ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড

Spread the love

আমরা এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (ডিডি) নামে একটা বিষয়ের মাঝখানে নাকি আছি। এ নিয়ে অনেক লেখালেখিও হচ্ছে। শাদামাটাভাবে এ হচ্ছে একটা দেশের ডেমেগ্রাফিতে (জনসংখ্যায়) তারুণ্যের আধিক্য। বেশিরভাগ দেশ এ সময়টা কাজে লাগানোর চেষ্টা করে এবং শুরু করে কমপক্ষে দুই দশক মানে বিশ বছর আগে থেকে।
যেমন চিনের ডিডি হয়েছে ২০০০-২০০৩ সালে। এটার পরিকল্পনা ওরা করেছে ১৯৭৮-৮০ সালে, যখন তাদের বেবি বুম হয়।
ভিয়েতনাম করেছে ১৯৯৬-৯৭ সালে। আমি দেখেছি বাড়তি জনগোষ্টীকে কর্মসংস্থানে সহায়তা করার জন্য তারা কয়েকটি নতুন খাতকে শুরুতে বাছাই করে। এর মধ্যে একটা ছিল পর্যটন। একটা দলকে দায়িত্ব দেওয়া হয় দেশের  পর্যটন শিল্পের বিকাশের করনীয় বের করতে। বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় পর্যটন নিয়ে ডিগ্রীর ব্যবস্থা করতে। একটি কমিউনিস্ট দেশ হওয়া স্বত্ত্বেও হ্যানয় ওপেন ইউনিভার্সিটি নিজেরা কোন ডিগ্রী কোর্স ডিজাইন করার ধারে কাছে যায়নি। তারা স্ট্রেট ফরোয়ার্ড বের হয় পৃথিবীর কোন কোন দেশে পর্যটন নিয়ে পড়ালেখার সুযোগ আছে সেটা খুঁজে বের করতে। তারপর তারা কানাডার একটি ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে পর্যটনের ওপর ডিগ্রী চালু করে দেয়। এর মধ্যে প্রথম দলটি দেশের সম্ভাব্য পর্যটনস্থানগুলোকে চিহ্নিত করে এবং সেগুলোকে ৫/১০/১৫ বছর উন্নয়নে ভাগ করে। কাজে প্রথম ব্যাচ যখন হ্যানয় ওপেন ইউনিভাসিটি থেকে বের হয় ততোদিনে তাদের হালং বে এলাকাটা পর্যটনের জন্য তৈরি হয়ে যায়। প্রথম ব্যাচের গ্র্যাজুয়েটরা তখন হালং বে কে বিক্রি করার জন্য উপযুক্ত হয়ে যায়। ওদের ডিডির সময়কালের প্রায় এক দশক আগেই ওদের নতুন সেক্টরগুলির ভিত্তি তৈরি হয়েছে। পর্যটন ছাড়াও সেখানে একাধিক খাত ছিল যার একটি আইসিটি, অন্যটি গার্মেন্টস। ভিয়েতনামের আইসিটি খাতের বিকাশ যেহেতু এ দেশের সবাই জানে তাই এ নিয়ে আলাপ করে কাজ নেই। ওদের এই ট্রান্সপরমেশনে সবচেয়ে বেশি তৎপর ছিল ওদের একাডেমি অব সায়েন্স। এর যিনি হেড থাকেন তাকে ওনারা মন্ত্রীর পদমর্যাদা দেন। এই একাডেমি অব সায়েন্সের একটি ভবনে ২০০৭ সালে একটি বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। সে সময় এ বিষয়গুলোর কিছু কিছুটা জানতে পেরেছি।

এ কথাগুলো বলার অর্থ হচ্ছে, ডিডি থেকে আপনি ফায়দা লুটতে পারবেন কিনা সেটা নির্ভর করে আপনি কীভাবে প্রস্তুত হচ্ছেন তার ওপর। তবে, আমাদের জন্য ব্যাপারটা মোটেই সহজ ছিল না। আমাদের বেবি-বুম হয়েছে এরশাদের আমলের শেষের দিকে। তখন আমরা রাস্তায়, স্বৈরাচারকে টেনে নামাতে হবে। ১৯৯১ সাল থেকে এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করার দরকার থাকলেও ব্যাপারটা তখনো সহজ ছিল না। বাজেটের সিংহভাগ আসে দাতাদের ঋণ ও দান থেকে। প্রথমত ১৯৯১ সালে আমরা শুল্ক নির্ভরতা কাটিয়ে ভ্যাটে ঢোকা শুরু করি। আর আয়করের ব্যাপারটা সামনে আনতে থাকি। গার্মেন্টেসের বিকাশ একটা গতি পায়। কিন্তু পাটের অবস্থা খারাপ হয়। বেসরকারি ব্যাংকিং সিস্টেম মাত্র কাঠামো পেতে  শুরু করেছে। এসব কারণে একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রেক্ষিত পরিকল্পনা আমরা সেসময় করতে পারি নাই বলে আমার ধারণা। (আর কোন কারণ থাকলে সেটা আমার জানা নেই)।

