আমাদের কালের নায়ক : স্যার স্টিফেন উইলিয়াম হকিং
ফিরে যাবো? দীপ্ত-র প্রশ্নভরা চোখের দিকে চেয়ে তপতী বললো – না।
দরজা ঠেলে সাহস করে ভেতরে ঢুকে গেল ওরা দুজন। রুমটা এলোমেলো, ছড়ানো-ছিটানো বই, একটা হোয়াইট বোর্ড! রুমের বাসিন্দাকে দেখা যাচ্ছে না। এদিক ওদিক তাকিয়েও কোন সুবিধা হল না।
প্রথম দর্শনেই তো দেখতে পাওয়ার কথা। হতাশ হয়ে পেছন ফিরে তপতী আর দীপ্ত দুজনই বুজতে পারলো ওরা ভুল ঘরে এসেছে। দরজাজোড়া মেরিলিন মনরোর এক বিরাট ছবি! নিজের ভুল বুঝে ওরা যখন বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো, তখনই শুনতে পেল একটি অদ্ভুত ধাতব কণ্ঠস্বর, স্বাগতম। তোমরা ভুল করোনি!
কণ্ঠস্বর শুনে, ঠিকমতো খুঁজে টেবিলের পেছনে, বোর্ডের সামনে একটি হুইল চেয়ারে বসা বিজ্ঞানীকে দেখতে পেল ওরা। মুখে এক ধরনের হাসি, কী, কেমন চমকে দিলাম।
তপতী আর দীপ্ত দুজনই সামনাসামনি হয়ে পড়েছে এক জীবন্ত কিংবদন্তির!
স্টিফেন উইলিয়াম হকিং!
হকিংকে বলা হয় আইনস্টাইনের পর এই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী। কতটা প্রতিভাবান? তার খোঁজ খবর নিয়েই ওরা এসেছে।
তপতী আর দীপ্ত হেটে তার কাছে যাওয়ার সময় খেয়াল করলো আর দশজন পদার্থবিদের কামরার মতো হকিঙের কামরায় রয়েছে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু বইপত্র, বইয়ের কয়েকটি রেক, দুতিনটে বাড়তি চেয়ার, একটা বোর্ড, বড়সড়ো একটা টেবিল। পড়ার ডেস্কটা অদ্ভুত। দীপ্ত আগে থেকে জানতো এর বৈশিষ্ট্য হলো একবার সেট করে দেওয়া হলে সুইচ টিপে বইয়ের পাতা ওল্টানো যায়। বোর্ডটিতে গণিতের নানান কিছু ছাড়াও বেশ কিছু মজাদার সব মন্তব্য। তবে, তাতে হকিঙের কোনো হাতের লেখা নেই। দেয়ালজুড়ে বিচিত্র সব কাগজপত্র। এর মাঝে সাদা চুলের একজন বিজ্ঞান ব্যক্তিত্বকে ওরা খুঁজে নিতে পারলো অনায়াসে। আইনস্টাইন।
সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের যে আঙিনায় হকিঙের বিচরণ, তাঁর স্রষ্টা হকিংকে ঘিরে রেখেছেন সার্থকভাবেই। ওরা বুঝলো, হকিং আসলে আইনস্টাইনের জগতের মানুষ – নিউটনের কার্যকারণের বেড়াজাল ডিঙিয়ে সম্ভাবনার জগতে তাঁর চলাচল।
এসময় দরজা খুলে ভিতরে আসলো হকিঙের একজন সহকারি। দীপ্ত আর হকিং ওনাকে চেনে। উনি তাদের জন্য এই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ওরা এসে হকিঙের পাশে এমনভাবে বসলো, যাতে হুইল চেয়ারের সঙ্গে লাগানো কম্পিউটার স্ক্রিন পড়তে পারে সহজে। সহকারিটিও এসে পড়লো কাছে।
ওদের ধারণা, আইনস্টাইনের পর সবচেয়ে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ছোটবেলা থেকেই দারুণ প্রতিভাবান। কাজেই শুরুটা তারা হকিঙের ছেলেবেলা দিয়েই করলো।
আর সবারই মতো
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকাল, ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি। অক্সফোর্ড শহরে ওইদিন আলাদা কোনো চমক ছিল না। ১৪ হিলসাইড রোডের ফ্রাঙ্ক হকিং ও তাঁর স্ত্রী ইসাবেলা অবশ্য খুশি ছিলেন অন্য কারণে। ওইদিন ইসাবেলার কোলজুড়ে এসেছে হকিং জুনিয়র। ঝটপট নাম রাখা হয়েছে স্টিফেন-স্টিফেন উইলিয়াম হকিং। সেদিনের আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল কি?
