ইমোশনাল মার্কেটিং-৯ : চাই সঠিক কৌশল-২
ইমোশনাল মার্কেটিং-৮ : চাই সঠিক কৌশল-১
কমিউনিটি গড়ে তোলা
আপনি ফেসবুকে একটি গ্রুপ করতে পারেন, বাস্তবে একটি সংগঠনও করতে পারেন। কিন্তু যাই করুন না কেন সেটা যেন সরাসরি আপনার মার্কেটিং-এর অনুসঙ্গ না হয়। এটি আসলে হবে একটি প্ল্যাটফর্ম যা আপনার সঙ্গে আপনার ক্রেতা, ব্যবহারকারীদের যুক্ত থাকার একটি জায়গা। আপনি শুরু করবেন খুব কাছের ক্রেতা/ব্যবহারকারীদের দিয়ে। তারপর আস্তে আস্তে অন্যদের যুক্ত করবেন। এই ধরনের কমিউনিটি আপনার ব্র্যান্ডের ব্যাপারে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ট্রিগারের কাজ করবে।
কমিউনিটির সদস্যরা, যারা কিনা কোন না কোনভাবে আপনার প্রোডাক্ট ব্যবহার করে, পরস্পর পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠে। বাংলাদেশে এই ধরণের কমউনিটির সবচেয়ে সফল উদাহরণ হচ্ছে দৈনিক প্রথম আলো’র বন্ধুসভা। যদিও বন্ধুসভা বা পাঠকদের সংগঠনের আইডিয়া বাংলাদেশে প্রথম নিয়ে আসেন সাপ্তাহিক যায় যায় দিনের (বর্তমান দৈনিকের পূর্বরূপ) সম্পাদক শফিক রেহমান। সম্ভবত আশির দশকে তৎকালিন স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ যায় যায় দিন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। পরে আবার ঐ নিষেধাজ্ঞা উঠেও যায়। তখন যায় যায় দিনের উদ্যোগে দেশব্যাপী রিডার্স রাইটস ফোরাম গঠন করা হয়। তবে, যায় যায় দিনের ধারণাটি পাকাপোক্ত হয় ১৯৯৩ সালে দৈনিক ভোরের কাগজ প্রকাশের পর। ভোরের কাগজে শিল্পী সঞ্জীব চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঠক সমাবেশ নামে একটি সংগঠন গঠিত হয়। ভোরের কাগজের সম্পাদক মতিউর রহমান যখন দলবল নিয়ে এসে প্রথম আলো প্রকাশ করেন, তখন প্রথম আলোর পাঠক সংগঠনটির নাম হয় বন্ধু সভা।
আমেরিকায় এ রকম সংগঠনের উদাহরণ হলো টমসের (TOMS) কমিউনিটি। টমসের দোকান থেকে আপনি যদি একজোড়া জুতা কেনেন তাহলে একই দামের আর এক জোড়া জুতা আর্জেন্টিনায় জুতাহীন লোককে দেওয়া হয়। এটিই তাদের জুতা বিক্রির সাফল্য। জুতা কেনার সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতাকে তাদের বিদ্যমান কমিউনিটিতে যুক্ত করে দেওয়া হয়।
এখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের বিকাশের ফলে ব্র্যান্ডভিত্তিক কমিউনিটি গড়ে তোলাটা কঠিন নয়। খালি কমিউনিটি সদস্য ও ফ্যান-ফলোয়ারের মধ্যে পার্থক্যটা মাথায় রাখবেন।
এই ধরণের কমিউটনি কেমন করে আপনাকে সাহায্য করে ব্র্যান্ড বিল্ডিং-এ?
প্রথম এখানে যে কোন ব্যবহারকারী তার কোন অভিযোগ জানাতে পারে। আপনি যদি ঠিকঠাকমতো অভিযোগের জবাব দেন, তাহলে কমিউনিটির কাছে আপনার জবাবদিহীতা স্পষ্ঠ হয়। অন্যদিকে ব্যবহারকারীরাও একটি জায়গা পেয়ে যায় যেখানে তারা তাদের সমালোচনা করতে পারে। আপনার মনে হতে পারে এর সঙ্গে আপনার প্রোডাক্ট নিয়ে সরাসরি সমালোচনার পার্থক্য কী?
