স্বপ্নের সিড়ি আর পড়ে যাওয়ার ট্রেনিং
গ্রীক গীতিকার ও কবি আর্কিলোকোসের এই কোটেশনটি আমার ছেলের টেবিলের সামনে সাটানো একটা পোস্টারে লেখা আছে। কথাগুলো খুব সহজ। বাংলা করলে মোটামুটি এমনভাবে বলা যায় যে, আমরা প্রত্যাশা অনুযায়ী উঠতে পারি না, বরং আমাদের আমাদের ট্রেনিং লেবেলে নেমে যাই। এই ট্রেনিং ঠিক প্রশিক্ষণ না। এটি হলো প্রতিদিনকার অভ্যাস, নিজেকে গড়ে তোলার নানা অনুষঙ্গ ইত্যাদি। যা দিয়ে আমাদের একটা চিন্তন-কাঠামো গড়ে ওঠে।
আজকে দুইটি সেশনে গিয়ে এই কথাটা আবার মনে পড়েছে। প্রথমটা ছিল আমাদের তারুণ্যের জয়োৎসবের একটি বিশেষ আয়োজনে। এই আয়োজনটা আমরা সারাদেশে ছোট ছোট করে করবো, নানান বিষয়ে। আজকের বিষয় ছিল “এমআইটিতে পড়তে চাই”। মানে যারা বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে চায় তাদের জন্য কিছু নির্দেশনা আর তথ্য জানানো। ফ্যাসিলিটেটর ছিল আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডের ব্রোঞ্জ পদক জয়ী, এমআইটি স্নাতক ও বর্মানে সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ডক্টর অব মেডিসিন ক্যান্ডিডেট নাজিয়া চৌধুরী।
শুরুতে যারা ছিল তাদের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করেছি। আলাপ করতে গিয়ে আমার পুরানো একটা কৌতুকের কথা মনে পড়েছে।
-আমি এমআইটিতে পড়তে চাই, স্যার।
এমআইটি দিয়ে কী হয়?
-ম্যাসাচুসেট ইনস্টিটিউট অব টেকনোলোজি।
আচ্ছা। ম্যাসাচুসেট বানান করো।
-থাক স্যার। আমি এমআইটিতে পড়বো না। আমি বরং ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। ওহাইও বানান হলো – ও এইচ আই ও!
তো, এ হলো অবস্থা। অনেকেই কয়েকবছর ধরে এই স্বপ্ন লালণ করেছে কিন্তু সেই স্বপ্নের পথে আগাোনর কোন চেষ্টা করছে না। হয়তো ঘন্টার পর ঘন্টা ইন্টারনেটে কাটাচ্ছে, কিন্তু এমআইটির ওয়েবসাইটে যাওয়া, সেখানকার এডমিশন ট্যাবটা খুলে দেখা এসব করা হচ্ছে না। আমি এতোই ভয় পেয়েছি যে, কোরা’তে কেউ এমআইটি এডমিশন নিয়ে কোন পোস্ট পড়েছে কী না এটা জানতে চাওয়ার সাহসই হয়নি!