কেন?
দীপ্ত আর তপতী এর বিশেষ তাত্পর্য জানে। কেননা এর ঠিক ঠিক ৩০০ বছর আগে এই দিনে ইতালিতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনাকারী গালিলিও গ্যালিলি। ওরা তাই হকিংকে সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিল। মুচকি হাসলেন স্টিফেন হকিং – ওইদিন আরো দু’শ শিশুর জন্ম হয়েছিল, কমপক্ষে।
স্বভাবের দিক থেকে ছোটবেলা থেকে হকিং খুব দূরন্ত। ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করাটা রীতিমতো অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। হকিং রেডিও খুলে তার ভেতরটা দেখতেন বোঝার জন্য নয়। হকিং আসলে আর সব বাচ্চার মতোই কাজটি করতেন।
স্কুলের শিক্ষকরা তাকে সাধারণের ওপরে স্থান দিতেন। আর দশজনের সঙ্গে তাঁর একটি পার্থক্য সে সময় ছিল, হকিং কেন জানি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত পছন্দ করতেন!
সেন্ট অ্যালবা থেকে অক্সফোর্ডে পড়তে এসে হকিং মোটামুটি জনপ্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন। স্বভাবের কারণে। ছাত্রটি বাচাল ও দুষ্ট। কিন্তু পড়াশোনায় ভালো। কাজেই শিক্ষকরাও তাঁকে পছন্দ করতেন। ইচ্ছে ছিল অনার্স শেষে কেম্ব্রিজে যাবেন।
এ সময় ওরা হকিং সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্পের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে সহকারি তাতে সায়ও দিল। শেষ পরীক্ষায় ভাইবা বোর্ডে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলতে গিয়ে হকিং বললেন – আমি যদি প্রথম শ্রেণী পাই তাহলে কেম্ব্রিজে চলে যাবো। নতুবা কিন্তু এখানেই থাকবো।
ভাবখানা অক্সফোর্ডে থেকে মাস্টারদের অনেক জ্বালাবো! অতএব একটা প্রথম শ্রেণী ও কেম্ব্রিজ।
হকিঙের সঙ্গে আলাপচারিতায় এটুকু আসতেই ওদের প্রায় সারাদিন লেগে গেল। কারণ, হকিং কথা বলেন, খুব ধীরে। এরই মধ্যে একাধিকবার নার্স এসে হকিঙের যত্ন নিয়েছে। এর মধ্যে এলিনা হকিঙের একটা ফোনও এসেছে। সহকারি বললো পরের দিন আসার জন্য।
মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস
হুইল চেয়ারের হকিংকে দেখে যারা জানে না তারা ভাবে তাঁর এই রোগটি বেশি পুরোনো নয়। কাজেই, যখন জানে ১৯৬২ সালে পিএইচডির ছাত্র থাকাকালে তাঁর এই অসুখের কথা হকিং প্রথম জানতে পারেন, তখন নিশ্চয়ই ভীষণ চমকে উঠে সকলে।
কেম্ব্রিজে পিএইচডি কোর্স করাকালে হকিং মাঝে মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। ছুটিতে বাড়িতে আসার পর ডাক্তার পিতা তাঁকে নিয়ে ছুটলেন বিভিন্ন ডাক্তারখানায়। ফলাফল – হকিং আক্রান্ত হয়েছেন মটর নিউরন ডিজিজে, আমেরিকায় এই রোগটির নাম লো গ্রেইরিজ ডিজিজ। স্নায়ুতন্ত্রের এই রোগ ক্রমশ হকিঙের প্রাণশক্তি নিংড়ে নেবে। ডাক্তারদের ভাষ্য মতে, হকিং আর মাত্র দু-আড়াই বছর বাঁচবেন।
