ই-উদ্যোক্তা হাটের উদ্যোক্তা-৬ : মাহমুদের টি আর্ট
গণিত অলিম্পিয়াডের কারণে অনেকে আমাকে পাগল বলে। আমার এক বন্ধু বলেছিল – টাকা পাস না, অফিসের ছুটি ফ্যামিলিকে না দিয়ে সারাদেশে ঘুরে বেড়াস। আর ইউ ম্যাড?
হ্যা। আমি এবং আমাদের মতো অনেকই আসলে ম্যাড। পাগল। কিন্তু এই পাগলামী আমাদের অনেক আনন্দ আর ভালবাসায় আবদ্ধ করেছে। দিনশেষে আমার মনে হয় আল্লাহ তায়ালা যে আমাকে এই সুযোগ দিয়েছেন এটা তাঁর একটি বিশেষ নেয়ামত। আলহামদুলিল্লাহ!
গণিত উৎসবের সঙ্গে সারাদেশে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে পরিচয় হয়েছে হাজারো স্বপ্নবাজ তরুণের সঙ্গে। নি:স্বার্থভাবে নিজেকে উৎসর্গ করেছে দেশের জন্য। এমনই একজন মাহামুদ, পুরো নাম : মোঃ মাহামুদুল আলম, ‘একজন চা শিল্পী”। নিজেকে সে পরিচয় দিতে পছন্দ করে, চায়ের কারিগর বা কামলা হিসেবে। বাড়ি – বরিশাল।
তাকে আমি চিনি ২০০৪ সাল থেকেই, বরিশাল বন্ধুসভার একজন সদস্য হিসেবে। যাদের কাজের ওপর ভর করে আমার অনেক নাম-ডাক, মাহমুদ তাদেরই একজন। ম্যাথ অলিম্পিয়াড সারা দেশে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে এইসব তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের ভূমিকাই আসল। অদ্রিতলে এই সব শিলাখন্ড বহে অদ্রিভার।
জীবন সংগ্রামে পোড় খাওয়া এই ছেলেটি আজকে স্বপ্ন দেখে- নতুন কিছু করার, নতুন কিছু চিন্তা করার।
২০০৬ থেকে চা বাগানে চাকরি করা মাহামুদ কাজ করেছে জেমস ফিনলে , কাজী & কাজী, রুথনা , ইস্পাহানি এবং সর্বশেষ হালদা ভ্যালি তে। কাজের ক্ষেত্রে নীতির সাথে আপোষ না করা এই ছেলেটি তার স্বল্প জীবনে দেখেছে মুদ্রার দুই পিঠই। উৎখান-পতনের ক্লাইমেক্স ভরা তাঁর ক্যারিয়ার, যা তার মনোবল ভেঙে দেয়নি, বরং জাগিয়ে দিয়েছে নতুন কিছু করার স্পৃহা। নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য একটি আদর্শ উদাহরণ। যে ছেলেটির নিজের জুতো পর্যন্ত হাত লাগিয়ে খুলতে হতো না, সে নিজেই তার প্রোডাক্ট ডেলিভারি করে ঢাকার রাজপথে। যার নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে চলাফেরা করার কথা, সে অনায়েসেই পথ চলে পাবলিক বাসে রড ধরে ঝুলে ঝুলে।
করোনা লোকডাউনের আগেই, অভিমান করে চাকরি ছেড়ে দেন মাহামুদ। অনিশ্চিত ভবিষ্যতে পড়ে যান, কারণ এপ্রিলেই তার অন্য একজায়গায় জয়েন করার কথা। মার্চের লোকডাউন শুরু হয়ে গেলে আক্ষরিক অর্থেই বিপদে পরে যায় সে। কিন্তু, বিচলিত না হয়ে ঘরে বসেই সে পরিকল্পনা করতে থাকে…. কিভাবে নিজেকে এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেবে। চা ছাড়া আসলে সে কিছুই জানেনা। শেষমেশ , সিদ্ধান্ত পাক্কা – চা নিয়েই সামনে আগাবে। পরিচিত অনেকের সঙ্গেই শেয়ার করলো তার আইডিয়া- কেউ আস্থা রাখেনি তার উপর। ২৫-৩০ জনের সঙ্গে আলোচনা করার পর মোটে ৩ জন ভরসা রাখলো তার আইডিয়া’র উপর। সকলেই ছা-পোষা চাকুরে। এইভাবে করোনাকালে জন্ম হলো একটি উদ্যোগের “টি আর্ট “, যখন অনেক উদ্যোগই বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো এক এক করে। করোনা জন্ম দিলো একটি উদ্যোগের, একটি স্বপ্নের।
এই নিয়ে মাহামুদের সঙ্গে সম্প্রতি আমার কিছু কথা হয়েছে। এখানে তার নির্বাচিত অংশ –
মুনির হাসান: উদ্যোগের নাম কেন “টি আর্ট”?
মাহমুদ: আমি চা নিয়ে কাজ করি। চা ছাড়া আমি আমি অন্য কিছু জানিনা। চেষ্টা করি, চা দিয়ে নতুন নতুন কিছু করার। যিনি গান গান- তিনি যদি কণ্ঠশিল্পী হন , যিনি ছবি আঁকেন – তিনি যদি চিত্র শিল্পী হন , যিনি ভালো রান্না করেন- তিনি যদি রন্ধনশিল্পী হন…… তবে আমি চা নিয়ে কাজ করলে- আমি কেন চা শিল্পী হবো না!!!! সেই চিন্তাধারা থেকেই “টি আর্ট” বা চা শিল্প নামের উৎপত্তি।
মুনির হাসান: অনেক কিছু থাকতে, এইটা কেন বেছে নিলে?
