ধানের মানুষ, আমাদের গানের মানুষ
সেই প্রথম থেকে, এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে যখন মানুষ বসতি গড়তে শুরু করে, তখনই মানুষ জংলি ঘাসের ওপর নির্ভরশীল। কালক্রমে সেই জংলি ঘাসকে বশীভূত করে এই এলাকার মানুষ প্রথম ধানের চাষাবাদ শুরু করে। আমাদের আশপাশের অনেক দেশ, বিশেষ করে এশিয়ার প্রায় সব দেশে ধানই প্রথম ও মূল শস্য। এ এলাকায় বেশির ভাগ মানুষই একসময় শুধু ধান চাষই করত। তো জংলি ধানকে কারা প্রথম বশীভূত করেছে, তা নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক আছে এবং সেই তর্কের আমরাও একটা পক্ষ বটে। কারণ, সম্প্রতি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক দেখিয়েছেন আমাদের দেশেও ধানকে বশীভূত করা হয়েছে; কেবল চীন, জাপান বা কোরিয়ায় নয়। কেবল যে বশীভূত করেছে তা নয়, তাকে দেখেছে মনের চোখ দিয়ে; হ্রদয়ের মাধুরী উজাড় করে ভালোবেসে, নানা বর্ণে-রঙে-রূপে সাজিয়ে নিয়েছে প্রিয় ওই ধানকে। বাংলাদেশের এই ছোট্ট ব-দ্বীপে তাই উদ্ভব হয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশি ধানের জাত। কোনোটি সূক্ষ্ম, ছোট; কোনোটি মোটা, কোনোটি রান্নার পর সুগন্ধী ছড়ায় এলাকাজুড়ে; কোনোটিতে পায়েস হয় অসাধারণ। এসব জাতের ধানের উদ্ভব হয়েছে আমাদের মাঠে।
আমাদের কৃষক বিজ্ঞানীরাই সেগুলোর উদ্ভাবক। কখনো নিজের বাড়ির পেছনের জংলা জায়গায় একা একা, কখনো দলবেঁধে পরীক্ষা করার নেশায় নানা সংকরায়ণের মাধ্যমে হাজার জাতের ধানের জন্ম এই বাংলায়। কালিজিরা, চিনিজিরা, খাসালত, দুমাহি, বিরুই, বিন্নি, সমুদ্রফেঁনা, রাঁধুনী পাগল, টেংরী, বাউরশ, লাল বিরুই, লাঠিশাইল, কাঠারিভোগ, ষাইট্টা, হাজারো জাতের ধানের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার আমাদের গণি মিয়া আর তাঁর সন্তান। তবুও তাঁরা হতদরিদ্র!
১৯৫০-৬০-এর আগে আমাদের ধানের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল এর রূপ, রস, গন্ধ।
ফলনশীলতার ব্যাপার ততটা মুখ্য ছিল না, যতটা মুখ্য হয়েছে সবুজ বিপ্লবের সময়। এ সময় আমরা ধানের ফলনও বাড়াতে শিখলাম। ১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (IRRI) প্রথম উফশী ধান বের করে। আর ১৯৭০ সালে জয়দেবপুরে গড়ে ওঠে আমাদের ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI)। তার পরের প্রেক্ষাপট?
১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীন হয়েছি। জনসংখ্যা সাত কোটি ১৩ লাখ। আর ধান উৎপাদন হলো ১৯৭২-৭৩ সালে ৯৯ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন।
বিআরআরআইর বিজ্ঞানীরা জানেন, নতুন ধারায় আমাদের ধানের ঠিকানা দরকার। শুরুতে ইরির কথামতো তাঁদের কাজ ছিল খর্বাকৃতির আলোক নিরপেক্ষ জাত উদ্ভাবন; পরে তাঁরা এর সঙ্গে মেশালেন আমাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি আর আলো-বাতাসকে। কালক্রমে বিআরআরআই থেকে বেরিয়ে এল ৪০টিরও বেশি উচ্চফলনশীল ধানের জাত। বিআর-২৩, বিআর-১১, বিআর-২৯-এর মতো সাড়াজাগানো ধানগুলো কিন্তু আমরা ওখান থেকেই পেয়েছি। এ ধানগুলো একেবারেই আমাদের নিজস্ব আমাদের আলো-বাতাসে গড়ে ওঠা ধানের সংকরায়ণ।
বিআরআরআইর বিজ্ঞানীরা কেবল ধানের জাত উদ্ভাবন করেই ক্ষান্ত হননি; এই ধানকে নিয়ে গেছেন আমাদের জাতবিজ্ঞানীদের কাছে, মাঠের কৃষকের কাছে। পরম মমতায় আমাদের গণি মিয়ারা সেগুলোকে লালন করেছেন। আজ বাংলাদেশের মোট ধানী জমির ৬০ শতাংশে চাষ হয় ব্রি উদ্ভাবিত জাত। আর তাঁদের অবদান আমাদের মোট ধান উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ।
২০০৭ সালে আমাদের জনসংখ্যা ১৯৭১ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। অথচ ধানের ঘাটতি কিন্তু ১৯৭১-এর চেয়ে কম। কারণ, আমাদের মাঠের আর পরীক্ষাগারের বিজ্ঞানীদের চেষ্টায় এখন দেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণের বেশি! গণি মিয়ার সেই সন্তান তাই এক ঐতিহ্যের ধারক।
তবে পারবে কি সে সেই ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে?
