপক সহযোগিতা পেয়েছি। দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যে ওনারা কোন আপত্তি করেন নাই। তারপর আমরা বের করলাম আমাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যে জ্যামিতিটা পড়ে সেটার সঙ্গে আইওমও জ্যামিতির একটা মিল আছে। মিলটা হলো আইওমও-র জ্যামিতি প্রবলেম সলভ করার জন্য প্রাথমিক ভিত্তিটা এখানেই রচিত হয়। কাজে আমরা শুরু করলাম জ্যামিতি নিয়ে যদিও জ্যামিতি ছাড়াও ওখানে থাকে নম্বর থিউরি, কম্বিনেটরিক্স ও বীজগণিত। প্রথম কয়েকবছর আমরা কেবল জ্যামিতিতে থাকলাম। জিওমেট্রি রি-ভিজিটেড নামে একটা বই পাঠ্য করা হলো ক্যাম্পের জন্য। পরের বছরই সম্ভবত আমি একটা বই নিয়ে আসলাম আইওমও থেকে – প্লেইন ইউক্লিয়ান জিওমেট্রির ওপর। এই দুইটা বই থাকলো। সুব্রত-এর নেতৃত্বে জ্যামিতি রি-ভিজিটেড জ্যামিতির দ্বিতীয় পাঠ নামে অনুবাদও করা হল। জ্যামিতির আরও বই যোগাড় করা হল। পাশাপাশি দ্যা আর্ট এন্ড ক্রাফট অব প্রবলেম সলভিংটাকেও সামনে নিয়ে আসা হলো। সমস্যা সমাধানের জেনেরিক বিষয়গুলোকে এগিয়ে আনা হল। আর সেভাবে আমাদের ক্যাম্পগুলোকে প্ল্যান করা হল। একটা বিষয আমরা খেযাল করলাম সেটা হল আমাদের ক্যাম্পারদের আমরা যা পড়াচ্ছি তা যদি পরের ক্যাম্পাররা আগেভাগে করে ফেলতে পারে তাহলে ক্যাম্পারদের সামনে আগানো যাবে। কাজে কৌশলটা হলো-
১. ক্যাম্পাররা যা শিখছে সেটা যেন নিজ এলাকায় গিয়ে অন্যদের কাছে পোছাতে পারে। এজন্য নিজ নিজ এলাকায় ম্যাথ ক্লাব করতে পরামর্শ দেওয়া হল
২. বইগুরো যেন ছড়িয়ে দেওয়া যায় সেটার জনয্আমরা আমমাদের লিস্টের যতো বই সব নিয়ে বিভিন্ন উৎসবে একটা দোকান চালাতে শুরু করলাম
৩. গাণিতিক সংস্কৃতি তৈরি জন্য চালু হলো প্রথম আলোর গণিত ইশকুল
৪. আর লেখা হলো গণিতের বাংলা বই। জাফর স্যার, গৌরাঙ্গ স্যারতো লিখলেনই লেখা শুরু করলো সৌমিত্র, অভীক, সুব্রতসহ আমাদের একাডেমিক টিমের লোকেরা। রাশেদ তালুকদার স্যারকে দিয়ে লেখানো হল ফাংশনের বই। ইলিয়াস স্যার একবার প্রশ্নোত্তর পর্বের প্রশ্নগুলোর উত্তর কম্পাইল করে দিলেন।
এই চারটা কাজের ফলে আমাদের ক্যাম্পের ভিত্তিটা আমরা নিচের দিকে নামাতে পারলাম। ময়মনসিঙহ, বিরল, সিলেট, খুলনা, চট্টগ্রাম এসব জায়গায় একটা করে প্যারালাল ম্যাথ স্কুল চালু হয়ে দাড়িয়ে গেল। পলে ক্যাম্পের প্রথম ধাপ আমরা এক স্তর নামিয়ে দিতে পারলাম।ময়মনসিংহ প্যারালাল স্কুল থেকে আমরা পেয়ে গেলাম মুগ্ধ, স্নিগ্ধ, সানজিদদের। এটি ছিল আমাদের প্রথম স্তরের কাজ।
এরপর আমরা নামলাম পরের ধাপে।
এবার আমরা শুরু করলাম জুনিয়র ও প্রাইমারি ক্যাম্প। আর মেয়েদের ক্যাম্প।
২০১১ সালের প্রাইমারি ক্যাম্প করা হল প্রথমবারের মতো। সেই ক্যাম্পেরই ফসল এবারের রূপাজয়ী চট্টগ্রামের জাওয়াদ আর টিমের বাকী সদস্যদের একজন সোয়াদ। সেই ক্যাম্পের কয়েকজন ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে গেল। ফারদীম মুনির গেলবছর ইন্দোনেশিয়া থেকে ইন্টারন্যামনাল জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াড থেকে রূপার পদক নিয়ে আসলো। এর পাশাপাশি আমরা শুরু করলাম জ্যামিতির বাইরে নম্বর থিউরির ক্যাম্প। আবার করা হল নন-রেসিডেন্সিয়াল ক্যাম্প। কাজে ক্যাম্পার হওয়ার লড়াইটা কিন্তু কঠিন হয়ে গেল।
২০১২ সালে আমরা রূপার পদক পেলাম।
এরপর আমাদের লক্ষ্য ঠিক করা হল ১০০ নম্বর পাওয়া। ততোদিনে জ্যামিতির ব্যাপারটা নিচের দিকে অনেকখানি ছড়িয়ে গেছে। নম্বর থিউরির বইগুলোও ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের কাজ হলো কেমন করে আমরা বীজগণিত, নম্বর থিউরি ও কম্বিনেটরিক্সেও ভাল করতে পারি। সেই পথ-পরিক্রমা এখন চলছে।