আমি অবশ্য আমার শিক্ষার্থীদের ব্যস্ততার কথা জানি। ওদের আড্ডা দিতে হয়, রাত জেগে ফেসবুকিং করতে হয়, দল বেঁধে সিনেমা দেখতে হয়, যেসব জায়গায় ফ্রি ইন্টারনেট পাওয়া যায় সেখানে গিয়ে মুভি ডাউনলোড দিতে হয়। ওদের ব্যস্ততার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া আমার মতো অলসদের পক্ষে অসম্ভব। এই জন্য আমি আমার ক্লাসে ওপেন বুক, ওপেন ইন্টারনেট, বাসায় বসে পরীক্ষা দেওয়া এসব চালু করেছি। ওদের সময় কম, যাতে সর্বোচ্চ ব্যবহার তারা করতে পারে।
নাজিয়ার প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার পর গেছি পাই ক্যাস্পে। ওখানে ১০ জন পাইথন প্রেমী একটা প্রজেক্ট করবে ২০ মে পর্যন্ত। এই জন্য ওদের বাসাতেও অনেক কাজ করতে হবে। ফ্যাসিলিটেটররা যা করবেন তা হলো তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেবেন। সেখানেও বলেছি এই প্রোগ্রামটা তোমার কাজে লাগবে যদি তুমি নিজে থেকে আরও ১০টা কাজ করো। কোডিং পড়ার অভ্যাস তৈরি করো, ইন্টারেনটে যে সব কোড পাওয়া যায় সেগুলো শুধু কপি-পেস্ট না করে সেগুলো বোঝার চেষ্টা করো, এলগরিদম এদিক ওদিক করে কমপ্লেক্সিটির কি অবস্থা দাড়াচ্ছে সেটা বোঝার চেষ্টা করো। আমি ঠিক জানি না ওরা সেটা করবে কি না।
এটা নিয়ে কথা বলছিলাম পাই ক্যাম্পের সমন্বয়কারী তানভির শুভ-র সঙ্গে। ওর ধারণা – এখন ফ্রিল্যান্সারের জোয়ার থেমে গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আর সরাসরি নিয়োগ দিচ্ছে না, বরং প্রথমে কিছু কাজ করতে দিচ্ছে, রেফারেল ছাড়া সিভি বিবেচনাতেও নিচ্ছে না। কারণ যে কোন জব পোর্টালে নিয়োগের খবর দিলেই অনেক সিভি জমা পড়ে যাচ্ছে। অন্নেযদিকে অনেকের এমনকি নিজের সিভি বানানোরও সময় নাই। আমাদের খুলনার আবু আশরাফ মাসনুনের তো এ বিষয়ে একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা আছে। তার একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে সে একবার একটি সিভি পায়। খুবই ফাটাফাটি। পড়তে গিয়ে চেনা চেনা লাগে। পড়ে বুঝতে পারে এটি তাঁরই সিভি। আবেদনকারী মাসনুনের নামটা কেটে নিজের নামটা বসিয়ে দিয়েছে আর কয়েকটা বাক্য পরিবর্তন করেছে!!!
তো, যার কিনা নিজের নিজে বানানোর সময় নেই, কোন ফোরামে কোন প্রশ্ন করতে হবে সেটা বোঝার দরকার নাই, তার জন্য চাকরি নিয়ে কে বসে থাকবে?
আমি জানি না। আমি দুইদিন ধরে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন পড়ছি যেখানে বলা হয়েছে আমাদের তরণরা একুম শতকের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে তৈরি হচ্ছে না। তারা তাদের সময় অন্য কোথাও দিয়ে দিচ্ছে। ফলে, অন্যদেশের তরুণরা চলে আসছে আমাদের দেশে। ওরা আমাদের দেশে থেকে নিজেদের দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে শত শত কোটি ডলার!
আর আমাদের তরুণদের বড়ো অংশ চাকরি পাচ্ছে না। ঐ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্নাতকদের পাস করার দুই বছরের মধ্যে চাকরি হয় না ৭০%-এর। পলিটেকনিকে এই হার ৪০%!!!
ঝামেলাটা কোথায়? কোথায় হাত দিলে এ থেকে উত্তরণ হবে?
