তার আগে চাই ব্রডব্যান্ড
মার্ক জাকারবার্গের এই কথার মর্ম একটাই। ইন্টারনেটে সবাইকে যুক্ত করা।
অনেকে ভাবে ইন্টারনেটে যুক্ত হলে কী লাভ? লাভ মনে হয় শুধু ফেসবুকের। সেজন্য ব্যাটা এখন এই সব বলে বেড়াচ্ছে।
আমি একটা সহজ উদাহরণ দেই। ক’দিন আগে আমার ছেলেকে আমার পড়াতে হচ্ছিল। আমি অনেকদিন ত্রিকোণমিতি আইডেনটিটি করিনা। কাজে ট্যানের একটা অঙ্ক আমি কিছুতেই মিলাতে পারলাম না। বাসায় সেদিন ইন্টারনেট ছিল না। পরে প্রথম সুযোগ দোতলার অফিসে গিয়ে এই সার্চটা দিয়েছে। এবং দেখলাম এর সমাধানটা খুবই সহজ।
আমার শুধু মনে হয়েছে যে বাবা আমার মত তার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কিল ভুলে গেছে এবং যে বাবার হাতের কাছে ইন্টারনেট নেই – তিনি কী করেন?
শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা সাধারণভাবে তথ্য – কতোটা দরকারী সেটা আমরা সবাই বুঝি। বুঝি বলেই ইন্টারনেটের প্রাপ্যতাকে আমাদের আইসিটি মন্ত্রী মৌলিক চাহিদা বলেন। আমরাতো বলিই।
আমার একটা ট্যাগ লাইন হল – অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান এবং ব্রডব্যান্ড। আমার কেন জানি মনে হয় শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের আগেই বোধহয় কানেকটিভিটি। কারণ কানেকটিভিটি নিশ্চিত করতে পারলে বাকীগুলো অনেকখানি সহজ হয়ে যায়।
আমি মাত্র ৩৩ বছর আগে স্কুলে পড়েছি। আমাদের সময়ে স্কুলে কোন একটা অঙ্ক না পারলে সেটা পারার জন্য আমাদের কত মেহনত করতে হতো। আর এখন?
আমি যেবার এসএসসি পাস করি, রেজাল্টের দিন ছিলাম ঢাকায়। আমি পড়েছি চট্টগ্রামে, বোর্ড কুমিল্লায়। আমি আমার ফলাফল, তাও সত্য না মিথ্যা সেটা ঠিকমতো বুঝতে পারিনি, জেনেছি রাতের বেলা, মানে প্রকাশের প্রায় ১২-১৩ ঘন্টা পর। এখন কিন্তু ঢাকার শিক্ষার্থীর সঙ্গে সঙ্গে ভুরুঙ্গামারীর শিক্ষার্থীও তার পরীক্ষার ফলাফল জেনে ফেলতে পারে। এটা ঐ কানেকটিভিটিরও ফল।
যারা গবেষণা করে তারা জানে প্রতি হাজার নতুন সংযোগ ৮টি নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করে আর প্রতি ১০ শতাংশ মোবাইল সংযোগ বাড়লে জিডিপি বাড়ে ১%। অনেকের কাছে আমাদের গেল এক দশকের ৬%+ গ্রোথ একটি মিথ মনে হয়। কিন্তু যখন আমরা এর সঙ্গে মোবাইল ফোনের বিকাশ আর মানুষের কর্মস্পৃহাকে যোগ করি তখন সেটা সত্যি মনে হয়। কারণ সেটা সম্ভব।
কানেকটিভিটির লড়াই তাই চিরন্তন। আমাদেরকে অবশ্য এই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে সব সেক্টরে। বিশ্বজুড়ে নানানভাবে সেটা হচ্ছে। যেমন একদল প্রযুক্তিপ্রেমী চেষ্টা করছেন এক্সেস ডিভাইসের দাম কমিয়ে আনার। ভাবা যায়, শুরুতে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন বিকাতো লাখ টাকায়। এখনতো স্মার্টফোন পাওয়া যায় ২-৩ হাজার টাকায়। আর কথা বলার ফোন তো আমাদের রুয়েল ৭২০ টাকায় বিক্রি করে!