ব্রির সাফল্যের মূলে কিন্তু বিজ্ঞান। সেই সময়কার বিজ্ঞান। যুগ পাল্টেছে, সময়ও পাল্টেছে। সাধারণ কৌল তত্ত্ব থেকে এখন যেতে হবে জিন তত্ত্বে। আমাদের তো সেই ধান দরকার, যা বন্যার সময় নুয়ে পড়ে না, খরায় শুকিয়ে যায় না; সমুদ্রের পানিতে গোসল সেরে সে লকলকিয়ে বেড়ে ওঠে, এমন ধানের জন্য আমাদের দরকার হাল-আমলের বিজ্ঞান। তবে সেই বিজ্ঞান কেবল থাকবে না গবেষণাগারে, সে-ই ছড়িয়ে পড়বে দেশজুড়ে। দেশের সব ধানের ক্ষেতও হবে আমাদের গবেষণাগার।
হরিপদের মতো কৃষকের চোখ খুঁজে ফিরবে নতুন বৈশিষ্ট্যের ধান; সেলফোনের কল্যাণে তার ছবি পৌঁছে যাবে ঢাকায় কিংবা অস্ট্রেলিয়ায়, গণিত অলিম্পিয়াডের স্বেচ্ছাসেবকেরা সেই নমুনা ধান পৌঁছে দেবেন পরীক্ষাগারে কম্পিউটার আর এনালাইজার দিয়ে হবে তার জেনোমিক সিকোয়েন্স। আমরা খুঁজে পাব সেই জিন, যা ঠেকাতে পারে খরা; হেসেখেলে বেড়ায় লবণাক্ততার সঙ্গে। এভাবে হয়তো একদিন আমরা পেয়ে যাব আমাদের স্বপ্নের ধান।
তবে, এ জন্য পাড়ি দিতে হবে অনেক পথ। ২০২০ সালে আমাদের এখনকার দ্বিগুণ মানুষকে তিনবেলা খাওয়াতে হবে, কিন্তু জমি যাবে কমে। পানিও পাব কম। এখন এক কেজি ধানের জন্য প্রায় দুই হাজার লিটার পানি লাগে! তখন তার পরিমাণ কমাতে হবে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো ধানের ওপর নির্ভরশীল নয়। তাই ধান গবেষণায় তাদের আগ্রহেও ভাটা পড়ছে। আমাদের সমস্যা সমাধান তাই আমাদেরই করতে হবে।
দেশের জানা জাতের ধানগুলোর জিনোম সিকোয়েন্স বের করা; সেগুলোয় থাকা আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যের ছন্দ খুঁজে পাওয়া, জিন কেটে জোড়া দিয়ে দরকারি শস্য বানানো এ সবই করা দরকার। মাঠের কৃষকের চোখ আর অভিজ্ঞতা যেন খুব সহজেই আধুনিক বিজ্ঞানসভায় উত্থাপিত হতে পারে, সে জন্য তাকে নিয়ে আসা; ধানের আলোচনাকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ থেকে গ্রামবাংলার হাটে-মাঠে নিয়ে যাওয়া –সব আমাদেরই করতে হবে।
এ সবই আমরা করতে পারব যদি আমরা নজর দিই গণি মিয়ার সন্তানের প্রতি; কৃষিকে যদি অবহেলা না করি, কৃষককে যদি সম্মান জানাই। স্বাধীনতার পর আজ পর্যন্ত আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন ধানের ফলন তিনগুণ বাড়াতে পারা। একঝাঁক বিজ্ঞানী বিদেশের চাকচিক্যের জীবনকে পরিহার করে রাজধানী ঢাকা থেকে দূরে থেকে আমাদের এই অর্জনকে সম্ভব করার পথে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। জাতি কি পারে না বিজ্ঞানীদের সেই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটকে স্বাধীনতা পদকের মতো সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করতে?
যে কৃষক বিজ্ঞানীরা তাঁদের শ্রম, মেধা আর ভালোবাসা দিয়ে আমাদের জন্য আহারের সংস্থান করছেন; তাঁদের জন্য কি রাষ্ট্রের কিছুই করার নেই, সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করা ছাড়া? বছরের একটা দিন কি আমরা ওই কৃষকদের জন্য আলাদা করে বরাদ্দ করতে পারি না? যতটা পথ আমরা পাড়ি দিয়ে এসেছি, তার চেয়েও অনেক সঙ্গিন সামনের দিনগুলো। সবুজ বিপ্লবের সময় চীন, ভিয়েতনাম ও কোরিয়া আমাদের সঙ্গে ছিল। এখন তারা অনেক দূর এগিয়ে গেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ভিত্তি করে। সামনের ধানের লড়াইয়ে আমাদের প্রায় একাকী যেতে হবে।
কাজেই, ধানকে আগের মতো করতে হবে আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ। কৃষক যেন হয় আমাদের আসল বীর। আমাদের ধানের মানুষেরা যদি আমাদের গানের মানুষ হয়ে ওঠে, তাহলেই বিশ্বসভায় আমাদের গান সবাই শুনবে। নচেৎ নয়!