আপনাকে অভিবাদন স্যার হরিপদ কাপালী
সেই সময় আমরা প্রায়ই ভুলে যেতাম, বাঙালির যে হাজার জাতের ধান, কোনটি ষাইট্টা, কোনটি চিকন, কোনটি সুগন্ধী, কোনটি মোটা চালের ভাত দেয়, তার সবই কিন্তু মাঠেই সৃষ্টি হয়েছে। কৃষক-বিজ্ঞানীদের হাতে। ব্রি ও ইরির দাপটে আমরা এই ঐতিহ্যের কথা ভুলেই যাচ্ছিলাম। ভুলেই বসেছিলাম আমাদের কৃষকেরাই বড় কৃষিবিজ্ঞানী আর মাঠগুলোই তাঁদের পরীক্ষাগার। ৬ জুলাই কক্সবাজার বিমানবন্দরে বসে বসে এই কথাগুলো ভাবছিলাম। ওখানে বসেই জেনেছি ভোররাতে চলে গেছেন ৯৫ বছর বয়সী ঝিনাইদহ জেলার কৃষক বিজ্ঞানী হরিপদ কাপালী। আর হরিপদ কাপালীই আমাদের আবার ফরিয়ে নিয়ে গেছেন মাঠের বিজ্ঞানীদের কাছে। হরিপদ উচ্চফলনশীল হরিধানের আবিষ্কারক।
আজ থেকে প্রায় দেড় দশক আগে, হরিপদ তাঁর ধানখেতে একটি গোছাকে আলাদা করেন। এটির ছড়াতে ধানের সংখ্যা বেশি মনে হলো, গাছটিও পুরুষ্টু। এরপর তিনি তা-ই করলেন, যা তাঁর পূর্বসূরি বাংলার কৃষক-বিজ্ঞানীরা যুগ যুগ ধরে করেছেন। ওই গোছাকে তিনি আলাদা করে লালন-পালন করলেন। পরের বছর সেই গোছার ধান দিয়ে একটুখানি জায়গায় বীজতলা করলেন। আর সেই চারা লাগালেন খানিক জায়গায়। ফলনের পর দেখলেন তার জমিতে যে বিআর-১১ ধানের চাষ করেন তার চেয়ে এর ফলন বেশি। আশপাশে আলাপ-আলোচনা করলেও ব্যাপারটা কেউ বেশি আমল দিল না। কিন্তু হরিপদ ভাবলেন, পরেরবার তাঁর জমিতে কেবল নতুন ওই ধানের চাষই করবেন। করলেন। আর পেয়ে গেলেন বিআর-১১ কিংবা স্বর্ণার চেয়ে উচ্চফলনশীল ধান। বিঘাপ্রতি বিআর-১১-এর ফলন ১৮ থেকে সর্বোচ্চ ২০ মণ। কিন্তু তাঁর নতুন ধানের ফলন ছাড়িয়ে গেল ২২ মণকেও। সারও লাগল কম।
সম্পূর্ণ ব্যাপারটিকে আমি যতো সহজে লিখলাম কাজটা ঠিক ততোটা সহজ ছিল না। প্রথমত মাঠে ধানের ছড়াকে আলাদা করার জন্য বিশেষ পর্যবেক্ষণশক্তি লাগে। সেটি সবার থাকে না, কেবল বিজ্ঞানীদের থাকে। হরিপদ এরপর প্রথম নিজের পর্যবেক্ষণকে একটি তত্ত্বে খাড়া করার চেষ্টা করলেন। সেটি করার জন্য তার বীজতলা আর ছোট্ট জায়গায় আবাদের পরীক্ষা। সেটা পাস করার পর নিজের জমিতে চাষ। আর তাতেই তার নতুন জাতের ধানটি আলাদা হয়ে পড়ে।
হরিপদ’র জমির নতুন জাতের ধান নজর কাড়ল আশপাশের এবং তাদের মাধ্যমে দূরদূরান্তের কৃষকদের। অনেকেই এলেন নতুন ধানের বীজ নিতে। হরিপদর কিন্তু মনেই হয়নি এই ধানের বীজ দিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব! তিনি পরম মমতায় অন্যদের হাতে তুলে দিলেন বীজ। সঙ্গে অনুরোধ, ভালো লাগলে অন্যকেও দেবেন। এভাবে ঝিনাইদহ থেকে আশপাশের জেলাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ল ‘হরির দান’। তত দিনে ‘হরির ধান’ হয়ে এই ধানের নামকরণ হয়ে গেছে ‘হরিধান’।
২০০৫ সালে প্রথম আলো পত্রিকায় আমি প্রথম হরিপদ কাপালী আর হরিধানের কথা জানতে পারি। পত্রিকা পড়েই বুঝতে পারি, আমরা এক নতুন আবিষ্কারের সামনে। ঠিক করি, যশোর গণিত উৎসবে হরিপদ কাপালীকে আমরা সম্মানিত করব, সংবর্ধিত করব। খবর দেওয়া হলো প্রথম আলোর প্রতিবেদক আজাদ রহমানকে। আর জানালাম জিনবিজ্ঞানী, ধান গবেষক আবেদ চৌধুরীকে। গণিত অলিম্পিয়াডের মঞ্চকে আলোকিত করে হরিপদ বললেন তাঁর ধানের কথা। হাজার খানেক কচি মুখের সামনে তিনি তুলে ধরলেন প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের আপ্তবাক্য: চোখ-কান খোলা রাখো। প্রকৃতিই তোমাকে তোমার সমস্যার সমাধান তুলে দেবে। গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির পক্ষ থেকে হরিপদ কাপালীর হাতে ফুল দিয়ে বরণ করেন আবেদ চৌধুরী। মঞ্চে আর মঞ্চের সামনে হাজার খানেক লোক আমরা দাঁড়িয়ে থাকলাম হরিপদ কাপালীর সম্মানে।
সেই অনুষ্ঠানেই আমার প্রথম হরিপদর সঙ্গে কথা। ফিরে এসে বিজ্ঞান প্রজন্ম পাতা থেকে ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ নবী ও জাবেদ সুলতানকে পাঠিয়ে দিই হরিপদ কাপালীর বাড়িতে। সারা দিন কাটিয়ে তারা ফিরে আসে। বিজ্ঞান প্রজন্ম পাতার পুরোটাই আমরা নিবেদন করি কৃষক-বিজ্ঞানী হরিপদ কাপালীর এক দিনের বর্ণনায়।