আলাপচারিতায় হয়রান হয়ে পড়ায় হকিং একটু বিশ্রাম নিলেন। তপতীরা রুমের চারদিক, বিশেষ করে টেবিলটা, ভালোভাবে লক্ষ করে একটি মজার জিনিষ দেখতে পেল। মনে হল প্রায় পাঁচ দশক ধরে মৃত্যুর সঙ্গে হকিঙের লড়াইয়ের প্রেরণার খোঁজ ওরা পেয়েছে। টেবিলে দুটো বাঁধানো ছবি। একটি ছবিতে দুছেলে ও এক মেয়ের সঙ্গে হকিং দম্পতি। অপর ছবিটিও হকিং দম্পতির। তবে, ভালোভাবে খেয়াল করে ওরা বুঝলো দুটো ছবির দুজন স্ত্রী কিন্তু আলাদা। প্রশ্নসূচক ভঙ্গিতে হকিঙের দিকে তাকাতে দেখল তিনি হাসছেন। ভাবখানা – অল্পক্ষণের মধ্যে জেনে যাবে।
মধুর সেই স্মৃতি
সহকারির কাছে হকিঙের পারিবারিক অ্যালবামে দেখা গেল লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়ানো স্টিফেনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাজনম্র বধুটির মুখে হাসি। হ্যাঁ, বিয়ের আসরে হকিঙের হাতে লাঠিই ছিল। ‘৬২ সালে এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে ভাষাতত্ত্বের ছাত্রী জেনের সঙ্গে লাভ অ্যাট ফাস্ট সাইট হওয়ার আগেই হকিঙের অসুস্থতা ধরা পড়ে। কাজেই উজ্জ্বল স্ফূর্তিবাজ, প্রাণবস্তু হকিংকে জেন দেখেননি কখনো। জেনের ভালোবাসা তাই অসুস্থ হকিংকে ঘিরেই।
কতোটা ভালোবাসা ছিল তাঁদের দুজনের মধ্যে? হকিঙের কাছে জানতে চাইতেই বললেন – বিয়ের কারণে আমি বেঁচে থাকতে, এগিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলাম। জেন আসলেই আমার বেঁচে থাকার প্রথম প্রেরণা।
কাজেই হকিং ফিরলেন তার মূল এরিনায় আপেক্ষিকতা তত্ত্বের আঙ্গিনায়।
ঈশ্বর যখন নরক বানাচ্ছিলেন
১৯১৬ সালে আইনস্টান তাঁর আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব প্রকাশ করেন। ১৯২২ সালে ফ্রিডম্যান আপেক্ষিতার সমীকরণের সমাধান করেন। তাতে দেখা যায় এই দুনিয়া (Universe) ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। নিউটনের স্থির দুনিয়া তত্ত্বের লোকজন এতে আতকে ওঠেন, খোদ আইনস্টাইনও এই সমাধান নাকচ করেন। কিন্তু ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল দুরবিন দিয়ে সত্যটা দেখে ফেলেন – দুনিয়া আসলেই সম্প্রসারিত হচ্ছে! গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর পরস্পর থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যদি তুমি পেছনে যাও তাহলে এক সময় দেখা যাবে এই দুনিয়ায় সবকিছু এক বিন্দুতে ছিল। কোনো এক সন্ত্রাসী ঘটনায় সবাই দিগ্বিদিক হয়ে ছুটে চলেছে। এ থেকে উদ্ভব বিগ ব্যাং তত্ত্বের, যা আজকের কসমোলজির প্রাণ।
বিগ ব্যাং-এর সমস্যা অন্যত্র। দুনিয়ার সবকিছুকে এক জায়গায় জড়ো করলে যা হয়, তাতে বিজ্ঞান একটু অস্বস্তিতে পড়ে। কারণ এক বিন্দুর দুনিয়ার নাম সিংগুলারিটি যাতে জানা সমীকরণগুলোর ভগ্নদশা। ষাটের দশকে রজার পেনরোজের সঙ্গে হকিং দেখালেন তাঁর প্রথম খেল। বললেন, যতোই আপত্তি থাকুক সিংগুলারিটি থেকেই দুনিয়ার শুরু। শুধু তাই নয়, বিগ ব্যাং থেকেই সময়ের শুরু। অর্থাৎ, বিগ ব্যাং-এর আগে বলে কিছু নেই। ক্ষ্যাপা, লোকজনের অনেকে হকিঙের কাছে জানতে চাইতো বিগ ব্যাঙের আগে ঈশ্বর কী করেছিলেন?
