বাজেটে ‘বিপ্লবের’ পদধ্বনি

Spread the love

মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিয়ে আমার এই লেখাটা শুরু করতে চাই। বাজেটের আগে এই কলামে আমি অনুরোধ করেছিলাম আমাদের তরুণদের উৎপাদক হওয়ার পথের বাঁধাগুলো অপসারণের জন্য। উদাহরণ হিসেবে বলেছি, ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার কেউ যদি দেশে সংযোজন করতে চায় তাহলে  তাকে কোন কোন কাঁচামালে ২৮% পর্যন্ত শুল্ক ও কর দিতে হয় কিন্তু বিদেশ থেকে সম্পূর্ণ ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার মাত্র ১ শতাংশ শুল্ক দিয়ে আমদানী করা যায়। অর্থমন্ত্রী তরুণদের এই কথা শুনেছেন এবং  ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার আমদানীর ক্ষেত্রে শুল্ক ১৫ শতাংশে উন্নীত যেমন করেছেন তেমনি এর মূল কাঁচামালের শুল্কও অনেক কমিয়ে দিয়েছেন।

বন্ধ হয়ে যেতে পারে সরসিংদির স্যামসাং-এর সেরফোন সংযোজনের কারখানা

একই সঙ্গে দেশীয় ইলেকট্রনিক্স শিল্পের সম্ভাবনাকে আরও বেগবান করতে সেলফোন উৎপাদকদেরও বেশ কিছু প্রণোদণা দেওয়া হয়েছে। সেলফোন বানানোর যন্ত্রপাতির ওপর শুল্কও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, সেলফোন উৎপাদনকারীদের উৎপাদন পর্যায়ে মুসক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে শর্ত দেওয়া হয়েছে সেলফোনের সকল অংশই অর্থাৎ মুদ্রিত সার্কিট বোর্ড, চার্জার, ব্যাটারি, হাউজিং ও কেসিং – সবই তাকে উৎপাদন করতে হবে! সম্ভবত অধিক উৎসাহের কারণে এটি হয়েছে। কারণ সেলফোনের মতো জটিল ডিভাইসের মাল্টিলেয়ার্ড পিসিবি উৎপাদনের সক্ষমতা এখনো আমাদের তরুণদের হয়নি। তাছাড়া মাত্র গতবছর থেকে প্রাণ পাওয়া একটি শিল্পের পক্ষে এক লাফেই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করাটা মোটেই সহজ কাজ নয়। ফলে এই সুবিধাটুকু হয়তো গ্রহণ করতে পারবে এমন প্রতিষ্ঠানের দেখা সহজে মিলবে না। কিন্ত এই সুবিধা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে কেবল সেলফোন সংযোজনকারী কারখানা সমূহের ওপর আবার ১৫ শতাংশ মুসক আরোপ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে, এখানে আবার ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজারের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কারণ এখন দেশে সেলফোন সংযোজনের ক্ষেত্রে আমদানীর চেয়ে তিন শতাংশ বেশি কর দিতে হবে!

অর্থমন্ত্রী সরাসরি উচ্চারণ না করলেও চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে তাঁর চিন্তা ভাবনার আভাস ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি স্বীকার করেছেন শিল্পখাতে কর্মসংস্থানের হার করে যাচ্ছে। ২০১০ সালে শিল্পখাতে মোট কর্মসংষ্থানের হার ছিল ২২.৩ শতাংশ কিন্তু ২০১৬-১৭ সালে এই হার কমে হয়েছে ২০.৩ শতাংশ। এর জন্য তিনি সঠিকভাবে অটোমেশন ও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারকে দায়ী করেছেন। স্বীকার করেছেন বছরে ২০ লক্ষ কর্মপ্রত্যাশী তরুণদের কর্মসংস্থানের জন্য শ্রমঘন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ করতে হবে। এমন তরুণদের জন্য র সরকারের গৃহীত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিরও বর্ণণাও দিয়েছেন। তবে, অটোমেশন ও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যে সূচনা হয়েছে সেটিকে তিনি আলাদা করে উল্লেখ করেননি।