আছে। শুরুতে আপনি এই কমিউনিটি তৈরি করবেন পরিচিত ক্রেতাদের মাধ্যমে। এবং এখানে আপনি সবাইকে নতুন কিন্তু আপনার ব্র্যান্ডের ব্যবহারকারীদের জায়গা করে দেওয়ার সুযোগ দিবেন। ফলে এই কমিউনিটির মধ্যে আপনার ব্র্যান্ডের প্রতি এক ধরণের ওউনারশীপ ডেভেলপ করে। ফলে, তারা যত্নবান হয়ে উঠে। এরা যেহেতু আপনার নিয়মিত খদ্দেরে পরিণত হয় তখন তারা এমন একটা প্ল্যাটফর্ম খুঁজে যেখানে আপনার সমালোচনা করা যাবে কিন্তু সেটি নতুন গ্রাহক তৈরিতে আপনার জন্য কোন সমস্যা তৈরি করে না। ফেসবুকের ফ্যান পেজে গিয়ে সমস্যা বললে সেটা বরং উদ্যোক্তাকে বিব্রতও করতে পারে।
এটিতো গেল আপনার দিক। এবার অন্য একটা উদাহরণ দেখতে পারেন। ধরুন আপনার একটি বুটিক হাউস আছে এবং আপনি তার জন্য ফেসবুকে একটি গ্রুপ তৈরি করেছেন। এটি অবশ্য একটি সিক্রেট গ্রুপ হবে যাতে সেখানকার একটিভিটি কেবল মেম্বাররাই দেখতে পায়। এখন সেখানে আপনার গ্রাহকদের কেউ একজন অন্য কোন বুটিক হাউসের একটি শাড়ির ছবি দিতে পারে। দিয়ে আপনার কাছে জানতে চাইতে পারে এমন শাড়ি আপনার আছে কী না। তখন আপনি তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন। অন্য একজন হয়তো শখের বশে ডিজাইন করেন। এবং নিজের ডিজাইন করা জামার ছবি ঐ গ্রুপে দিতে পারেন। তখন আপনি তাকে এপ্রিসিয়েট করতে পারেন। এভাবে ঐ কমিউনিটিটা হয়ে উঠবে আপনার সেকেন্ড ফ্যামিলির মতো।
এই ঘটনার সূত্রপাত হয় যখন টমসের উদ্যোক্তা ব্লেইক মাইকোস্কি ২০০৬ সালে আর্জেন্টিনাতে যান। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন শত শত ছেলে-মেয়ে রাস্তায় খালি পায়ে চলাচল করে। এর পর তিনি দেখলেন জুতার অভাব আর্জেন্টিনা ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর এক বড়ো সমস্যা। সামান্য জুতার অভাবে শিশুদের যেমন নানা রকমের অসুখ-বিসুখ হয় তেমনি তারা খালি পায়ে স্কুলে যেতেও আগ্রহী হয় না। খালি পায়ের কথা মনে হলেই আমার বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার কথা মনে হয়। শেওড়াতলী থেকে ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে পড়তে আসার সময় মেঘনাদ সাহা খালি পায়েই এসেছিলেন।
আর্জেন্টিনার শিশুদের জুতার অভাব দূর করার জন্য ব্লেইক “ওয়ান ফর ওয়ান” মডেল উদ্ভাবন করেন। কেউ যদি টমসের জুতা কেনে, তাহলে তার কোম্পানি এক জোড়া জুতা আর্জেন্টিনায় একজন জুতাহীন শিশুকে পৌঁছে দেবে। এরকম প্রথম ১০ হাজার জোড়া জুতা অক্টোবর ২০০৬ সালে আর্জেন্টিনায় পৌঁছে। এ প্রক্রিয়া এখনও বিদ্যমান আছে। আর জুতা বিক্রি করার জন্য ব্লেইক দুই পায়ে দুই রকমের জুতা পড়তে শুরু করেন, মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন করার জন্য।
প্রথম আলো বন্ধুসভার কাজকর্ম দেখলে আপনি ব্র্যান্ড বিল্ডি-এ কমিউনিটির ভূমিকা দেখতে পাবেন। শুরুতে প্রথম আলো’র পাঠকদের সংগঠন ঞলেও এটি এখন দেশের তরুণদের অন্যতম বৃহত্তম সংগঠনে পরিণত হয়েছে। প্রথম আলো’র নানা সামাজিক উদ্যোগের পাশাপাশি এর সদস্যরা বিতর্ক, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, বিভিন্ন দিবস উদযাপন, লাইব্রেরি গঠন এবং দরিদ্র বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিতদের পাশে দাঁড়ান। আখেরে এ সবই প্রথম আলো’র জমার ঘরে জমা হয়। দেশে অনেক প্রিন্ট মিডিয়ার এরকম পাঠক সংগঠন বর্তমানে কার্যকর রয়েছে।
পরের পর্ব : ইমোশনাল মার্কেটিং-১০ : চাই সঠিক কৌশল-৩
2 Replies to “ইমোশনাল মার্কেটিং-৯ : চাই সঠিক কৌশল-২”