মুচকি হেসে হকিং বলতেন, অবিশ্বাসীদের জন্য নরক বানাচ্ছিলেন!
ঈশ্বর কি পাশা খেলে?
সময়ের শুরুর ধারণা জেনে হকিং এগোলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে। এরই মধ্যে জানা হয়েছে, বস্তুজগতে এমন বস্তু সম্ভব, যার থেকে দুনিয়ায় সবচেয়ে দ্রুতযান আলোও বের হতে পারে না – ব্ল্যাকহোল। ব্ল্যাকহোল কি আসলেই ব্ল্যাক? কিছুই কি সেখান থেকে বের হতে পারে না?
হুইল চেয়ারের বিজ্ঞানী ভাবেন। ভাবেন কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের অনিশ্চয়তার তত্ত্ব নিয়ে। পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দুটো কোয়ান্টাম রাশির যুগপৎ নিশ্চয়তা নেই। শূন্যস্থানে এই তত্ত্বের প্রয়োগ এরই মধ্যে বলে ফেলেছে শূন্যস্থান আসলে শূন্য নয়। সেখানে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে কণা ও প্রতিকণা, আবার তা লয়ও পাচ্ছে। হকিং এই ঘটনাকে প্রয়োগ করলেন ব্ল্যাকহোলের আশপাশে এবং আশ্চর্য হয়ে দেখলেন ব্ল্যাকহোল থেকেও বের হয়ে আসছে অবিরল কণাস্রোত।
১৯৭৩ সালে হকিং প্রকাশ করলেন তাঁর ধারণা এবং অচিরেই তা গৃহীত হলো। বিজ্ঞানজগৎ ওই বিকিরণকে অভিহিত করলো হকিঙেরই নামে হকিং রেডিয়েশন।
রাজকীয় বিজ্ঞান সমিতির সভ্য
এই বিশ্বের বিজ্ঞানীদের বড় সম্মানের একটি হলো রয়্যাল সোসাইটির সভ্য হওয়া। নতুন সভ্য হওয়ার কোনো অনুষ্ঠানে তোমাদের আমরা নিতে চাই। দেখবে উপস্থিত সব সভ্যদের সামনে দিয়ে নতুন সভ্যটি এগিয়ে যাবেন মঞ্চের দিকে, সেখানে সভাপতির সামনে রক্ষিত খাতা সই করবেন। টাইম মেশিনে করে এবার আমরা হাজির হবো ১৯৭৪ সালের কোনো একদিন। দেখবে সোসাইটর শত বছরের নিয়ম ভেঙে সভাপতি খাতা হাতে নিয়ে হাজির হয়েছেন এক নতুন সভ্যর সামনে। আর হুইল চেয়ারের সভ্যটি অনেক কষ্টে নিজের নাম স্বাক্ষর করছেন – স্টিফেন উইলিয়াম হকিং।
এরপর থেকে আশির দশকের শুরু পর্যন্ত হকিং পেয়েছেন ছয়টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার, যার মধ্যে রয়েছে তত্ত্বীয় পদার্থবিদদের সর্বোচ্চ সম্মান অ্যালবার্ট আইনস্টাইন পদক। ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে, তাঁর পুরোনো অক্সফোর্ডসহ। রানী এলিজাবেথ তাঁর নাম ঘোষণা করেছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একজন কমান্ডার’ (Commander of the British Empire) হিসেবে।
আর ১৯৭৯ সালে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হকিংকে বানালো গণিতের লুকাসিয়ান প্রফেসর, এক সময় যে পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। ২০০৯ সালে আবারএ এই পদে আসীন হোন তিনি। সর্বশেষ এখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রের গবেষণা পরিচালক।