তথ্য প্রযুক্তি, ইন্টারনেট ইত্যাদির কারণে যে নতুন অর্থনীতি তৈরি হয়েছে বিশ্বব্যাপী তার জন্য দেরিতে হলেও আলাদা একটি খাতের সৃষ্টি করেছেন এই বাজেটে। ভার্চুয়াল বিজনেস নামের এই খাতটিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এ ভাবে –যে কোন ধরণের নিজস্ব বিক্রয় বা ব্যবসা কেন্দ্র ব্যতিত ইলেকট্রনিক নেটওয়ার্ক  ব্যবহারের মাধ্যমে ইন্টারনেট বা ওয়েব বা স্যোসাল মিডিয়া বা মোবাইল এপ্লিকেশন ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম বা অনুরুপ যে কোন মিডিয়া ব্যবহার করিয়া কোন পন্য বা সেবার ক্রয়-বিক্রয় বা হস্তান্তরকে বুঝাইবে তবে টেলিকম অপারেটরদের প্রদত্ত যে কোন ধরণের ভ্যালু এডেড সার্ভিস এর অন্তর্ভুক হবে না  লক্ষ লক্ষ তরুণ যারা ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করে নিজেদের দিন বদলের চেষ্টা করছে এটি তাদের জন্য একটি বড় অর্জন। কারণ আশা করা যায়, এখন স্থানীয় সরকার কাঠামো (সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ) এই ভার্চুয়াল ব্যবসা করার জন্য আমাদের তরুণদের বিজনেস লাইসেন্স (বা ট্রেড লাইসেন্স) দেবেন যার শর্ত হিসাবে “বর্গফুট” পরিমাণ জায়গা বা অফিস থাকার আবশ্যক হবে না। কেবল উদ্যোক্তার জাতীয় পরিচয় পত্রের ওপর ভিত্তি করেই এই লাইসেন্স দেওয়া যাবে। আমি মনে করি ট্রেড লাইসেন্সে এই খাতের পৃথক স্বীকৃতি অনেক অনেক তরুণকে এই খাতে আরও উৎসাহী করে তুলবে।  বর্তমানে প্রায় ২০ হাজারের অধিক উদ্যোক্তা কেবল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই তাদের ব্যবসা করছে। আরও প্রায় ৭৭ হাজার উদ্যোক্তা তাদের ফেসবুক পেজকে ব্যবহার করছেন কোন না কোন কাজে। “বর্গফুট” সংক্রান্ত জটিলতায় এদের অনেকেরই ব্যবসার আইনী অংশটি সম্পূর্ন নয়। “ভার্চিুয়াল বিজনেজ”-এর এই নতুন খাতটি ট্রেড লাইসেন্সে অর্থুর্ভূক্ত হলেই অনেকেই বিজনেজ লাইসেন্স করতে উৎসাহী হবে। যেহেতু এই খাতটি এবারই প্রথম বাজেটে যুক্ত হয়েছে কাজে এই নতুন সেক্টরে ৫% হারে মুসক আলোপের প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে নিলেই ভাল হয় কারণ তাদে তরুণদের প্রণোদণা অনেক বাড়বে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক উত্তম চচ্চা অনুসরণ করে ইন্টারনেটে জায়ান্ট যেমন ফেসবুক, গুগল বাংলাদেশে যে ব্যবসা করছে তার ওপর আয়কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে যা নি:সন্দেহে অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। কেবল মনে রাখতে হবে, এর প্রয়োগ যেন আয়করই থাকে, মুসক হয়ে  না যায়। এটি খুবই সতর্কতার সঙ্গে বাস্তবায়নের প্রয়োজন হবে।
চতুর্থ  শিল্প বিপ্লবের উবার/পাঠাও-এর উদাহরণ আমি আগের কয়েকটি লেখায় উল্লেখ করেছি। উবার এবং পাঠাও যে কেবল গণপরিবহনের সমস্যা কিছুটা লাঘব করেছে তা নয় বরং এর পাশাপাশি তরুণদের জন্য বিকল্প কর্মসংষ্থানেরও ব্যবস্থা করছে। আমাদের মতো দেশে যেখানে সিনজি/রিকশা/বাসচালকের সঙ্গে তুই-তোকারি করার সে অপসংস্কৃতি চালু আছে সেটিরও একটি পরিবর্তনের সূচনা করেছে। বিশ্ববিদ্যারয় পড়ুয়া বিপুল পরিমান শিক্ষার্থী এখন এমনকী শিক্ষাখরচের জন্য রাইড শেয়ারিং-এ আগ্রহী হচ্ছে। এসব কিছু যে ধনাত্মক প্রতিক্রিয়া সমাজে তৈরি করছে যাতে ভাটা পড়তে পারে যদি এখনই এই সেবাকে মুসকের আওতায় আনা হয়, কেননা সেটি আসলে ব্যবহার কারীর ওপর গিয়েই পড়বে। অন্যদিকে আমাদের ভুলে যাওয়া উচিৎ হবে না যে, এই ধরণের নতুন সেবাগুলো বিদেশী বিনোয়গকারীদের প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। সম্প্রতি আমরা দেখেছি বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আমাদের পাঠাও-এর বাজার মূল্য নির্ধারণ করেছে ৮০০ কোটি টাকা! সিঙ্গাপুরের রাইড শেয়ারিং সেবা গ্র্যাবে সম্প্রতি জাপানী টয়োটা কোম্পানির ১০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগও একটি উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

