ডেলিভারিং হ্যাপিনেজ ১৯ ও ২০ : ১ নয়, ২০ নয় ২৬৫ মিলিয়ন ও বাজিতে বাজিমাত?
আগের পর্ব : ডেলিভারিং হ্যাপিনেজ ১৮ : এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
১৯. ১ নয়, ২০ নয় ২৬৫ মিলিয়ন
আমাদের অফিসের পুরো ফ্লোরে আমাদের জায়গা হচ্ছে না বলে নতুন ফ্লোরও ভাড়া নেওয়া হল। এমনকী আমরা নিউ ইয়র্ক ও শিকাগোতে আমাদের সেলস অফিসও খুলে ফেললাম। প্রতিদিন ফ্লোরে হাটার সময় আমি নতুন নতুন লোকদের দেখতাম যাদের আমি আগে দেখি নাই, চিনি না এমনকী কে কী কাজ করে তাও জানি না। এটা যে ভাল হচ্ছে না সেটাও আমার কোনদিন মনে হয়নি। সে সময় আমাদের হাইপারগ্রোথের সঙ্গে কোম্পানির কালচারের সম্পর্ক কেমন হওয়া দরকার সেটাও আমরা ভাবতাম না। এখন বুজি এভাবে কাজ করাটা মোটেই ঠিক হয়নি।
আমাদের প্রথম ২৫ জন এমপ্লয়ীকে আমরা (আমি, আলি বা সঞ্জয়) কোন না কোনভাবে চিনতাম আগে থেকে। আমাদের এক ধরণের সিনার্জিও ছিল। আমাদের কোর অবজেক্টিভও একই ছিল। টেকা-টুকার আকর্ষনে আমরা একত্রিত হইনি। বরং সবাই মিলে এক্সাইটিং একটা কিছু করার জন্যই আমরা একত্রিত হয়েছি।
কিন্তু পরে যখন আমাদের টেকা-টুকা হলো, লেনি বা জেরির কথা লোকে জানলো তখন যারা যোগ দিল তাদের সবাই কিন্তু একই উদ্দেশ্যে জমায়েত হয়নি। ওদের কেউ কেউ হয়তো কেবল টাকার জন্যই এসেছে। কেউ কেউ হয়তো ভেবেছে এখানে কাজ করলে পরে ইয়াহু! বা মাইক্রোসফটে চাকরি পাবে। এদের লক্ষ্য ছিল লিঙ্ক এক্সচেঞ্জে কিছুদিন কাজ করে অন্যত্র চলে যাওয়া। এসব কিছু খেয়াল না করেই আমরা ১৯৯৮ সাল নাগাদ ১০০+ জনের কোম্পানিতে পরিণত হলাম।
এরকম একদিন আমি সকালে আমার এলার্ম ঘড়ি থামিয়ে দিলাম পরপর ছয় বার। সপ্তমবারের বার এলার্মের দিকে হাত বাড়িয়ে আমি চমকে উঠলাম। সর্বশেষ আমি এরকম করে ঘড়ি থামাতাম যখন আমি ভাবতাম আমাকে ওরাকলে চাকরি করতে যেতে হবে। সেটা ভাবলেই আমার জ্বর আসতো। আর এখন আমি নিজে একটা কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা, সেটিকে বড়ো করার সংগ্রাম করছি। কাজের অন্ত নেই। তাহলে কেন আমার অফিস যেতে ইচ্ছে করছে না?
কোথাও কী হয়েছে কোন সমস্যা? আমি এমন কোন একজন কর্মীর কথা মনে করতে পারলাম না যে কিনা একাই আমাদের আনন্দের কাজের পরিবেশটা নষ্ট করে ফেলেছে। সেরকম কাউকে আমি পেলাম না। আমি বুঝলাম অনেকে বা সবাই মিলে আমরা একটু একটু করে আমাদের চিন্তা-চেতনার জগৎটাকে অন্যরকম করে ফেলেছি। আমাদের প্রতিষ্ঠানের কালচার আর আগের মতো নেই।
কী করবো বুঝতে পারলাম না কিন্তু দেখলাম এ নিয়ে ভাবারও সময় নেই। কারণ আমার তখন অনেক কাজ। বিশেষ করে নতুন কিছু প্রজেক্ট আর এক্সপানসন নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। এছাড়া আরও একটা অত্যন্ত জরুরী বিষয়ও ছিল। আমরা যেভাবে ভেবেছিলাম সেভাবে আমাদের রেভেনিউ বাড়াটা বন্ধ হয়ে গেল। একটা কারণ রাশিয়ার মুদ্রা রুবল সংক্রান্ত একটা ঝামেলা। এটা আমি নিজে ঠিকমতো বুঝি নাই। আমরা দেখেছি আমাদের রেভেনিউ আরও কমে গেলে আমাদের কোম্পানি লাটে উঠার সম্ভাবনা আছে। সে সময় আমরা শেয়ার বাজারে যাওয়ার জন্য গণপ্রস্তাব (IPO) তৈরিতে হাত দিয়েছি। কিন্তু টের পেলাম সেটাও এখন সম্ভব না। আমরা একটু চিন্তিত হলাম কারণ নগদ টাকার ব্যবস্থা না করতে পারলে বছর শেষে সত্যি সত্যি আমরা লাটে উঠবো।