উত্তরের জন্য বব ডিলানের এই গান শোনা যেতে পারে।
তারুণ্যের জয়োৎসবে আমরা এমনতর বিভিন্ন বিষয়কে এড্রেস করতে চাই। আমি পথে নেমে যাবার লোক। তাই নেমে পড়েছি। আশা করছি করতে করতে একটা লাইন নিশানা পেয়ে যাবো।
আপাতত ভার্সিটিগুলোতে তথ্য আর তত্ব নিয়ে যাবো। সঙ্গে থাকবেন বিষয় বিশেষজ্ঞগণ। এই যেমন আগামী ২৩ এপ্রিল ২০১৮ বিকেল ৫টায় যাবো বুয়েটের অডিটরিয়ামে। সেখানকার আলোচনার মূলে থাকবে যারা প্রযুক্তি নিয়ে পড়ছে বা স্নাতক শেষ করেছে তাদের সামনের দিনগুলো কেমন। এই নিয়ে কথা বলার জন্য আমরা আহবান জানিয়েছি ক্রাউন সিমেন্টের উপদেষ্টা আবদুল মজিদ, গ্রামীণ ফোনের চিফ কর্পোরেট এফেয়ার্স অফিসার মাহমুদ হোসেন, হাতিরঝিলের স্থপতি ইকবাল হাবীব, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক, সিওর ক্যাশের প্রধান নির্বাহী ড. শাহাদত উল্লাহ, অন্য রকম গ্রুপের চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান। এচাড়া আরও থাকবেন ৩৬ তম বিসিএসের প্রথম। থাকবে আমাদের বন্ধু অরূপ রতন চৌধুরী, বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের জেনারেল ম্যানেজার জাকারিয়া জালাল, স্পেকট্রাম কোনসোর্টিয়ামের এমডি ফোরকান বিন কাশেম, রবির ভাইস প্রেসিডেন্ট জাভেদ পারভেজ। । আমন্ত্রণ জানিয়েছি কিন্তু এখনও আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি স্থপতি মেরিনা তাবাসসুমসহ আরও ১/২ জন। চেষ্টা করছি যারা স্থপতি-প্রকৌশলী নিয়োগ দেন তাদের কয়েকজনকে সেখানে দাওয়াত দিতে। বুয়েটের ক্যারিয়ার ক্লাব আমাদের সহযোগিতা করছে এই আয়োজনে। দেখা যাক আরও কাউকে পাওয়া যায় কিনা। দুইটা সেশন থাকবে।
আলোচনায় ঘুরে ফিরে থাকবে প্রযুক্তিবিদদের সামনের দিনের ক্যারিয়ার, অলটারনেটিভ ক্যারিয়ার আর এন্ট্রারপ্রিনিয়রশীপ। থাকবে মুক্ত আলোচনার সুযোগ। বুয়েটের শিক্ষার্থী ছাড়াও আগ্রহী যে কেউ যেতে পারবে, প্রযুক্তি-প্রকৌশল-স্থাপত্য নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে। অবশ্য সেজন্য নিবন্ধন করতে হবে জয়োৎসবের ইভেন্টে।
এসব আলোচনা থেকে আমরা বের করতে চাই প্রথম আলো আর ক্রাউন সিমেন্ট তরুণদের কোথায় কোথায় সাহায্য করতে পারে (যদি তারা চায় আর কি), কোন কোন পয়েন্টে আমরা লেখালেখি করতে পারি, নানা ফোরামে বলতে পারি। অথবা ছোটখাটো কোন ইন্টারভেনশন হয়তো আমরাই করে ফেলতে পারবো বা উপস্থিত এলামনাইরা একটা সমাধান দিতে পারবেন। আমরা হয়তো গোল টেবিলবৈঠক করতে পারি। আলোচনা করে পলিসি মেকারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি।
মধ্য এশিয়ার প্রিয় লেখক রসুল গামজাতভের “আমার জন্মভূমি” আমার জীবনে বাঁক ঘুরিয়ে দেওয়া অন্যতম একটি বই। সেখান থেকে আমি শিখেছি – অনেক দূরের যাত্রাও ঘর থেকে এক পা ফেলে শুরু করতে হয়।
এ জন্য লম্বা সময় নিয়ে নেমে পড়েছি। জানি সবটা আমি টেনি নিতে পারবো না। কিন্তু ততোদিনে অনেক হাত আর কাঁধ তৈরি হয়ে যাবে।
সবার জন্য শুভ কামনা।