দুই বন্ধুর হেসে খেলে ২৫ বিলিয়ন ডলার
সাম্প্রতিক সময়ের আগে আমি তাদের দুই ভাই মনে করতাম। খুব ক্লোজলি দেখা হয়নি সেভাবে। তাহলে জানতাম যে তারা ভাই তো নয়, এমনকী দূরতম আত্মীয়ও নয়। কিন্তু তাদের দুইজনের নামের শেষ অংশ একই!
বাংলাদেশে আমাদের সময় বুয়েটে ভর্তি হওয়াটা ছিল সায়েন্সে এইচএসসি পাস করাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ। এখন হয়তো এটা অনেক সহজ। ভারত যেহেতু দেশ বড় এবং তাদের আইআইটিগুলোর সুনাম দেশ ছাড়িয়ে, তাই সেখানে আইআইটির জয়েন্ট এন্ট্রাস পাস দেওয়াটা একটা বড় কাজ। শচীন আর বিনি তাই সেই বিচারে একটি নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করেছে। যদিও তাদের স্কুল রেজাল্ট কিন্তু আহামরী নয়।
ছোটবেলা থেকেই শচীনের কম্পিউটার গেমের প্রতি আগ্রহ। প্রায়শ ঘরের দরজা বন্ধ করে খেলায় মেতে থাকতো সে। এটাই কন্টিনিউ করলো দিল্লী আইআইটিতে। ফলাফল চার বছরে ডিগ্রী শেষ হলো না। অতিরিক্ত এক বছর সেখানে থাকতে হলো। এই এক বছর সময়কালে শচীনের পরিচয় হলো বিনি’র সঙ্গে। বিনিও পড়ালেখায় উচ্চমার্গীয় নয়।
২০০৪ সালে অ্যামাজন তাদের ভারতীয় অফিস খোলার জন্য একটি কঠিন রিক্রুটিং-এর ব্যবস্থা করে। হেড অফিস থেকে কয়েকজনকেও পাঠানো হয়। মোটমাট ৬০ জন মিলে শুরু হয় ব্যাঙ্গালোরে অ্যামাজনের অফিস। এরকম অফিসগুলো ভারতে কেউ আগে দেখেনি। এখানে কেউ স্যুট-টাই পরে অফিসে আসে না। বরং হাফপ্যান্টের ছড়াছড়ি। সঙ্গে পিক আপ, দামী ক্যাটারারের খাবার, দ্রুত গতির ইন্টারনেট – এসব বরং ভারতের টেক-সেবীদের জন্য এটি হয়ে উঠে আরাধ্যের চাকরি। এই অফিসে জুনিয়ররা আবিস্কার করে চাইলে সিনিয়রদের কাজের খুঁত ধরা যায়। The Emperor Has No Clothes নামে একটা অনুষ্ঠান সেখানে হতো যদি কেউ কোন প্রোডাক্টের ভুল বরে করতে পারতো।এখানে এভাবে একটা মাইন্ডসেট গড়ে ওঠাদের মধ্যে তিন ডজন সেখান থেকে বের হয়ে নিজেরাই একটা কিছু করার চেষ্টা করে। আমাদের মচীন ও বিনি বংশালও তাদের দুইজন।
সেই সময়ে একটা ইন্টা্রনেট ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মোটেই সহজ বিষয় ছিল না।শচীন ও বিনির প্রথম আইডিয়া ছিল তারা অনলাইনে একটা প্রোডাক্ট রিভিউ সাইট করবেন। মানে কেউ গগুল করে তাদের সাইটে এস নির্দিষ্ট সাইটে গিয়ে কেনাকাটা করবে এবং তারা কমিশন পাবে। কিন্তু অচিরেই তারা টের পেলেন ভারতের ই-কমা্সে যা পাওয়া যায় সেগুলো এমনিতে ক্রাপ। সেগুলোর রিভিউ করে কী লাভ হবে? “সবই যখন সাব-স্টান্ডার্ড, তখন সেগুলোকে তূলনা করে কী লাভ”।
মার্কেটিং-এর জন্য নিজেরাই বিভিন্ন জায়গায় পোস্ট-টোস্ট দিতো। সেই হিসাবে শচীন একটা পোস্ট করে ভি কে কে চন্দ্র নামে একজনের ব্লগে। চন্দ্রই হয় ফ্লিপকার্টের প্রথম কাস্টোমার। এ সময় তারা ই-বে’তে একাউন্ট খুলেও বই বেচেছে। বই-এর ওপর ফ্লিপকার্টের স্টিকার লাগিয়ে দিতো। ধীরে ধীরে তারা একটু মোমেন্টাম পেতে শুরু করলেও কেউ কোনদিন স্বপ্নে্ও ভাবেনি ফ্লিপকার্ট একদিন এতো বড় হবে। ওদের একজন আইআইটি বন্ধুকে রিক্রুট করতে চাইলে সে বন্ধুটি তাদের বলেছিল – কে আর বই পড়ে?
তারপর তারা বিনিয়োগ খো্ঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু কেউ আগ্রহ দেখায়নি। কেউ কেউ তাদের চাকরির অফার দিয়েছে। কেউ কমদামে কিনে নিতে চেয়েছে। এই সময় তারা প্রতিদিনই প্রচুর উপদেশ পেতেন। বিশেষ করে আমার মতো একদল ‘গায়ে মানে না আপনি মোড়ল’ টাইপের লোক। যারা ভাবে তারা স্টার্টআপের অনেককিছু জেনে ফেলেছে। তারা শচীন আর বিনিকে পরামর্শ দিতো এইসব ছেড়ে চাকরি বাকরি করতে।
ওরা পাত্তা না দিয়ে নিজেরা নিজেদের প্রশ্ন করতো –
আগামীদিনগুলোতে কি ভারতের ভঅনেক লোক ইন্টারনেট ব্যবহবর করবে?
অনেক অনেক লোক কি একদিন অনলাইনে কেনাকাটা করবে?
অন্যান্য ই-কমার্সগুলোর কী এমন কোন সমস্যা আছে যা আমরা সলভ করতে পারি।
এখন আমরা জানি ওদের প্রশ্নের উত্তর কী ছিল। ই-কমার্সে সব সময় ঝামেলা হলো বিশ্বাস নিয়ে। ওরাও সেটা জানতেন। বই-এর মতো একটা সহজ এবং কমদামী প্রোডাক্ট দিয়ে ধীরে ধীরে সে জায়গাটা অর্জন করেছেন। তারপর অন্য প্রোডাক্টে মনোনিবেশ করেছে।
২০১২ সালে অ্যামাজন আবার ইন্ডিয়াতে এসে পড়ে। তখন থেকে ফ্লিপকার্ট জানতো সামনে তাদের লড়াই কঠিন। ২০১৮ সালে ওরা ফ্লিপকার্টের একটা বড় অংশ ১৬ বিলিয়ন ডলারে ওয়ালমার্টের কাছে বেচে দেয়। গত বছরও তারা তাদের আরও শেয়ার বেচে দিয়েছে।
এএখন এই দুই বংশালের “বই কে পড়ে” দোকানের মূল্যমান হয়েছে মাত্র ২৪.৯ বিলিয়ন ডলার। তারা দুজনই বিলিওনিয়ার এবং নানা কিছু এখন করে বেড়ান।
ফ্লিপকার্টের গল্পে উদ্যোক্তা ও মার্কেটারদের জন্য অনেক কিছু শেখার আছে। যারা শিখতে পারলো তারা এগিয়ে গেল। যারা পারলো না তারা তাদের গল্প ব্লগে লিখে ফেসবুকে শেয়ার দিল।