হ্যাপিনেস ইজ দ্যা প্রবলেম
যারা আমার পড়ো পড়ো পড়ো পড়েছে তারা জানে বুয়েটের আহসানউল্লাহ হলে আমি থাকতাম। গেট দিয়ে ঢোকার পর হাতের ডানে প্রথমে গেস্ট রুম, তারপর ১২০ এবং এরপরই ১১৯ নম্বর কক্ষ। ওখানে স্থায়ী বাসিন্দা আমি আর মেটালার্জির সেলিম। তৃতীয় বেডটা খালি রাখা হতো কায়দা করে। আমাদের রুমের শেষ মাথায়, ডাইনিং আর অফিসের আগের ১১৩ বা ১১৪ নম্বর রুমে থাকতো হাফিজ রশীদ ঢালী। কেমিকেলের এবং নেতা। খুবই মন খোলা মানুষ। হলে প্রায়শ দরজা গলায় গান গাইতো। একটাই গান – সবাই তো সুখী হতে চায়, কেউ হয় কেউ হয় না। ঐটিই তার ট্রেডমার্ক। দূর থেকে শুনেই আমরা বুঝতাম ঢালী যাচ্ছে বা আসছে।
আমি মাঝে মধ্যে খালার বাড়ি থেকে টু-ইন ওয়ান নিয়ে আসতাম। সেখানে আমরা রবীন্দ্রনাথের গীতিকাব্য শুনতাম যার একটাতে আছে ঐ গান টা – তারা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না। মানে হলো আমরা সবাই হয়তো সুখের সন্ধানেই সময় কাটাতে ভালবাসতাম।
পরে যখন আমি আমার কর্মজীবনে বুয়েটের তৎকালীন কম্পিউটার সেন্টারে কাজ করেছি তখন আমার পরিচালকদের একজন ছিলেন প্রফেসর আলী মুর্ত্তাজা স্যার। প্রফেসর আলী মুর্ত্তাজা স্যার শহীদ আসাদের ভগ্নিপতি। সে হিসেবে স্যারের প্রতি আমার আলাদা ভালবাসা ছিল। কারণ ছাত্র জীবনে আমি সেই দলের রাজনীতি করতাম, শহীদ আসাদ যে দলের ছিলেন। এবং কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকার সময় আসাদের বাড়ি, শিবপুর ছিল আমার এলাকা। এরশাদের আমলে সেখানে কর্মীসভা করতে যেতাম। পুলিশের তাড়াও খেতাম। স্যারের যে জিনিষটা আমার বেশি ভাল লাগতো সেটি হলো ‘দেখে নেওয়া’ পদ্ধতি। এটি অন্য প্রসঙ্গে আর একদিন বলা যাবে। স্যার জয়েন করার কিছুদিন পর আমার কাছে জানতে চাইলেন – কি মিয়া, টাকা পয়সাতো ভালই কামাচ্ছো। চলে তো?