দ্বিতীয় একদলের চেষ্টা হচ্ছে কেমন করে এ স্থান থেকে অন্য স্থানে কানেকশন নেওয়া যায় দ্রুত এবং কম টাকায়।
দেশে দেশে সরকারও এই লড়াইয়ে কখনো শামিল হয়। যেমন এই আমাদের দেশে ২০০৫ সালে খালেদা জিয়ার আমলে যে ব্যান্ডউয়িডথদের দাম ছিল মেগাবিট মাত্র ৮৬ হাজার টাকা সেটি শেখ হাসিনার সরকার নামিয়ে এনেছে দুই হাজার টাকায়। দেশে কম্পিউটারেরওপর ট্যাক্সও নাই।
তবে, এই সবই সব নয়্। কারণ এখনো বাংলাদেশের সাড়ে ১১ কোটি মানুষ একদিনের জন্যও ইন্টারনেট ব্যবহার করেনি।
আর যে সাড়ে চার কোটি ব্যবহার করেছে তারাও ইন্টারনেটের সব সুফল পায়নি। অনেকেই কেবল ভাবে ফেসবুকই মনে হয় ইন্টারনেট। কয়েকদিন আগে আমার এক অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলাম –
-ইন্টারনেট ব্যবহার করো?
-না।
-মোবাইল আছে?
-আছে।
-মোবাইল দিয়ে কথা বলার বাইরে কী করো?
–
–
–
–
– অনেক কিছু।
-যেমন?
-গেম খেলি, ফেসবুক চালাই।
দেখতে দেখতে একটা নতুন বৈষম্য সৃৃষ্টি হয়েছে। ইন্টারনেট আছে, ইন্টারনেট নাই। ব্রডব্যান্ডের আলোচনা না হয় নাই করি।
আমরা কেমন করে পাল্টাতে পারি?
১. পলিসি লেবেলে মারপিট করে – সরকার যাতে তার সবটুকু দেয় সেটা আদায় করার চেষ্টা করা, তাকে দিয়ে ইন্টারনেটকে সহজলভ্য করার জন্য সম্ভাব্য সা রিসোর্স কাজে লাগানো, সংসদ সদস্যদের কাছে নিজেদের প্রাণের দাবী তুলো ধরা ইত্যাদি।
২. যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ইন্টারনেট নাই দের পাশে দাড়ানো – এটা একটা বড় কাজ। এই কাজের জন্য সরকারকে দরকার নাই। নিজে নিজেই করা যায়। কাজটা সহজ। এই লেখা যেহেতু তুমি পড়ছো কাজে তুমি আমাদের অন্য লোকেদের, যাদের পাশে দাড়ানো দরকার, চেয়ে আলাদা। আমাদের একটা নতুন সংস্কৃতি দাঁড় করাতে হবে। যেখানে আমরা নতুন জগৎ, নতুন সম্ভাবনার কথা তুলে ধরবো। বাজারে বসে যে আড্ডাটাতে রাজনীতিকে তুলোধুনো করা হয় সেটি প্রতিস্থাপিত হবে জ্ঞানের আলোয়, নতুন সম্ভাবনার কথাতে।
এই যে সামনে একটা বড় ছুটি হবে তোমার, তুমি হয়তো যাবে গ্রামের বাড়িতে। যাবার সময় তোমার ইন্টারনেটওয়ালা ল্যাপটপটি সঙ্গে নিয়ে যাও। না হলে স্মার্টফোনটি। গ্রামে তোমার সমবয়সী কিংবা বড়-ছোট, দেখবে অনেকই খালি “ফেসবুক চালাই”। তাদেরকে দেখাও যে, ফেসবুকই কেবল ইন্টারনেট নয়। এ এক আশ্চর্য হাতিয়ার। তাকে দেখাও বিনামূল্যের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জ্ঞান ভান্ডার উইকিপিডিয়া।
বিশ্বাস করো, আগামী বছর তুমি যখন আমার বাড়ি যাবে তখন তোমার গ্রামের এক আশ্চর্য সুন্দর পরিবর্তন তুমি দেখবে। আর কেও না জানুক, তুমি তো জানবে সেই আশ্চর্য পরিবর্তনের সূচনাটা তোমার হাত দিয়ে হয়েছে।
একবার ভাবো সেই বিশ্বটা কেমন হবে যেখানে আমরা সবাই পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকবো!
সবার জন্য শুভ কামনা।