এরই মধ্যে আমরা কানাঘুষা শুনতে পাই। অনেকেই বলতে থাকেন, হরিধান আসলেই বিআর-১১ বা স্বর্ণারই সামান্য হেরফের, মোটেই নতুন জাত নয়। দ্রুত ব্যাপারটা জানালাম আবেদ স্যারকে। কয়েক দিন পর স্যার জানালেন, স্বর্ণা আর হরিধানের জিনগত বিশ্লেষণ করতে রাজি হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেবা ইসলাম সেরাজ। ১০ কেজি স্বর্ণা আর ১০ কেজি হরিধান জোগাড় করে আনা হলো। পাঠিয়ে দেওয়া হলো রাউজান-১ আর রাউজান-২ কোড নাম দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে। কোডিং করার ব্যাপারটা আমার মাথাতে ছিল না। কিন্তু আবেদ স্যার আমাকে বললেন গবেষকদের কোনটি কোন ধান বলার দরকার নেই। আমার মাায় কেবল আমার নিজের উপজেলার নামই আসলো। কাজে আমি তাৎক্ষণিকভাবে দুইধানের কোড দিয়ে দিলাম রাউজান-১ আর রাউজান-২।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে অধ্যাপক জেবা ইসলাম সেরাজের তত্ত্বাবধানে রোকাইয়া বেগম ও অন্যরা গবেষণা করে বের করেন হরিধান আসলেই একটি নতুন জাতের ধান। মোটেই বিআর-১১ নয়। গবেষণার ফলাফলে জানাগেল মাঠেই বদলে গেছে বিআর-১১। কয়েক প্রজন্মে বদলে যাওয়া ধানের সঙ্গে অন্য কোন ধানের প্রাকৃতিক সংকরায়নের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে হরিধানের। গবেষণার ফলাফল ছাপা হলো আন্তর্জাতিক জার্নালে। অবসান হলো বিতর্কের।
হরিধান আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে আমাদের কৃষককুলের ঐতিহ্যের কথা। হাজার জাতের ধানের সৃষ্টি আমাদের এই কৃষকদের হাতে। আর গণিত অলিম্পিয়াডের মঞ্চে হরিপদ কাপালী যা বলেছিলেন সেটাই মূল কথা। প্রকৃতি প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জাতের সৃষ্টি করে। এগুলোতে প্রকৃতি তার সন্তানদের জন্য পর্যাপ্ত রসদ দিয়ে দেন। ইরি-ব্রি যুগের আগে এরকম নতুন জাতগুলো মাঠের নানান পরীক্ষাতে টিকে যেত, কৃষকের হাতে। ষাটের দশক থেকে পরীক্ষাগারের ব্যাপারটা আমাদেরকে সরিয়ে আনে এখান থেকে এবং ব্যাপারটা হয়ে উঠে উল্টোমুখী। মানে ল্যাবরেটরী থেকে মাঠে। ফলে প্রকৃতির নিজের উদ্ভাবনটা আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। হরিধানের আবিস্কার প্রকৃত পক্ষে বিজ্ঞানীদের সামনে প্রকৃতিকেই ল্যাবরেটরি হিসাবে পুনরায় হাজির করেছে। এই ধারাতেই এখন আমাদের দরকার হরিপদ কাপালীদের সঙ্গে ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীদের মিলন ঘটিয়ে দেওয়ার। যে উচ্চফলনশীল বন্যা-খরারোধী ‘জাদুধানের’ খোঁজ করছে মানবজাতি, সেটি হয়তো বিকশিত হচ্ছে কোনো এক হরিপদ কাপালীর ঘরের পেছনের বীজতলায়। তাঁকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে নিয়ে আসতে হবে সামনে। দিতে হবে স্বীকৃতি। মাঠের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে দিতে হবে তার প্রাপ্য সম্মান।
আগামী দিনগুলোতে কোনো দেশই আর খাদ্যশস্য রপ্তানিতে আগ্রহ দেখাবে না। এই বদ্বীপের মানুষকে তাই খুঁজে ফিরতে হবে হরিপদ কাপালীদের। কারণ, তাঁরাই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার নতুন প্রেরণা সৃষ্টি করেন, প্রতিনিয়ত!
নতুন করে মাঠের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আর নজর ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য হে হরিপদ কাপালী, আপনাকে জানাই আমাদের কৃতজ্ঞতা। ৯৫ বছরের নশ্বর দেহ আপনি ছেড়ে গেছেন বটে, কিন্তু যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন আপনার ধানের মধ্যে, কৃষকের মাঠে, বিজ্ঞানীর পরীক্ষাগারে।
৬ জুলাই আপনার দেহাবসানের খবর পাওয়ার পর থেকেই আপনাকে ‘স্যার’ সম্ভাষণ করব বলে ঠিক করেছি বাকি জীবন।
আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন, স্যার হরিপদ কাপালী।