আমি বললাম – স্যার চলে। তবে, আর একটু বেশি হলে ভাল হতো আর কি।
স্যার আমাকে কনসাল্টেন্সির কাজ বাড়িয়ে দিলেন। কয়েক মাস পর আবার একই প্রশ্ন আর আমার একই উত্তর। স্যার আবারও আমার কাজ বাড়িয়ে দিলেন। আমি সকালে অফিসে যাই, রাত ১০টায় অফিস থেকে বের হই। দরকার হলে অফিসেই থেকে যাই। আগে অনেক অনুষ্ঠানে যেতাম, কিন্তু সেগুলো বাদ দিলাম। এমনকী যে বইমেলাতে আমি স্টল খুলতে আর বন্ধ করতে যেতাম সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। নিয়ম করে আত্মীয় স্বজনের বাসায় যেতাম সেটাও বাদ।
তারপর স্যার একদিন আমাকে ডাকলেন। একই প্রশ্ন।
আমি উত্তর দেই না। স্যার তখন বললেন – “বুঝলা মুনির, এটা একটা নেভার এন্ডিং গেম। তুমি যতো পাবা, ততোই পেতে চাইবা। ১০ হাজার হলে ভাববা ১৫ হাজারে ভাল। সেটা হলে চাহিদা হবে ২০ হাজার। এভাবে তোমার ডিমান্ড বাড়তে থাকবে। এতে তুমি কখনো সুখ পাবা না। কিন্তু তুমি যা পাও সেটাতেই যদি সন্তুষ্ট থাকো তাহলেই তুমি ভাল থাকতে পারবা। যে কাজ করছো সেটা যদি আনন্দের সঙ্গে করো তাহলে দেখবা টাকা তোমার পেছনে ঘুরবে। তোমাকে টাকার পেছনে ঘুরতে হবে না”। কলাবাগানের ছাদকোটায় সেদিন রাতে আমি অনেক ভেবেছি। তারপরই জীবনের সবচেয়ে সহজ সিদ্ধান্তটা নেই। টাকার পেছনে দৌড়াবো না। এরপরই আমার জীবনটা অনেক সহজ হয়ে যায়।
কিন্তু স্যারও তো বলার সময় সুখের কথাই বলেছেন। সেটা কী?
এটি চিরন্তন প্রশ্ন। উত্তরটাও মনে হয় অনেকেই জানে।
আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে হিমালয়ের পাদদেশে একজন রাজা ঠিক করলেন রাজপুত্রকে তিনি দুনিয়ার কোন খারাপ জিনিষের মুখোমুখি হতে দেবেন না। তিনি প্রাসাদের দেওয়ালগুলো উঁচু করলেন। আর রাজপুত্রের জন্য শিক্ষকের ব্যবস্থা করলেন। দুনিয়াদারীর কোন কিছু না জেনেই রাজপুত্র বড় হলেন। কিন্তু তার মনে শান্তি নেই। কেমনে কেমনে একদিন রাজপুত্র প্রাসাদের বাইরে বের হলেন আর সারাদিন ধরে মানুষের দু:খ কষ্ট সবই দেখে ফেললেন। বুঝলেন দুনিয়ার এই দিকটা তিনি দেখেননি। এখানেই মনে হয় সুখ। কাজে একদিন রাতের অন্ধকারে রাজপুত্র পালালেন। তারপর তিনি সাধারণ গরীবী হালে দীর্ঘদিন কাটালেন। কিন্তু দিনশেষে আবিস্কার করলেন ওতেও শান্তি নেই। তারপর তিনি সাধনায় বসলেন একটি গাছের নিচে। হ্যা, আমি গৌতম বুদ্ধের কথা বলছি। তিনি শেষ পর্যন্ত বললেন একটা অদ্ভুত কথা – ধনীরা সুখে নেই কারণ তাদের ধন আছে, গরীবরা সুখে নেই কারণ তারা দরিদ্র! মানে যার যা নেই সেটার জন্য মনে সুখে নেই!
আমি বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত ধনী লোকের কথা জানি। ৭০-এর দশকে তিনি লন্ডনে কয়েক কোটি টাকার বাড়ি কিনে সে দেশের সংবাদপত্রে নিউজ হয়েছেন। কিন্তু বেচারা। কিছুই খেতে পারতেন না। কেবল টমেটা ভর্তা দিয়ে দুমুঠো ভাত খেতেন দুই বেলাতে! শান্তি কই। সুখ কই?
তাহলে সুখ কই? সুখের সন্ধানে দুনিয়া চষে বেড়িয়ে কী লাভ? যদি শেষ পর্যন্ত সুখ পাওয়া না যায়? আমরা ভাবি জীবনে সমস্যা না থাকাটাই হয়তো সুখ। কিন্তু আসলে কী তাই?
