চাকরি চাই-১: আবেদনের আগে
দেড় হাজার সিভি দেখে আমার মনটা খুবই খারাপ হয়েছে। শুধু তিনটে পদের জন্য দুই হাজারের সংখ্যার জন্য নয়, বরং মন বেশি খারাপ হয়েছে বেশিরভাগ আবেদনকারীর ক্যাজুয়ালনেস দেখে। অনেকেই হয়তো কেবল দরখাস্ত করতে হবে বলে করেছে!!!
আমি লক্ষ করেছি,
- সবচেয়ে বেশি আবেদনকারী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের,
- অনেকেই ন্যূনতম যোগ্যতা ও বিষয় না দেখেই আবেদন করেছেন,
- নিজের মত করে সিভি লিখেছে মাত্র কয়েকজন, বাকীরা সবাই কাট-পেস্ট করে সিভি তৈরি করেছে,
- জব-অরিয়েন্টেড সিভির ধারণা সম্ভবত একজনেরও মাথায় ছিল না। ফলে, কয়েকপাতার সিভি থেকে আমাদের কাঙ্খিত যোগ্যতা খুঁজে নিতে কষ্ট হয়েছে।
কয়েকটি কারিগরি পয়েন্ট
- অনেকেরই সিভির ফাইলটির নাম অদ্ভুত- updateCV, ssss, xxxx, scscss, asdfg, final ইত্যাদি। ব্যাপারটি ভযাবহ কারণ এভাবে পাঠানো সিভি কেমনে এইচআর দেখে আমি জানি না। আমরা অবশ্য এই কারণে কাউকে বাদ দেইনি। দিলেও কেও মনে হয় দোষ দিতে পারতেন না
- সিভির ফাইল (ডক বা পিডিএফ)টির ফরম্যাটিং-এর কোন বালাই নাই,
- যারা হার্ডকপি পাঠিয়েছেন তাদের বেশিরভাগই না দরখাস্ত না সিভি কোথাও স্বাক্ষর করেননি,
- একজন একটা ছোট চিরকুটে কভার লেটারটা লিখেছেন,
- দুইটা হার্ডকপি সিভি পেয়েছি যেখানে শুধু নাম আর বাবার নাম ভিন্ন, বাকী সবই একই! মানে দ্বিতীয়জন সামান্য এদিক ওদিক করার সময় পাননি।
আমার সিদ্ধান্ত
- আবেদনকারীদের সিংহভাগই চাকরি পাবার জন্য আবেদন করেননি, করার জন্য করেছেন
- সিংহভাগই বিজ্ঞপ্তিটি ঠিক মতো পড়েন নি
- বেশিরভাগই সিরিয়াস নন
আমি কোন এইচআর বিশেষজ্ঞ নই, তবে আমার চাকরি সংক্রান্ত বোর্ডে থাকার অনেক অভিজ্ঞতা আছে। এই অভিজ্ঞতা পিওন, চাপরাশি থেকে শুরু করে হেড অব বিজনেজ, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিজনেজ ডেভেলপমেন্ট, প্রোগ্রামার, সরকারি, বেসরকারি- সবই আছে। এসব জায়গায় বড় বড় এইচআরদের সঙ্গে থেকে আমি কিছু বিষয় লক্ষ করেছি। তার আলোকে কিছু সুপারিশ ভবিষ্যৎ চাকরি প্রার্থীদের জন্য করছি।
প্রথমে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী
যারা সিভি আর দরখাস্ত দিয়ে চাকরি পেতে চান তাদের একথা মনে রাখতে হবে যে, সিভি আর কভার লেটার হল তার সিংহ দরজা। সেটার ওপরে নির্ভর করে তার পরের ধাপে উত্তরণ। এখানে পরের ধাপ হল প্রথম বাছাই-এ টিকে যাওয়া। হাজার হাজার সিভি থেকে নিজেদের কাঙ্খিত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা যখন এইচআরের লোকেরা খুঁজে তখন তারা যেন সহজে সেটা পায়। বাজারে যে ফরম্যাটগুলো পাওয়া যায় সেগুলোর বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নাই। আমার অভিযোগ একটাই। তোমার সিভি দেখে যেন এটাঅন্য কারো সিভি মনে না হয় সেটার নিশ্চয়তার ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে।
সিভিতে তাই কয়েকটা বিষয় খুব পরিস্কার করে থাকা দরকার বিশেষ করে যারা এন্ট্রি পজিশনে ঢুকতে চাও-
- তোমার শিক্ষাগত যোগ্যতা (বিজ্ঞপ্তিতে যা চাওয়া হয়েছে তা কী তোমার আছে? )
- শিক্ষার সঙ্গে সরাসরি যায় না কিন্তু দরকারী এমন কিছু যোগ্যতা কী কী তোমার আছে? (তোমার সফটস্কিল কেমন? সফটস্কিল কিন্তু কেবল কম্পিউটার রিলেটেড নয়। তোমার লিডারশীপ, কমিউনিকেশন, টিম স্পিরিটের ব্যাপার ইত্যাদি)
- খালি পড়ালেখা করেছ না অন্য অনেক কিছু করেছ যেমন দুর্গতদের জন্য রুটি বানিয়েছ বা রুটি বানানোয় সহায়তা করেছ, শীত বস্ত্র বিতরণে কাজ করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনে কাজ করেছ, এসব)