সবকিছু এক রকম নয়
মধ্য-আশিতে এক অপারেশনের ফলে তকিং সম্পূর্ণভাবে বাকশক্তি হারান। আগে থেকেই তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। ছোট ছেলে টিমোথির বন্ধুর বাবা ডেভিড মেসন হকিংকে একটি কম্পিউটার বানিয়ে দেন, যা তাঁর হুইল চেয়ারের হাতলে ফিট করা (এটিরই উন্নত সংস্করণটি দেখছে তপতী ও দীপ্ত)। ক্যালিফোর্নিয়ার এক কম্পিউটারবিদ তৈরি করেছেন একটি বিশেষ সফটওয়্যার। শুধু আঙুল নাড়িয়ে হকিং কম্পিউটারের পর্দায় ফুটে ওঠা শব্দ নির্বাচন করেন। এভাবে তৈরি করেন বাক্য। ভয়েস সিনথেসাইজারের মাধ্যমে ওই বাক্য স্পিকার থেকে বের হয়ে আসে। এভাবে হকিং কথা বলছে তপতীদের সঙ্গে এবং এভাবেই লিখেছেন এযাবত্কাল প্রকাশিত সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বিখ্যাত বিজ্ঞানের বই এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম।
১৯৮৮ সালে স্টিফেন হকিঙের A Brief History of Time- From the Big Bang to Black Holes প্রকাশিত হয়। বিশ্বজুড়ে আজ পর্যন্ত এক কোটি কপিরও বেশি বিক্রি হয়েছে। এখনো প্রতি মাসে সারা বিশ্বে এর প্রায় ৫ হাজার কপি বিক্রি হয়। প্রকাশের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমেরিকায় ৪০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। ফলে দুটো উল্টো ছাপানো ছবিসহ ওই মার্কিন সংস্করণ সংশোধনের আগেই বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়! বিজ্ঞানের দুরূহতম বিষয়ের এমন সহজবোধ্য বই এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি বলে ধারণা করা হয়। যদিও জটিল বিষয়বস্তুর কারণে অনেকেই বেশি দূর এগোতে পারেন না। এই বইয়ের শেষে হকিং তিনজন বিজ্ঞানী সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। গ্যালিলিও, নিউটন ও আইনস্টাইন। দুর্জনেরা বলেন আগামী দিনের ব্রিফ হিস্ট্রিতে থাকবে চারটি জীবনী। চতুর্থটি হবে হকিঙের।
জেন আর হকিং– নয় আর দুজনার
বই লেখা শুরু করার কিছু আগে ডেভিড মেসনের স্ত্রী এলিনা মেসন হকিঙের নার্সিঙের দয়িত্ব নেন। এলিনার ভরসায় হকিঙের সঙ্গে বিদেশ যাওয়া বাদ দেন জেন। এর মধ্যে তিন ছেলেমেয়ের দায়িত্বও তাকে পালন করতে হচ্ছে। সর্বোপরি হকিঙের ঈশ্বরবিশ্বাসও জেনকে টলিয়ে দিছে। অবশেষে জেন ও হকিং পরস্পরের জীবন থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৯১ সালে হকিং উঠে আসেন এলিনার ফ্ল্যাটে। জেন ও হকিং তাদের বিচ্ছেদ সম্পর্কে কখনোই কিছু বলেন না।
ঈশ্বরের মন
হকিঙের কাছে ওরা জানতে চাইল বিজ্ঞানের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী? হকিঙ বললেন – ঈশ্বরের মন বুঝতে পারা।