মোটা দাগে আমরা পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ধরে এগিয়েছি। লম্বা চিন্তা ছিল না বা থাকার কথাও না (ইন ফ্যাক্ট আমি স্যারদেরকে ছাড়া কাউকে দোষও দেইনা। এ বিষয়ে তখন পত্রপত্রিকায় কোন কলাম-টলাম আমি দেখি নাই। আমি নিজেই অনেক ছোট ছিলাম মাত্র ২/৩টা পত্রিকা পড়তে পারতাম। আমাদের দেশে যে একাডেমি অব সায়েন্স আছে তারা প্রতিবছর নিজেদেরকে গোল্ড মেডেল দেওয়া ছাড়া আর কিছু করে বলে আমি শুনি নাই। পিএল-৪৮০ এর প্রায় ৯০ কোটি টাকার একটি স্থায়ী আমানত তাদের আছে বলে আমি শুনেছি। কিন্তু তরুণ বিজ্ঞানীদেরকে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গবেষকদের কোন ফান্ড-টান্ড সহজে দেয় বলেও শুনি নাই। যাকগে ধান ভানতে শিবের গীতের দরকার কী? )

এখন যখন আমাদের লম্বা চিন্তা করার সুযোগ হচ্ছে তখন অলরেডি আমরা ডিডিতে ঢুকে পড়েছি। ফলে প্ল্যানিং যেমন দরকার তেমনি কাজও দরকার। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের ৬+ শতাংশের প্রবৃদ্ধি থাকলেও সে হারে কিন্তু কর্মসংস্থান হয়নি।
কাজে এখন একটা স্পেশাল বুষ্ট দরকার। ডিডি’র ফায়দা লুটতে হলে দরকার তরুণদের কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া। তাদের জন্য অনেক কাজের একটা বন্দোবস্ত করা। সেটা কি হচ্ছে? একেবারে হচ্ছে না তা কিন্তু বলা যাবে না। কিন্তু যা হচ্ছে তার চেয়ে বেশি হওয়া দরকার আছে বলে আমার মনে হয়। সবচেয়ে ভাল হতো যদি কিছু সুপারিশ সরকারের হাতে দেওয়া যেতো। যেমন –

ইন্টারনেট ভিত্তিক বিজনেজ লাইসেন্সের জন্য “বর্গফুট” জায়গা লাগবে না।

১০/২০ লাখ টাকা পর্যন্ত তরুণদের বিনা জামানতে লোন দেওয়া যাবে। প্রতি বছর এখাতে কিছু টাকা রেখে দিতে হবে যা এক্সপেরিমেন্টে ব্যয় হবে।

২০২৩ সাল থেকে বছরে গড়ে ১ লাখ ম্যানেজারের দরকার হবে। তাদেরকে কেমনে পাওয়া যাবে? বহুজাতিক, বহৎ দেশী শিল্প মিলে সর্বোচ্চ ২০ হাজার আমরা তৈরি করতে পারবো। তাহলে বাকীদের কোথা থেকে পাওয়া যাবে?

আমাদের দেশে গত দুই বছরে বেশ কিছু বিদেশী বিনিযোগ এসেছে ব্যক্তিখাতে, তরুণ উদ্যোক্তাদের হাতে ধরে। বিদেশী বিনিয়োগের এই সেক্টরটির বিকাশের জন্য করণীয়গুলো ঠিক করা দরকার। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের একটি বড় অংশ কিন্তু কর্মসংস্থান তৈরি করে। কাজে প্রতিবছর আমাদের প্রবাসী তরুণদের পাঠানো রেমিট্যান্সের একটা অংশকে কীভাবে জমি-দালান-ভাই-এর বিয়ের বিনিয়োগের পাশাপাশি বিকল্প বিনিয়োগে আনা যায় সেটাও ভাবা দরকার। আর ব্যক্তিখাতে বিদেশী বিনিয়োগ আসবে স্টার্টআপে সেটার কালচার কেমনে হবে?

এরকম আরও কিছু।

এসব নিয়ে তরুণদের ভাবনাগুলো জানার উপায় কী? কয়েকটা আড্ডা কী দেওয়া যায়?
আমি ভাবছি দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে গিয়ে একটা আড্ডা দিলে কেমন হয় যেখানে তরুণরায় তাদের বিষয়গুলো নিয়ে বলবে? তবে, সেটা সব কিছু মিলিয়ে নয়। মানে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার খেলা নয়।
আর একটু গভীরে, আর একটু ভবিষ্যতের দিকে।

 

One Reply to “ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড”

Leave a Reply Cancel reply