গণ প্রস্তাবে পিছিয়ে যাওয়া আর রাশিয়ার ঘোড়ার ডিমের ঝামেলার জন্য আমরা ঠিক করলাম আমরা একটা অন্তর্তীকালীন (মেজনাইন) ফান্ড রাইজিং-এর চেষ্টা করবো। বিগত দু বছরে আমাদের খুব ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ইয়াহু!, নেটসক্যাপে ও মাইক্রোসফটের সঙ্গে। আমরা প্রায়শ আলাপ করতাম তাদের সঙ্গে আমাদের কোন স্ট্র্যাটেজিং পার্টনারশীপ নিয়ে। এই ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝতাম না। আমার কাছে এটিকে অন্য পার্টনারশীপের মতোই মনে হয়। কিন্তু শব্দটা বেশ সেক্সি এবং সবাই ব্যবহার করছে দেখে আমরাও করতাম।
আমরা যখন ফান্ড রাইজিং-এর কথা ভাবলাম, তখন আশ্চর্য হয়ে দেখলাম তিনটে কোম্পানিই লিঙ্ক এক্সচেঞ্জে বিনিয়োগে উৎসাহী। আমরা আরও অবাক হলাম যখন আমরা জানলাম নেটসক্যাফে আর মাইক্রোসফট এমনকী আমাদের কিনে নিতেও রাজি আছে।
মাইক্রোসফট মোট ২৬৫ মিলিয়ন ডলার দিতে রাজিহলো।
২৬৫ মিলিয়ন ডলার!!! ২৬৫ মিলিয়ন!!!
এবার কিন্তু আমার সেরকম কোন বিকার হলো না।
মাইক্রোসফট এর সঙ্গে কিছু শর্ত জুড়ে দিল। সেটা হলো আমি, সঞ্জয় ও আলি – আমাদের তিনজনকে লিঙ্ক এক্সচেঞ্জে আরও ১২ মাস থাকতে হবে। যদি আমি ১২ মাস থাকি তাহলে আমি ৪০ মিলিয়ন ডলার নিয়ে বের হতে পারবো। আর যদি না থাকি তাহলে এর ২০% ছেড়ে দিতে হবে কোম্পানিকে।
যদিও লিঙ্ক এক্সচেঞ্জ আর আমার কাছে সেরকম এক্সাইটিং না, তারপরও আমার মনে হলো ঐ টাকার জন্য আমি আরও একবছর থাকতে পারি। এমনভাবে থাকতে হবে যেন আমি ফায়ার না হই। সিলিকন ভ্যালিতে এটি একটি প্রচলিত নিয়ম। সেরকম কোন কন্ট্রিবিউশন ছাড়া নিজের বিক্রি হয়ে যাওয়া কোম্পানিতে থাকা। এটার একটা প্রবচনও আছে – Vest in Peace!
মাইক্রোসফটের সঙ্গে আলাপ আলোচনা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মোটামুটি একটা স্থিরতায় আসলো। চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার আগে একদিন দুপুরে আমি আর সঞ্জয় অফিসের পাশে এক রেস্তোরায় লাঞ্চ করতে গেলাম। সেটি ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাস।
অন্য সময়ের মতো আমরা অনেক গল্প করলাম না। চুপচাপ খেতে থাকলাম। এর মধ্যে আলফ্রেড আমাকে ফোন করে জানালো মাইক্রোসফটের সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি হয়ে গেল। ডিল ইজ ক্লোজড। আমি খবরটা সঞ্জয়কে জানালাম।
সবাই হয়তো ভেবেছে এই খুশিতে আমরা একটা চিক্কুর মেরে লাভ দিয়ে উঠবো এবং ধেই ধেই করে নাচবো। কিন্তু সেরকম কোন অনুভূতি আমাদের হলো না। আমরা খাওয়া শেষ করে চুপচাপ বসে থাকলাম।
তারপর আমি বললাম – আমাদের এখন অফিসে ফেরার দরকার।
তারপর আমরা ধীরপায়ে, চুপচাপ অফিসে ফিরলাম।
২০. বাজিতে বাজিমাত?
কলেজের সমাবর্তনের দিনের কথা মনে পড়লো। সেদিন আমার বন্ধুরা আমার সঙ্গে একটা বাজি ধরে। তারা মনে করেছে পাস করার দশ বছরের মধ্যে আমি একজন মিলিওনিয়ার হবো। আর তাই যদি হয় আমরা সবাই প্রমোদতরীতে বিলাস ভ্রমণে বের হবো। সবার খরচ আমাকেই দিতে হবে। আর যদি ১০ বছরে সেটা না হয় তাহলেও আমরা যাবো তবে সেক্ষেত্রে আমার খরচটা ওরা চান্দা তুলে দিয়ে দেবে। আমার জন্য ব্যাপারট উইন-উইন। হয় আমি মিলিয়নিয়ার হবো অথবা ফ্রিতে একটা দারুণ ট্রিপ পেয়ে যাবো!