কীভাবে? এই বস্তুজগতের নিয়মাবলীর সাধারণ, সহজ ও সরল সূত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে। এই তত্ত্ব হবে সব পেয়েছির তত্ত্ব। এই যে হকিং আজকাল বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন কাল্পনিক সময়, ওয়ার্মহোল প্রভৃতি নিয়ে— এসব কিছুর লক্ষ্যও কিন্তু এক। নিছক কোনো বাগুজে সমীকরণ নয়, এ হচ্ছে সব পেয়েছির চাবি। এর সাহায্যে মানুষ যেমন পারবে বস্তুজগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মৌলিক কণার খবর জানতে, তেমনি সক্ষম হবে দূর মহাকাশের বিশালাকার কৃষ্ণবিবরের আচরণ ব্যাখ্যা করতে।
বস্তুজগতে মোট চার ধরনের বল ও তাদের মিথষ্ক্রিয়া আমরা অনুভব করছি প্রতিনিয়ত। মহাকার্ষ, বিদ্যুৎ- চৌম্বক, ক্ষীণ ও সবল পারমাণবিক বল। প্রকৃতি জগতের এই চারটি বলকে একত্রিত করে একটি সমন্বিত তত্ত্ব দাঁড় করানোই হলো এখনকার তত্ত্বীয় পদার্থবিদদের চ্যালেঞ্জ। ইতিমধ্যে সবল, ক্ষীণ ও তড়িৎ- চৌম্বকত্বের এককত্ব প্রমাণিত। বাকি রয়েছে মহাকর্ষ। মহাকর্ষ সম্পর্কে সবেচেয়ে সুন্দর তত্ত্বটি হলো আইনস্টাইনের সাধারণ তত্ত্ব। আর অন্যদিকে মাইক্রোওয়ার্ল্ডের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতের কণারা মেনে চলে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। কাজেই মেলাতে হবে এই দুই তত্ত্বকে— পেতে হবে কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির সন্ধান।
পরিণয়ের আগে পরিচয়ের পালাটি করিয়ে দিয়েছেন হকিং। ব্ল্যাকহোলের আচরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মহাকাশে সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন কোয়ান্টাম তত্ত্বের।
বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা এই জোড় মেলানোর কাজে ব্যস্ত। কেম্ব্রিজের অসাধারণ প্রতিভাবান উজ্জ্বল চোখের অধিকারী, তপতীদের পাশে বসা স্টিফেন উইলিয়াম হকিংও এই দলে রয়েছেন। যদিও তাঁর বয়স মাত্র ৭২ বছর। অন্য বিজ্ঞানীদের মতো হকিংও আশাবাদী। কেউ না কেউ এই খোঁজ পেয়ে যাবেন দুই-এক দশকের মধ্যে।
হকিং কি নোবেল পুরস্কার পাবেন
না মনে হয়। স্টিফেন হকিং নোবেল পুরস্কার পাবেন না। কারণ? কারণ আলফ্রেড নোবেল নিজে। দুর্জনেরা বলেন, নোবেল তাঁর উইলে পদার্থ বিজ্ঞানে পুরস্কারের ক্ষেত্রে পরীক্ষাগারে প্রমাণিত হতে হবে- এমন বাক্য যোগ করেছিলেন জ্যোতির্বিজনীদের পুরস্কার থেকে দূরে রাখার জন্যই! কেননা, নোবেল বিশ্বাস করতেন, শেষ বয়সে তাঁর প্রতি তাঁর স্ত্রীর অনীহার কারণ এক যুবক জ্যোতির্বিজ্ঞানী। এ জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা। এই খাঁড়াতেই তত্ত্বীয় পদার্থ বিজ্ঞানীদেরও সমস্যা। কখনো কখনো এমন সময় আসে পুরস্কারপ্রাপ্তি ব্যক্তির চেয়ে পুরস্কারকেই মহিমান্বিত করে। হয়তো সে রকম একটা মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছে নোবেল পুরস্কার যেদিন স্টিফেন উইলিয়াম হকিং ভূষিত হবেন নোবেল পুরস্কারে।