- যদি কোন অভিজ্ঞতা থাকে, সেটা। (না থাকলে নাই,
রাইট ওয়ান্স, সেন্ড মেনি নয়
দয়া করে জীবনে একবার মাত্র সিভি লিখো না। প্রতিটা চাকরি কিন্তু আলাদা এবং প্রত্যেকেই তোমার কাছ থেকে তার চাকরি অনুসারে সিভি আশা করে। গড়পড়তা সিভির উৎরে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। উদাহরণ দেওয়া যাক –
একটি কোম্পানি লোক খুজছে নেটওয়ার্কিং-এর। তুমি চার বছরে তিটা প্রজেক্ট করেছ, ফাইনালটা সহ। তার মধ্যে একটামাত্র নেটওয়ার্কিং রিলেটেড বাকী দুইটার একটা ডেটাবেস ম্যানেজমেন্টের। তুমি সেই দুইটা সম্পর্কে বিস্তারিত লিখলে কারণ সেটার ক্রেডিট আওয়ার বেশি ছিল। কিন্তু তুমি যে ফাঁকতালে একটা সিসিএনএ করেছে সেটা কিন্তু লিখলে না। কারণ তুমি দেখেছো ওরা সেটা চায় নাই।
আবার কেও হয়তো প্রমোশনাল বা মার্কেটিং ইন্টার্ন খুজছে। যেহেতু তোমার প্রথম চাকরি কাজে কেও তোমার চাকরির অভিজ্ঞতা খুঁজছে না। ওরা খুঁচছে এমনকিছু তোমার আছে কী না যা তোমাকে প্রমোশনাল একটিভিটির সঙ্গে মেলানো যায়। সেটা কী হতে পারে? বিতর্ক। আর একটা হতে পারে তুমি যদি কলেজে পড়ার সময় কোন প্রোগ্রাম অর্গানাইজ করো। কারণ একটা প্রোগ্রামকরতে হলে প্রচুর মানুষের কাছে তোমার প্রোগ্রাম কনসেপ্ট “বিক্রি” করতে হয়।
তুমি যদি তোমার সিভিকে চাকরিদাতার চাহিদা অনুসারে সাজাতে পারো তাহলে প্রথমধাপ পেরোনোটা সহজ হয়।
চাকরি দাতার মনোভাব বোঝা
এটার জন্য প্রথম কাজ হলো চাকরির বিজ্ঞাপনটা প্রথমে ৫ বার পড়া। তারপর একটা লালকলম নিয়ে আবার ৫ বার পড়া। এবারের উদ্দেশ্য হবে কী পয়েন্টগুলোকে আইডেন্টিফাই করা। তারপর সেই কী পয়েন্টগুলোকে আলাদা ভাবে লিপিবদ্ধ কর একটা ছক আকারে। যার একদিকে থাকবে কী পয়েন্ট অন্যদিকে থাকবে কীসের ভিত্তিতে তুমি নিজেকে ঐ যোগ্যতার মনে করছো তার পয়েন্ট। তোমার হিসাবে যদি তুমি ৬০% এর বেশি ম্যাচ করতে পারো তাহলে তুমি ঐ চাকরির জন্য এপ্লাই করো। নতুবা গ্যাপ পূরণের জন্য মাঠে নাম।
এরপর তুমি ঐ কোম্পানি সম্পর্কে জানো। আমরা অনেক সময় ভাবি যে, ঐটিতো বিখ্যাত কোম্পানি। কাজে সবই তো জানি। ভুল। তোমাকে অবশ্য আলাদা করে জানতে হবে। কারণ ঐটা দরকার। এজন্য ঔ কোম্পানিতে চাকরি করে এমন কাউকে খুঁজে বের কর। না পেলে ওদের ওয়েবসাইটে যাও। নিচের পয়েন্টগুলো খুঁজো-
- ওদের মূল কাজ কী?
- ওদের সেবা ও পণ্যগুলোর তালিকা তৈরি কর
- কোম্পানির কোন কোর ভ্যালু কী আছে? থাকলে সেটা নোট ডাউন করো
- কোন বিশেষ কর্মসূচি কী আছে (যেমন বিএটি পরিবেশের জন্য কাজ করে,এইচএসবিসি ২০৫০ সালের ভবিষ্যৎ নিযে একটা রিপোর্ট করেছে যেখানে বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে)।
এরপরের কাজ হবে নিজের সিভিটাকে এই লাইনে সাজানো। তাহলে তোমার প্রথম কাজটা হবে।
আমি এই লেখাটা কেন লিখেছি জানি না। আমার খালি মনে হয়েছে, আমাদের চাকরি প্রত্যাশীরা যদি একটু সতর্ক
হতো তাহলে আক্ষেপের মাত্রা এত বেশি হতো না। আমার পক্ষে তাদেরকে সহায়তা করার কোন বুদ্ধি নাই। চাকরি চাই নামে একটা ফেসবুক গ্রুপ আমরা খুলে রেখেছি এই নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা থেকে। চাকরি চাই গ্রুপে এখন প্রায় হাজার চারেক সদস্য আছে।
ঢাকা এবং বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসব নিয়ে অনেক ক্যারিয়ার মেলা-টেলা হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবশ্য সে সুযোগ হয় না। একটা কারণ মনে হয় এগুলোর কোন স্পন্সর নাই।
একটা ছোটখাটো ম্পন্সর পেলে আমি নিজে বেগার খেটে কিছু কর্মশালা করতে চাই।
কিন্তু অলসদের দিয়ে কী হয়? আলসেমি ছাড়া।
2 Replies to “চাকরি চাই-১: আবেদনের আগে”