তরুণ, শুরু করার আগেই হতাশ কেন?
আমার মনে পড়ল, মাত্র কদিন আগে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমার অনুরূপ একটি অভিজ্ঞতা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পঠিত বিষয়ের বাস্তব প্রয়োগ এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে চাকরির বাজার সম্পর্কে ধারণার জন্য তাদের একটি আইসিটি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের জন্য নির্বাচিত করা হয়। নির্ধারিত দিনে প্রতিষ্ঠানটি তাদের জন্য ব্রিফিং, বিভিন্ন সেকশন ঘুরে দেখাসহ খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করলেও নির্ধারিত শিক্ষার্থীদের ৪৫ শতাংশ সেখানে উপস্থিতই হয়নি!
শিক্ষার্থীদের উদাসীনতার এমন প্রকাশ দেখে দুদিন আগে দুটি ঘটনা আমার সামাজিক যোগাযোগ প্রোফাইলে শেয়ার করি। সেখানে আরও ঘটনার কথা জানতে পারি। যেমন ইন্টারভিউয়ের জন্য নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত না হয়ে পরবর্তী দিনের জন্য ইন্টারভিউয়ের টাইম ঠিক করে সকাল থেকে ফোন বন্ধ রাখা, আবেদন করে ইন্টারভিউয়ের জন্য নির্বাচিত হয়ে সেখানে উপস্থিত না হওয়া ইত্যাদি বিষয় সম্ভবত আমাদের তরুণ প্রজন্মের একাংশের অস্থিরতা ও উদাসীনতাকে তুলে ধরেছে।
গত কয়েক দিন এ বিষয়ে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হচ্ছে, দুই কারণে তরুণদের এ মনোভাব গড়ে উঠছে। একটি হলো ‘হলে হবে না হলে না হবে’—এমন মনোভাব। এ দলের আসলে জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে সে রকম মোলাকাত হয়নি। অভিভাবকের অর্থে এরই মধ্যে তারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে চলে এসেছে এবং দুঃখ-কষ্ট ছাড়াই দিন যাপন করতে পারছে। এদের একটা অংশকে আরও দেখা যায় পড়াশোনায় যথাযথ মনোযোগ না দিয়ে বেদরকারি কাজে বিপুল পরিমাণ সময় অপচয় করতে। তাদের অনেকেরই ধারণা, চাকরির সময় হলে এমনিতেই সেটা পাওয়া যাবে। শুধু শুধু কষ্ট করার দরকার কী!
তবে, একাংশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধারণা চাকরি-বাকরিসহ কাজকর্ম এখন মামা-চাচা কিংবা বিশেষ তদবির ছাড়া হয় না, হবেও না। অনেকের ধারণা, এগুলোর ব্যাপারে তাদের কোনো ‘দক্ষতা’ নেই, তাই তাদের চাকরিও হবে না।
মুশকিল হচ্ছে, তাদের কেউ বলছেও না যে বিশেষ করে বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে দক্ষতা ও মেধাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কারণ, প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কাজকর্ম তুলতে হয় এবং সেটির জন্য তাদের এমন কর্মী দরকার, যাদের এগিয়ে নেওয়া যায়, যাদের দক্ষতাকে শাণিত করা যায়।
গত তিন বছরে একাধিক প্রতিষ্ঠানের কর্মী নিয়োগের সময় যুক্ত থাকার সুবাদে আমি এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, নিয়মিতকরণের ঘটনা ছাড়া বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই ‘আগে থেকে ঠিক’ করা প্রার্থী নিয়োগে তৎপরতা দেখায় না। সবাই ভালো কর্মীর সন্ধান করে।
কিন্তু চাকরিপ্রার্থীদের একাংশের আচরণে কোনো কোনো মানবসম্পদ বিভাগ এতই বিরক্ত হয় যে তারা ‘রেফারেন্স’ প্রার্থী ছাড়া অন্যদের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কারণ, কোনো একটি পদের জন্য একবার বিজ্ঞাপন দেওয়া হলে ক্ষেত্রবিশেষে কয়েক হাজার আবেদন পাওয়া যায়। সেখান থেকে বাছাই করে প্রথমে লিখিত পরীক্ষা, তারপর সাক্ষাৎকারের আয়োজন করাটা যথেষ্ট সময় ও ব্যয়বহুল কর্মকাণ্ড। তারপর যদি ঘটনা এমন হয় যে ‘২৬ জনের মধ্য মাত্র ৭ জন’ ভাইভা বোর্ডে উপস্থিত হয়, তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটিই প্রশ্নবিদ্ধ ও অর্থহীন হয়ে পড়ে। এ কারণে অনেক মানবসম্পদ বিভাগ ইদানীং রেফারেল প্রার্থীদের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে বেশি।
দেশে ৪৭ শতাংশ গ্র্যাজুয়েটের সে অর্থে কর্মসংস্থান নেই। অথচ এরই মধ্যে দেশে প্রায় সাত-আট লাখ বিদেশি কর্মী কাজ করেন। এঁদের মধ্যে ক্ষুদ্র একটি অংশ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও বেশির ভাগই দেশীয় উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। ২০১৬ সালে এই বিদেশি কর্মীরা আমাদের দেশ থেকে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার নিয়ে গেছেন, যা দেশীয় টাকায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি! এসব উদ্যোক্তার কাছে জানতে চাইলে তাঁরা একবাক্যে দেশীয় কর্মীদের অদক্ষতা এবং একই সঙ্গে অপেশাদার মনোভাবকে দায়ী করেন।
এসব উদ্যোক্তার এমনতর প্রশ্নের চটজলদি জবাব দেওয়া যায় না। কারণ, আমি একটি প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন প্রকৌশলীকে কোনো নোটিশ বা জানান না দিয়ে বিদেশে চলে যেতে দেখেছি। তাঁদের এ আচরণের পর ওই প্রতিষ্ঠান যদি পরবর্তী সময়ে দেশি প্রকৌশলীদের চাকরি দিতে অনীহা দেখায়, তাহলে কি তাদের খুব বেশি দোষ দেওয়া যাবে?