আমাদেরই লোক
সহকারির সঙ্গে কথা বলে, পারিবারিক এলবাম দেখে তপতীদের তখন অনেক কিছু জানা হয়েছে। হকিঙ আড্ডা দিতে ভালবাসেন। যখন পারতেন তখণ কনসার্ট গিয়ে হুইর চেযারেই মেতে উঠতেন আনন্দে। ছবি ঘেটে একটি ছবিতে আমাদের বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামকে দেখে উচ্ছসিত হয়ে পড়ল দীপ্ত। হকিঙকে যকন বলা হল ওরা জেএনইসলামের দেশের লোক তখনই চোখদুটো আরোকিত হয়ে উঠলো। জানা গেল আশির দশকে জামাল নজরুল ইসলাম আর হকিং ছিলেন পারিবারিক এবং গবেষণা বন্ধু।
এই ক’দিনে ওদের সঙ্গে খাতির হয়েছে হকিঙের। কাজে সাহস করে জানতে চাইল – নোরমা জিন ওরফে মেরিলিন মনরো কেন হকিঙের দেয়ালে?
হ্যাঁ, এদের মতোই হকিঙের প্রিয় নায়িকা মেরিলিন মনরো। হকিং রীতিমতো তাঁর ফ্যান।
জ্যামিতিক চিত্রের মাধ্যমে তিনি নিজের চিন্তাকে বিকশিত করেন। ছুটে যাচ্ছেন দেশ থেকে দেশে, লোকেদের শোনান বিজ্ঞানের কথা। বলেন, বিজ্ঞান আর গবেষণাকে ভালোবাসতে, যাতে মানবজাতি এগোতে পারে।
কেবল বক্তৃতা নয়, লিখে ফেলেছেন বিজ্ঞানকে সহজ করে বলা বই। এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইমের কথা আগেই শুনেছে ওরা। এর বাইরে ইউনিভার্স ইন এ নাটশেল, ব্রিফার হিস্টরি অব টাইম, ব্ল্যাকহোল অ্যান্ড বেবি ইউনিভার্স, গড ক্রিয়েটেড দ্যা ইন্টিজার, দ্যা গ্র্যান্ড ডিজাইন প্রভৃতি বই। মেয়ে লুসির সঙ্গেলিখেছেন, জর্জ’স সিক্রেট কি টু ইউনিভার্স, যেখানে হ্যারি পটারের স্টাইলে বিজ্ঞানের জটিল বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
হকিং অভিনয় করেছেন স্টারট্রেকের ডিসেন্ট এপিসোডে। যারা তোমরা পিঙ্ক ফ্লয়েডের ডিভিশন বেল অ্যালবামের কিপ টকিং গানটা শুনেছে, তারা সবাই কিন্তু হকিংয়ের সিনথেসাইজড শব্দও শুনেছ! সেখানে তাঁর সিনথেসাইজড ভয়েস ব্যবহার করা হয়েছে।
হকিং যদি বিজ্ঞানী নাও হতেন, তাহলেও তিনি বিখ্যাত হতেন। কারণ ৫০ বছর ধরে এএলএস রোগে আক্রান্ত কেউ বেঁচে আছেন, এমন কোনো রেকর্ড নেই!
তবে আমাদের সৌভাগ্য যে রোগ তাঁর বাক ও চলত্শক্তি কেড়ে নিলেও তাঁর মেধা, মনন, দৃষ্টিকে কেড়ে নিতে পারেনি।
কাজে তিনি স্বপ্ন দেখেন এবং স্বপ্ন দেখাতে ভালবাসেন।
[তপতী ও দীপ্তর সাক্ষাৎকার নেওয়ার বিষয়টি কাল্পনিক]
[কিশোর আলো নভেম্বর সংখ্যাতে প্রকাশিত]
One Reply to “আমাদের কালের নায়ক : স্যার স্টিফেন উইলিয়াম হকিং”