লিঙ্ক এক্সচেঞ্জের বেচাবিক্রির পর আমি সত্যি সত্যি মিলিওনিয়ার হয়েছি। কাজে ১৯৯৯ সালের শুরুতে আমরা দলবলে একটা ক্রুজে বের হলাম। ফ্লোরিডা থেকে বাহামা – তিন দিনের ট্যুর। আমার কলেজের বন্ধুরা ছাড়াও আমি আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিলাম। মোট ১৫ জনের একটা দল। হৈ হল্লা, গল্প, আড্ডা আর কলেজের দিনগুলোতে ফিরে যাওয়ার মতো এক আশ্চর্য সুন্দর সময় কাটলো আমাদের। শেষ রাতে সবাই যখন ডিঙ্কের সমুদ্রে অবগাহন করছে তখন আমার মনে সেই প্রশ্নটা ফিরে আসলো। সেই প্রশ্নটা যা মাইক্রোসফটের সঙ্গে ডিল ক্লোজ হওয়ার দিন থেকে আমার মাথায় ঘুরছে – এখন কী? এর পরে কী?
এবং তারপরই কিছু ফলোআপ প্রশ্ন – সাফল্য কী? সুখ কী? আমি কিসের পিছনে দৌড়াচ্ছি?
প্রমোদ ভ্রমণের সময় বা এরপরেও আমি প্রশ্নগুলোর জবাব পাইনি। ক্রুজ থেকে ফেরার পর আমার জীবনটা একটা অটো পাইলটে চলে গেল। দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা, হেলেদুলে অফিস যাওয়া, ই-মেইল চেক করা, আর্লি অফিস থেকে বের হওয়া, এসবই নিয়মে পরিণত হল। আমার হাতে তখন অফুরন্ত ফ্রি টাইম, কী করবো জানি না।
তবে বেশিরভাগ সময় আমি চিন্তা করি। আমার তো আর টেকার দরকার নাই। তাহলে আমি কেন মাইক্রোসফটে ভেস্ট ইন পিসে আছি?
আমি আমার জীবনের সুখের স্মৃতিগুলোর একটা তালিকা করার চেষ্টা করলাম এবং অবাক হয়ে উপলব্দি করলাম এগুলোর কোনটার সঙ্গে টাকার কোন সংস্রব নাই। আমি দেখলাম একটা কিছু বানানো এবং সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী কাজে আমি সুখী। পুরানো কোন বন্ধুর সঙ্গে রাতভর আড্ডা দেওয়াতেই আমি সুখী। মিডল স্কুলে বন্ধুদের ফাঁদে পা দিয়ে আমি খুশী হতাম। সবাই মিলে যখন কোন প্রিয় বন্ধুকে বোকা বানাতাম তখনও আমি খুশী হতাম। সাঁতার কেটে বাসায় এসে আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে আমি সুখী। খাবারের সময় আচার দেখলেও আমি সুখী। (আচারের ব্যাপারটা কেন সেটা আমি ঠিক বুঝিনা। একটা কারণ আচার সুস্বাদু আর একটা কারণ আচর বলতেই আমার ভাল লাগে)।
এই তালিকা করতে করতে আমি টের পেলাম কীভাবে আমাদের সমাজ, আমাদের চারপাশ চিন্তার পরিবর্তে আমাদের এক ইঁদুর দৌঁড়ে নামিয়ে দিচ্ছে। আমরা ভাবছি বেশি টাকা, বেশি সুখ। অথচ শেষ পর্যন্ত জীবনকে উপভোগ করাটাই হচ্ছে সুখ। জীবনের প্রতিটি মুহুর্তকে উপভোগ করতে পারাটাই সুখ।
আমি দেখলাম কীভাবে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নতুন কিছু করে আমি সুখী হই। অথচ এখন টাকার জন্য মাইক্রোসফটে আমি বসে আছি। ইন্টারনেটের বিকাশের এই সময়ে কতো কী করার আছে। এমন কী সব আইডিয়ার পেছনে দৌড়ানোর সময়ও নাই। অথচ আমি কী করছি?
আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। এর কয়েকদিন পরই আমি মাইক্রোসফট অফিসে গিয়ে ইস্তফা দিলাম।আমার ৮ মিলিয়ন ডলার নাই হয়ে গেল কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কারণ আমি তো আর টাকার পেছনে দৌড়াতে চাই না। আমি আমার প্যাশনের পেছনে জীবন উৎসর্গ করতে চাই।
আমি পরে বুঝেছি ঐটাই ছিল আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।
আমি আমার জীবনের নতুন অধ্যায়ের জন্য প্রস্তুত হলাম।
[জাপ্পোসের সিইও টনি সেই-এর বিখ্যাত বই ও দর্শন সুখ বিতরণের কিছু অংশ আমি অনুবাদ করছি আমার মত করে, আমাদের উদ্যোক্তাদের জন্য। এটি আক্ষরিক অনুবাদ নয়]
2 Replies to “ডেলিভারিং হ্যাপিনেজ ১৯ ও ২০ : ১ নয়, ২০ নয় ২৬৫ মিলিয়ন ও বাজিতে বাজিমাত?”