গুগল, ফেসবুক ও আমাজন কী করে হবে?
গত ১ জুলাই গুলশান হামলার পর থেকে ঢাকা শহরের দুই সিটি করপোরেশন হঠাৎ করে আবিষ্কার করেছে, শহরের বিভিন্ন স্থানে উদ্যোক্তারা নানা কিছু করছেন। এমনকি গুলশান-বারিধারার আবাসিক এলাকাতেও রেস্তোরাঁ, ব্যায়ামাগার ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। দুই সিটি করপোরেশন আবাসিক এলাকা থেকে ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠানকে খেদানোর চিন্তা শেষ করে এখন ভাঙচুর শুরু করে দিয়েছে। ভাবছে না, ১৯৫০ সালে ধানমন্ডি এলাকা ডিজাইন করার সময় কোনো পাগলও ভাবেনি মাত্র ৬০ বছর পরে ঢাকায় দেড় কোটি মানুষ থাকবে। তাদের অনেক চাহিদা থাকবে, যেগুলো ট্র্যাডিশনাল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মেটাতে পারবে না। তারা পারবে না বলেই অনেকে নেবেন নতুন নতুন উদ্যোগ। কারণ, প্রয়োজনই উদ্ভাবনের শর্ত। সংবাদমাধ্যমের হিসাবে এই উচ্ছেদের জেরে প্রায় অর্ধলাখ মানুষ তাঁদের কর্ম হারিয়ে বেকার হয়ে যাবেন।
প্রশ্ন হচ্ছে এসব উদ্যোক্তা যাবেন কোথায়?
এসব উদ্যোক্তার বেশির ভাগই তরুণ। বেকারত্ব একটি বিশ্বজনীন সমস্যা। বিশ্বে এই মুহূর্তে বেকারের সংখ্যা ২০ কোটির বেশি। তরুণেরাই সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এর সঙ্গে ১৫-২৪ বছর বয়সী যারা পড়ালেখাও করে না, আবার কাজও করে না, সে সংখ্যা যোগ করলে সেটা ২৯ কোটি ছাড়াবে। রক্ষণশীল হিসেবে বাংলাদেশে ৯ শতাংশ লোক বেকার। তাতে সংখ্যাটা হয় প্রায় ১ কোটির কাছাকাছি। এর মধ্যে শিক্ষিতের সংখ্যা বেশি, ৪৭ শতাংশ।
প্রতিবছর ২২ লাখ তরুণ এই দেশে কর্মবাজারে প্রবেশ করেন। তঁাদের মধ্যে পাঁচ থেকে সাত লাখ বৈধ-অবৈধ পথে দেশ ছেড়ে সোনার হরিণের আশায় বিদেশে পাড়ি দেন। এক-দুই লাখ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পান। দুই লাখের মতো লোক নিজের যোগ্যতার চেয়ে কম যোগ্যতার ইনফরমাল সেক্টরে ঢুকে পড়েন। তারপরও মেরেকেটে ১০ লাখ লোকের প্রতিবছর কর্মসংস্থান হয়
না। এই ২২ লাখের মধ্যে ২ লাখ হচ্ছেন গ্র্যাজুয়েট, যাঁদের অর্ধেকও যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পান না।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের হিসাবে, বেকারমুক্ত বিশ্ব গড়তে হলে প্রতিবছর ৪ কোটি ২০ লাখ নতুন চাকরি সৃষ্টি করা প্রয়োজন
আর বাংলাদেশে দরকার কমপক্ষে নতুন ১০ লাখ কর্মসৃজনের। প্রশ্ন হচ্ছে এই কাজটা কেমন করে হবে?
