আকাশ ছোঁয়ার স্থপতি
পরে যখন বুয়েটে পড়তে আসি তখন বুয়েটের প্রসপেক্টাস ঘেটে দেখলাম ওনার নামে কোন হল বা ভবন আছে কী না। দেখলাম নাই। এমনকী পুরকৌশল ভবনের নিচতলায় ওনার কোন ছবি নেই।
এরপর দীর্ঘদিন কোন খবর রাখি নাই। বুয়েট থেকে পাস করার আগেই আমার পত্রিকাতে লেখালেখির হাত চালু হয়। সে কারণে পাস করার পর দুই বছর ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজের সহযোগী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি। সে সময় সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল্লাহর নির্দেশে এফআরখানের ওপর পড়ালেখা শুরু করি। সে সময় জামিলুর রেজা স্যার আইইবির সভাপতি। কাজে একদিন স্যারের কাজ থেকে এফআরখান বিষয়ক জ্ঞান নিলাম। তারপর বই পুস্তক ঘাটাঘাটি করে ম্যালা কিছু জেনে অবাক হয়ে গেলাম। এই দেশের একজন সন্তান কিনা এমন একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন যে কারণে শততলা ভবন বানানো যায়। শিকাগো শহরে মেয়র অফিসের সামনে নাকি ওনার একটা আবক্ষ মূর্তি আছে!!! জামিল স্যারের কথামতো সেটার একটা ছবিও যোগাড় করা হল। সেবার ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজে লেখার পর আর একবার এফআরখান সম্পর্কে লিখেছি ভোরের কাগজে।
তারপর থেকে সুযোগ পেলেই ওনার কথা আমার কোন না কোন লেখাতে দিয়ে দিতাম। ওনার ডিজাইনের মধ্যে আমার সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল জেদ্দা বিমানবন্দরের হজ্ব টার্মিনাল নিয়ে। তাবুর মতো করে বানানো। মাথার মধ্যে এ ব্যাপারটা এমন গেঁথে যায় যে, কাজাখস্থানে গিয়ে এরকম তাবুর মতো একটা স্থাপনা দেখে ভেবেছি ঐটিও মনে হয় ওনার ডিজাইন। যব হোক, বছর তিনেক আগে জেদ্দা টার্মিনাল দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।
স্যারের অনেক স্ট্রাগল ছিল প্রথম জীবনে। তাছাড়া তিনি দেশে আসার মতো তখনো তৈরি হোননি। সত্তর দশকের শেষের দিক থেকে উনি দেশে আসতে শুরু করেন। কাজের ক্ষেত্র হিসাবে বেঁছে নেন উপকূলীয় এলাকার জন্য ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস প্রতিরোধী স্বল্প খরচের বাসভবন বানানোর চিন্তা। সে সময় জেদ্দা টার্মিনালটি তৈরি হচ্ছিল। এর মধ্যে তিনি বিটিভির একটা অনুষ্ঠানে তাঁর ধারণার বাড়িটি কেমন হবে সেটির একটি মডেল দেখিয়েছিলেন। তবে আকস্মিকভাবে তাঁর মৃত্যু হওয়ায় সেই কাজটা আর হয়নি।
আমি যখন এলিফেন্ট রোডে বর্তমান আবাসস্থলে উঠি, তখন আবার তাঁর কথা মনে হয়। আমি যে এপার্টমেন্টে থাকি সেটির দক্ষিণ দিকে দুই দুইটি টয়লেট আছে। যা থেকে খুব সহজে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে, স্থপতির বাংলাদেশ সম্পর্কে, দখিনা হাওয়া সম্পর্কে কোন ধারণা নেই!!! এফ আর খান সব সময় এই ব্যাপারটা মাথায় রাখতেন। তিনি গ্লোবাল বিষয় নিয়ে কাজ করতেন বটে তবে লোকাল ব্যাপারগুলোকে বাদ দিতেন না। জেদ্দা টার্মিনালের কথা ভাবুন। সকালে উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য তার বানানো মডেলটার কথা মনে করার চেষ্টা করছিলাম সফল হইনি।
আজকে তাঁর সম্পর্কে যারা জানতে চায় তারা উইকিপিডিয়াতে, তাঁর মেয়ের লেখা এবং অন্যান্যদের লেখা থেকে জানতে পারবেন। আমি এগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে চায় না। এফ আর খানকে নিয়ে আমার সর্বশেষ লেখা থেকে কিছু অংশ-
আকাশচুম্বী অট্টালিকা বানানোর মূল বুদ্ধিটা বের করেছিলেন বাংলাদেশের সন্তান, আমেরিকার নাগরিক ফজলুর রহমান খান। সাধ ছিল তাঁর আকাশ ছোঁয়ার। সেই ছোঁয়ার জন্য তিনি শিল্পেরই দ্বারস্থ হয়েছেন। তাঁকে বলা হতো ‘কাঠামোগত প্রকৌশলের আইনস্টাইন’। উইলস টাওয়ার, হ্যাকক টাওয়ার, জেদ্দা বিমানবন্দরের টার্মিনালের মতো বিশ্বের সেরা কিছু স্থাপত্যকর্মের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা। আমেরিকায় শিকাগো শহরের মেয়র অফিসের সামনে তাঁর একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি-স্মারক রয়েছে। সেখানেই লেখা রয়েছে তাঁর একটি আপ্তবাক্য। ১৯৭১ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ রেকর্ড তাঁকে বছরের সেরা প্রকৌশলী ঘোষণা করে (তিনিই একমাত্র প্রকৌশলী যিনি তিন তিনবার এই সম্মান পেয়েছেন)। পত্রিকায় এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছিলেন, প্রযুক্তি আর প্রযুক্তিবিদদের মূল কাজ হলো মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন। সে জন্য তাঁদের অবশ্যই মানুষের কাছাকাছি থাকতে হবে। স্মারক ভাস্কর্যে তাঁর সেই উক্তি খোদাই করা হয়েছে— ‘The technical man must not be lost in his own technology. He must be able to appreciate life; and life is art, drama, music and most importantly people.’ (‘প্রযুক্তিবিদদের অবশ্যই তাঁর প্রযুক্তির নিচে চাপা পড়া চলবে না। তাঁর অবশ্যই জীবনকে উপভোগ করা উচিত; আর জীবন হলো শিল্প, নাটক, সংগীত এবং সর্বোপরি মানুষ।’)
ফজলুর রহমান খান – আপনাকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।