তরণদের এই অসাধারণ উদ্যোগগুলোকে লালন-পালন করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের স্থানীয় তথ্যপ্রযুক্তিখাতকে সহায়তা ও সংরক্ষণের চেষ্টা করছে। ঠিক এখানে এসে আমাদের বাজেটে একটি বিষয় আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেছি। বর্তমানে আমাদের দেশের তরুণদের তৈরি করা সফটওয়্যার কেবল দেশে নয় সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি সফটওয়্যার বিশ্বের ২০টি ভাষাতে অনূদিতও হয়েছে। কাজে, এরকম একটি সক্ষম শিল্প থাকার পরও এবারের বাজেটে বিদেশ থেকে আমাদানী করার সফটওয়্যারের শুল্ক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং মুসক প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে যেখানে মুসকসহ দেশিয় সফটওয়্যার বিপননে কমবেশি ২৭% শতাংশ কর আরোপিত সেখানে বিদেশী সফটওয়্যার মাত্র ৫% করের সুযোগে দেশে ঢুকে পড়বে!!! এই অবস্থান কেবল দেশীয় সফটওয়্যার শিল্পকে ধ্বংস করবে না, যে লক্ষ লক্ষ তরুণের হাত ধরে আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবেলার স্বপ্ন দেখছি তাদেরকে পথে বসিয়ে দেবে। আগামী এক দশকে সফটওয়্যার খাতের রপ্তানি আয়ে তৈরি পোষাক শিল্পের আয়কে ছাড়িয়ে যাওয়ার যে স্বপ্ন দেখছেন ডিজিটাল বাংলাদেশর স্থপতি সজীব ওয়াজেদ সেটি কখনোই পূরণ হবে না।

প্রস্তাবিত বাজেট চূড়ান্ত করার সময় এ বিষয়গুলো মাননীয় অর্থমন্ত্রী মাথায় রাখবেন বলে আমার বিশ্বাস। তাঁকে আগাম ধন্যবাদ জানিয়ে রাখি।

 

 

Leave a Reply Cancel reply

Exit mobile version