আমাদের এখনকার টার্গেট ১,২ এবং ৪ ও ৫।
এখনও ৩ বা ৬ এর পেছনে আমরা দৌড়ানো শুরু করি নাই।
এ তো গেল আমাদের একাডেমিক কোশল। লজিস্টিকের জন্য আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন রাস্তায় গিয়েছি। এই কোশরটার নাম হল – দুই ইঞ্চি থিউরি। নামটা জাফর ইকবাল স্যারের দেওয়া। এর সারমর্ম হলো যে অন্যজনের চেয়ে একটু বেশি (দুই ইঞ্চি) জানে সেই দ্বিতীয়জনকে শেখাতে পারে। কাজেই গণিত ক্যাম্পে তথা আমাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমগুলোতে আমরা স্বেচ্ছাসেবকদের দায়িত্ব দিয়েছি প্রশিক্ষক হিসেবে। এদের বেশির ভাগই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থী। আমাদের কোচ এই প্রশিক্ষকদের তৈরি করে দেন, তারপর তারাই এই ক্যাম্পগুলো চালায়, কোচের তত্ত্বাবধানে। আপনি যদি কোনদিন আমাদের ক্যাম্পে যান দেখবেন সেখানে সিনিয়র ক্যাম্পাররা নিজেদের ক্লাস নিচ্ছে, জুনিয়রদের ক্লাশ নিচ্ছে, মেন্টরিং করছে। কথাতে বলে শেখালেই নাকি সবচেয়ে বেশি শেখা যায়। ফলে তাদের শেখাটাও পোক্ত হতে থাকে। ক্লাশ নিলে একজন শিক্ষার্থী সবচেয়ে বেশি বুঝতে পারে তার দূর্বলতার জায়গাটা। তখন সেটা মেক-আপ করাটা অনেক সহজ হয়। তো এভাবে আমরা আমাদের ক্যাম্পিংগুলো চালাচ্ছি।
এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমাদের একাডেমিক টিম মেম্বারদের বাংলাদেশ সফর। তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে নিয়মিত ক্যাম্প পরিচালনা করছে। উদ্দেশ্য দ্বিবিধ। একটা হরো সেখানকার ক্যাম্পারদের জাতীয় ক্যাম্পে আসার পথ চেনানো আর একটা হলো সেখানকার মেন্টর বানানো। এভাবে এখন দিনাজপুর, খুলনা, চট্টগ্রামে অনেক মেন্টর তৈরি হয়েছে।
আগেই বলেছ কেবল প্রশিক্ষণ নয়, গাণিতিক সমস্যা সমাধানের একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হলে আমাদের এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে হবে তৃণমূলে এবং তা কেবল সম্ভব, যদি বাংলায় অনেক অনেক বই লেখা যায়। ঠিক এই কাজই করা হয়েছে প্রায় ১৫ বছর ধরে। আমাদের শিক্ষক, গণিতবিদ ও স্বেচ্ছাসেবকেরা এরই মধ্যে বাংলা ভাষায় গণিতের নানান বিষয়ে দেড় শতাধিক বই লিখেছেন, যা আমাদের পুস্তক প্রকাশকেরা সানন্দে প্রকাশ করেছেন।
আর এই কাজগুলোর কোনোটিই কেবল ঢাকাতে হয় না, সারা দেশেই হয়। ফলাফল হলো ২০১৭ সালে দুটি রুপার পদক পেয়েছে সিলেট ও চট্টগ্রামের প্রতিনিধি। এবং সব বিভাগের শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে জাতীয় দলে তাদের প্রতিনিধি রাখতে সক্ষম হয়েছে।
আর এভাবে কাজ করে আমরা টের পেয়েছি আমাদের শিক্ষার্থীদের অসাধ্য আসলে কিছুই নেই। আমাদের ধারাবাহিক উন্নতিই এর প্রমাণ। ২০০৯ সালে প্রথম ব্রোঞ্জ পদক প্রাপ্তিতে আমাদের অবস্থান হলো ৫৮তম। ২০১২ সালে রুপার পদক নিয়ে আমরা এগোলাম চার ধাপ, ২০১৫-তে হলাম ৩৩তম আর এবার ২৬তম।
এই যে গণিত অলিম্পিয়াডে আমাদের অবস্থান কানাডা, জার্মানি বা ভারতের ওপরে, তাতে কি বোঝা যায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তাদের থেকে উন্নত? না, মোটেই নয়। এসব দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষার্থীদের গড় মান আমাদের দেশ থেকে অনেক অনেক উন্নত। কিন্তু গণিত অলিম্পিয়াডের এই সাফল্য দেখিয়ে দিয়েছে, বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীকে সমন্বিত করে সঠিক নির্দেশনা ও সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে পারলেই আমাদের শিক্ষার্থীরা তাদের মেধার পূর্ণ প্রকাশ দেখিয়ে দিতে পারে, যা প্রমাণ করে এই দেশের মেধা কেবল বিশ্বমানের নয়, সেটি আগামী সময়ে বিশ্বকে নাড়িয়ে দিতেও পারে।