প্রাথমিকে একটা গল্প পড়ানো হতো ‘সুখী মানুষের জামা’। এক রাজা অসুস্থ। অনেক ভেবেচিন্তে রাজবদ্যি বললেন – রাজাকে সেরে তোলার জন্য একজন সুখী মানুষের জামা দরকার। সেটা পড়লেই তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন। ব্যাস, পাইক পেয়াদারা বের হয়ে পড়লো সুখী মানুষের সন্ধানে। রাস্তাঘাটে হাসিখুশী লোক দেখলেই তাদের ফলো করে, পেছন পেছন যায় এবং শেষ পর্যন্ত আবিস্কার করে যে ধনী সে আরও ধনের জন্য লালায়িত। যে গরীব সে টাকার অভাবে সুখী নয়। স্বাস্থ্যবান লোক সিক্স প্যাকের পেছেন দৌড়াচ্ছে। যাকে জিজ্ঞাষা করে সেই নিজেকে সুখী বলে না।
চারদিকে ঘোরাঘুরি করে হতাশ দুই পেয়াদা রাতের বেলায় একটা ভাঙ্গা ঘরের পাশে রেস্ট নিতে গেল। গভীর রাতে তারা শুনতে পেল ভিতরের লোকটি গান গায় এবং বেশ ফূর্তিতে আছে। তার স্বগতোক্তি শুনে মনে হলো – ব্যাটা সুখী। দুই পেয়াদা তখন দরজা নক করে বাড়িতে ঢুকে পড়লো। একটা তক্তপোষের ওপর ঐ লোক বসে বসে তাদের সব প্রশ্নের জবাব দিল। পেয়াদার শেষ প্রশ্ন – আপনি কি সুখী?
‘হ্যা। আমি জগতের সুখী লোক। সুখী দ্যা গ্রেট।“
দুই পেয়াদার মনে সাহস ফিরে এল। তারা বুঝলো রাজামশাইকে বাঁচানো যাবে। তখন তারা বললো – আপনার একটি জামা আমাদের দেন। আমরা সেটি নিয়ে যাবো। রাজবদ্যি বলেছে – সুখী মানুষের জামা পড়লেই রাজা সেরে যাবেন।
“জামা!!!’ লোকটি অবাক হয়ে বললো – ‘আমার তো কোনো জামা নেই!!!’
“সে কি। আপনার কোনো জামা নেই”।
‘না। আমার কোনো জামা নেই”। সুখী লোকটি বললো – সেজন্যইতো আমি সুখী!!!
মেসেজ ক্লিয়ার। যার হারানোর কিছু নেই,জয় করার জন্য তার আছে সারা বিশ্ব।
যেভাবে মানুষ এখন সুখের পেছেন দৌঁড়াচ্ছে, তাই দেখে আমার মনে হয় এদের কারও কপালে সুখ নামক সোনার হরিণ ধরা পড়বে না। কারণ হ্যাপিনেস ইজ দি প্রবলেম।
এসএসসিতে আমাদের একটা কবিতা পড়তে হতো – হ্যাপি দ্যা ম্যান। আলোকজান্ডার পোপের লেখা। আমার মনে হয় এটা এখন সবার বার বার পড়া দরকার।
Happy the man, whose wish and care
A few paternal acres bound,
Content to breathe his native air,
In his own ground.
Whose heards with milk, whose fields with bread,
Whose flocks supply him with attire,
Whose trees in summer yield him shade,
In winter fire.
Blest! who can unconcern’dly find
Hours, days, and years slide soft away,
In health of body, peace of mind,
Quiet by day,
Sound sleep by night; study and ease
Together mix’d; sweet recreation,
And innocence, which most does please,
With meditation.
Thus let me live, unseen, unknown;
Thus unlamented let me die;
Steal from the world, and not a stone
Tell where I lye.
যারা সুখের সন্ধানে আছেন, তারা সুখী হোন।
One Reply to “হ্যাপিনেস ইজ দ্যা প্রবলেম”
Leave a Reply Cancel reply
You must be logged in to post a comment.
স্যার , আপনার কি “পড় পড় পড়” এর ২য় খন্ড লেখার পরিকল্পনা আছে?