সব হিসাবনিকাশ বলছে, সনাতনী পদ্ধতিতে সরকারি ও করপোরেট হাউসের চাকরি দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। দরকার নতুন নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের, উদ্ভাবনী ও ডিজিটাল প্রযুক্তির। কর্মসংস্থানের সমীকরণে তাই সামনে এসেছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা। বলা হচ্ছে কর্মসৃজন বেশি করবেন উদ্যোক্তারাই। সে জন্য তাঁদের কাজটা যেন সহজে হয় তার জন্য সমাজে, সরকারে উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা দরকার। মানে হলো ব্যবসা শুরু করা, কাগজপত্র তৈরি করা—এসব যেন সহজে করা যায়। সামগ্রিক বিষয়টা যেন ভালো হয়, উদ্যোক্তা যেন সহজে অনুমোদনগুলো পায়, ব্যাংক যেন তার পাশে দাঁড়ায়। বেশির ভাগ দেশই সেটা করার চেষ্টা করে।
আমেরিকার মতো দেশের প্রেসিডেন্ট তাঁর বার্ষিক ভাষণের একটা অংশ নবীন উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ দেন। তিনি কী করবেন সেটা বলেন। শুধু যে উদ্যোগ নেন তা নয়। সফল উদ্যোক্তাদের দাওয়াত দিয়ে হোয়াইট হাউসে এনে চা খাওয়ান। শুধু সরকার নয়, সেখানে রয়েছেন বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা, যাঁরা তরুণ ও উদ্ভাবনী ধারণার পেছনে বিনিয়োগ করতে পিছপা হন না। ১০টি ধারণার পেছনে অবলীলায় টাকা ঢালেন এবং একটি উদ্যোগ সফল হলে আত্মতৃপ্তি পেতে কসুর করেন না। নতুন প্রযুক্তি আর নতুন ধারণাকে লালন-পালন করেন বলে সেখানে গুগল, ফেসবুক কিংবা আমাজনের মতো আপাত উদ্ভট ধারণা বিরাট হয়ে সবকিছুকে গ্রাস করার পর্যায়ে যেতে পারে।
তো বলছিলাম এই যে ডিজিটাল প্রযুক্তি, সেটা কিন্তু বিশ্বব্যাপী এক বিরাট চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এটা এমনই একটা অবস্থা তৈরি করেছে যে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মিডিয়া কোম্পানি নিজে কোনো কনটেন্ট তৈরি করে না (ফেসবুক), সবচেয়ে বড় ট্যাক্সি সার্ভিসের নিজেদের কোনো ট্যাক্সি নেই (উবার), পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দোকানের নিজের কোনো ইনভেন্টরি নেই (আলিবাবা), সবচেয়ে বড় হোটেল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের হোটেলই নেই (এয়ারবিএনবি)। এই তালিকা আরও বড় করা যায়। ডিজিটাল প্রযুক্তির কারণে আজকে বিশ্বের অন্যতম ধনীদের প্রোডাক্ট হয়েছে মেধাসম্পদ, সেগুলো হাতে ধরা যায় না।
এ উদাহরণগুলো দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো এটা জানানো যে এখন একটা ইন্টারনেট সংযোগ আর ল্যাপটপ থাকলেই নিজের
দক্ষতায় এমন প্রতিষ্ঠান গড়া যায়, যার মোট মূল্য কোনো কোনো দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের চেয়ে কম নয়। মাত্র ৫৫ জনের একটি মেসেজিং কোম্পানি হোয়াটসঅ্যাপকে ফেসবুক কিনে নিয়েছে ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলারে!
বিশ্ব এখন একটা ডিজিটাল অর্থনীতির দিকে এগোচ্ছে। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরাও সেদিকে ঝুঁকবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের কাজ হওয়ার কথা তাদের জন্য একটা প্রযুক্তিবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা। তা না করে আমরা প্রতিনিয়ত তাদের জন্য রাস্তাটাকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলছি। ওয়েবসাইট বানানোর একটা কোম্পানিতে কাজ করে হয়তো দুই বা তিনজন এবং তাদের অফিসে নিজেরা ছাড়া অন্য কোনো লোক আসেও না। আমাদের সিটি করপোরেশনগুলো যে কাঠামোকে ‘অফিস’ ভাবে, এগুলো সে রকমও না। তারপরও আমরা জোর করছি তারা যেন হাজার টাকার স্পেস ছেড়ে লাখ টাকার স্পেসে যায়। কোনো কোনো মেয়র ভাবছেন তিনি একসঙ্গে সাত বছরের ট্রেড লাইসেন্স ফি নিয়ে নেবেন। অথচ এটা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত তথ্য যে ৬০-৭০ শতাংশ নতুন ডিজিটাল কোম্পানি প্রথম বছরেই বন্ধ হয়ে যায়, তাদের উদ্যোক্তারা নতুন ধারণা নিয়ে কাজ করে। ফেসবুকে পেজ খুলে বা একটি ই-কমার্স সাইট খুলেই একটা বড় ব্যবসা চালু করা যায়, যার কর্মীরা নিজ নিজ বাসা থেকেই সেটা চালাতে পারে। এ রকম একটা ভার্চ্যুয়াল শপের কেন ‘তথাকথিত বাণিজ্যিক এলাকায়’ অফিস থাকা লাগবে? কেনই-বা তাকে একটা ‘দোকান’ নিতে আমরা জোর করব?
বিশ্বব্যাপী এখন বাসায় থেকে কাজ করাকে উৎসাহ দেওয়া হয়, যাতে পরিবারকে বেশি সময় দিতে পারে। এতে যাতায়াত খরচ ও অফিস ভাড়াটাও বাঁচে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানে এখন আর কারও জন্য নির্দিষ্ট চেয়ার-টেবিল থাকে না। দরকারও পড়ে না। তাহলে?
আপনি তরুণদের কাজ দেবেন না, চাকরির সুযোগ তৈরি করবেন না আর সে নিজে নিজে কিছু করতে চাইলে তাকে পদে পদে হয়রানি করবেন আর ভাববেন সে আপনাকে গুগল, ফেসবুক আর আমাজন বানিয়ে দেবে। এত সোজা?