মাহমুদ: ব্যবসার একটি বেসিক কথা হচ্ছে, ‘যে যেই জিনিষটা সম্পর্কে মোটামুটি জানে, তার সেটা নিয়েই সামনে আগানো উচিত’। আমি চা ছাড়া আর কোনো বিষয়ে কিছু জানিনা। তাই আমার কাছে মনে হয়েছে, আমি চা নিয়ে কাজ করলে, দেশকে নতুন কিছু দিতে পারবো। চায়ের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে, দেশের মানুষকে নতুন নতুন চা উপহার দিতে পারবো। এই দেশে মানুষ চা বলতে শুধু – রং চা , দুধ চা (আর কিছু মানুষ গ্রীন টি) ছাড়া আর কিছু জানেনা। চায়ের যে কতরকম ভ্যারাইটি আছে (এক দিলমাহ’র এইদেশে ১৮ ক্যাটাগরির গ্রীন টি দেখেছে), কতরকম ফ্লেভার আছে, সেগুলো তৈরী করে দেশের মানুষের কাছে সহজলভ্য করতে চাই। চা নিয়ে আমার অনেক পরিকল্পনা, স্বপ্ন। আল্লাহ কবুল করলে, আর সবার সহযোগিতা পেলে, দেশের চা শিল্পে একটি বিরাট বিপ্লব আনতে চাই। স্পেশালটি টি (বিশেষায়িত চা) কে এইদেশে সহজলভ্য করে তুলতে চাই, সুযোগ পেলে রপ্তানি করতে চাই।
মুনির হাসান: ই-কমার্স যুগে ফেইসবুক খুললেই এই উদ্যোগ নিয়ে কাজ করা হাজারটা উদ্যোগ দেখা যায়। সবার সঙ্গে নিজের পার্থক্য করে, নিজেকে কিভাবে আলাদা করবে ?
দ্বিতীয়ত স্পেসিয়ালটি টি (বিশেষায়িত চা ) নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা কারো নেই। তারা মার্কেট থেকে কালেক্ট করে সেল করে, আর আমি নিজে বানিয়ে সেল করবো। তাই, কাস্টমার ইউনিক প্রোডাক্ট পাবে।
তৃতীয়ত , আমাকে কেউ চা গছিয়ে দিতে পারেনা। আমি নিজে টেস্ট করে সন্তুষ্ট হলেই পারচেজ করি… নয়তো না। তাই, সবসময় একই স্ট্যান্ডার্ডের চা আমার কাছে পাবে কাস্টমার। স্ট্যান্ডার্ড ঠিক না থাকলে, আমি সেই প্রোডাক্ট সাময়িকভাবে সেল করা বন্ধ রাখবো।
চতুর্থত বিশ্বসেরা চা বানানোর ফর্মুলা আমি জানি বা বানাতে পারি। দেশের মানুষকে এটি উপহার দেবার কোনো সুযোগ নেই অন্যান্য স্টার্টআপের।
পঞ্চমত, আমি ইন্টারন্যাশনাল টি মাস্টার সার্টিফিকেটধারী। ফিল্ড টু ড্রয়িং রুমে পরিবেশিত চা…… প্রতিটি সেক্টরে কাজ করার বিরল সুযোগ অন্যদের নেই।
মুনির হাসান: নিজের উদ্যোগকে সফল হিসেবে দেখতে কোনটাকে বাধা হিসেবে মনে করছো ?
মাহমুদ: স্পেসিয়ালটি টি আমার স্বপ্ন। এইটাকে স্টাব্লিশ করা আমার প্রধান টার্গেট। কিন্তু, এদেশের মানুষ এই চা সম্পর্কে একদমই জানে না। শুধু গ্রীন টি’র নাম জানে। এটাকে পরিচিত করা একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। আপাতদৃষ্টিতে স্পেসিয়ালটি টি অনেক দামি চা। দাম অবশ্য উসুল হয়, এগুলোর রি-ইউসের মাধ্যমে। দামি চা কেনার ক্ষেত্রে, চায়ের মূল্য একটি প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে, ঠিক ভাবে প্রচারণা – লেখালেখি করে সচেতনতা আর মানুষের জ্ঞান বাড়ানো গেলে এটার প্রতি মানুষের আস্থা বেড়ে যাবে।
সবচেয়ে বড় বাধা টাকা। স্পেসিয়ালটি টি বানাতে মেশিন পত্র কেনা একটি মাঝারি ধরণের ইনভেস্টমেন্ট প্রয়োজন, যেটা এরেঞ্জ করাটা আমার জন্য একটু টাফ হবে, কারণ আমাকে কোনো ব্যাঙ্ক আইডিয়ার উপরে বিনিয়োগ করবে না। আর আমরা আক্ষরিক অর্থেই অতি ক্ষুদ্র স্টার্টআপ।
মুনির হাসান: চা নিয়ে আর কি কি পরিকল্পনা আছে?
মাহমুদ: চা নিয়ে আমার অনেক বড় পরিকল্পনা আছে। প্রথমটাতে সফল হলে, এর সাথে সাথে অন্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু করবো। সেগুলো আপাতত বলতে চাচ্ছি না, কারণ এদেশে আইডিয়া চুরি হয় প্রতিনিয়ত। তবে, এতো টুকুই বলতে পারি…. পরিকল্পনাগুলো সফল করতে পারলে, দেশের প্রচুর লাভ হবে, বিভিন্ন জিনিসের আমদানি নির্ভরতা (অবশ্যই চা কেন্দ্রিক ) অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
মাহমুদের টি-আর্টের খোঁজ পাওয়া যাবে এখানে