সঙ্গীতজ্ঞ গাধা, কুকুর, বেড়াল, মুরগি আর সিড়ি ঝাড়ু–র কাহিনী
রূপকথাবিদ গ্রিস ভাইদের কারণে ব্রেমেনের এই চার সঙ্গীতজ্ঞেদের কথা জানে বিশ্বের প্রায় সব ছেলেমেয়ে। গ্রিস ভাইদের চার প্রাণী শেষ পর্যন্ত ব্রেমেনে না গেলেও বাস্তবের ব্রেমেনে ওই চার প্রাণীর যথেষ্ট আদর। ওরা ব্রেমেনের সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে স্থান পেয়েছে সিটি সেন্টারে, নগরীর আকর্ষণীয় সব স্থানেÑশহরের প্রতীক হিসেবে।
আজ থেকে প্রায় সাড়ে ১২০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জার্মানির ছোট বন্দর নগরী ব্রেমেন। বিশ্বের প্রাকবিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মেধার লড়াই, আন্তর্জঅতিক গণিত অলিম্পিয়াডের সুবর্ণ জয়ন্তী হয়েছে এবার জার্মানির ব্রেমেন শহরে। এই উপলক্ষে বাংলাদেশ গণিত দলের ডেপুটি লিডার হিসেবে আমর সৌভাগ্য হয়েছে জার্মানির দুই শহর দেখার।
সময়, সময়, সময়
এখন ঢাকা থেকেই ইউরোলের টিকেট কাটা যায়। ইন্টারনেটে তো যায়। ব্রেমেন যাবো বলে আমরা ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ট্রেনের টিকেট কেটেছি, ওই ঢাকা থেকে। ১২ তারিখ সন্ধ্যায় আমরা ফ্রাঙ্কফুটে পৌছানোর পর বুয়েটের প্রাক্তন ছাত্র প্রকৌশলী রনি (নাজমুল হুদা) আমাদের এয়ারপোর্টে রিসিভ করে। রেলস্টেশনের পাশেই সে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছে। রেলের টিকেট কাটতে গিয়ে জানলাম, বেশির ভাগ লোকেরই সাপ্তাহিক, মাসিক এমনকী বাৎসরিক টিকেট রয়েছে এবং সবচেয়ে আনন্দের হলো একই টিকেট দিয়ে ট্রেন, বাস কিংবা টামে চড়া যায়। দলবেধে টিকেট করলে কিছুটা ছাড় পাওয়া যায়। আমাদের যেহেতু বাস/ট্রেন যাই উঠতে হবে তাই আমরা গ্র“প টিকেট করলাম। ৫ জনের একটা গ্র“পের সারাদিনের টিকেট হলো সাড়ে চৌদ্দ ইউরো! তা, ট্রেনে করে আমরা গেলাম ফ্রাঙ্কফুর্ট হোস্টেলে, রেল স্টেশনর উল্টোদিকে।
বোঝা গেল, এই সরাইখানাটি মোটামুটি শিক্ষার্থী-যুবাদের প্রথম রাত্রিযাপনের জায়গা। জন প্রতি ২২ ইউরো করে দিয়ে আমরা একটা রুম ভাড়া করে বের হয়ে পড়লাম রনির সঙ্গে। বাক্সপেটরা নিয়ে এবার বস। দুই স্টেশন এগিয়ে আমরা পৌছে গেলাম রনির বাসায়। সেখানে আগে থেকে জড়ে হয়েছে তৌহিদ ও মাসুম। দুজনই দীর্ঘদিন ধরে জার্মানি প্রবাসী। সঙ্গে রনির বউ শারমিন ও তাদের কন্যা øেহা। বাংলাদেশের গণিত দলের জন্য সেখানে ব্যাপক খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। খাওয়া-দাওয়া শেষে নিজেদের হোস্টেলে ফেরার জন্য বললাম রনিকে। ইন্টারনেটে দেখে বললো, বাস আসতে আরো ৯ মিনিট বাকী আছে। আমরা আরো ৫ মিনিট গল্প করতে পারবো! অবাক হয়ে জানলাম বাসার সামনের স্টপেজে কখন বাস আসবে সেটাও ইন্টারনেট থেকে জানা যায়।
হোস্টেলের কক্ষটিতে সব দোতলা-খাট। আমরা সাতজনের সেখানই রাত্রিযাপন। ভোরে সবাই ঘুমে থাকতে আমি বের হলাম ফ্রাঙ্কফুর্ট দেখতে। হাটতে হাটতে চলে গেলাম ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকভবনের সামনে। এটি একটি নতুন চমৎকার বিল্ডিং। তবে সেখানে যাওয়ার আগে আমার চোখে পড়লো একটি পুরনো ব্যাংক ভবন, কমপক্ষে শখানেক বছর পুরনো। পরে জানলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ওই ভবনটিকে পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে।
সকালে আমাদের দলের নাজিয়া আর জেসমিন আক্তার রনির বাসা থেকে আমাদের হোস্টেলে চলে আসে। ইন্টারনেট থেকে আমাদের ট্রেনের প্ল্যাটফরম নম্বর দেখে নিয়েছি। সে মোতাবেক আমরা ট্রেনে উঠবো। রনির কাছে জানতে চাইলাম রেল স্টেশণ থেকে ওর অফিসে যেতে কতো সময় লাগে। বললো, ‘সতের মিনিট’। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে আমাদের ট্রেন ছেড়েছে ঘড়ির কাঁটায় ১১:৪৪ মিনিটে। একচুলও এদিক ওদিক হয়নি। ১১:৪০ এ একটি ট্রেনকে ছাড়তে দেখে আমরা বিভ্রান্ত হয়েছিলাম। তবে,ভুল করি নাই কারণ প্ল্যাটফরমে সাহায্যকারীরা ছিল।
আন্তঃনগর ট্রেনটির গড় গতিবেগ ১৫০ কিলোমিটার হবে। তবে টের পাওয়া যায়নি। ইউরোপের রেলযাত্রার অনেক সুনাম শুনেছি, এবার সেটা টের পেলাম। সঙ্গে জার্মানদের সময় জ্ঞান। কাগজ দেখে সময় মিলিয়ে স্টেশণ বের করাটা আমাদের জন্য খুবই সহজ হয়ে গেল। পথে যেতে যেতে বিস্তীর্ন সবুজ পাহাড়, নদী এবং দুর্গ সবই দেখেছি। কোন ন্যাড়া গাছপালা দেখিনি। পাহাড়ে জুম চাষের চেষ্টাও দেখেছি। তবে, সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি বিভিন্ন স্থানে বায়ুকল আর সৌরপ্যানেল দেখে। যেখানে যেখানে সম্ভব সেখানে জার্মানরা বায়ু বিদ্যুৎতের আয়োজন করেছে। একটা বড় পোলট্রি খামার চোখে পড়লো যার ছাদ জুড়ে সৌর প্যানেল। বোঝা গেল পরিবেশবান্ধব বিদ্যুতের প্রতি জার্মানদের কতো যত্ন!
সাইকেল-রিসাইকেল
কেবল বিদ্যুতের বেলায় নয়। জার্মানদের বেশ কিছু গুণ দেখে আমি বুঝেছি কেন ওরা এতো উন্নত। জ্যাকবস বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটি আগে সেনাবাহিনীর ব্যারাক ছিল। এক যুগ আগে থেকে জার্মানরা তার সেনাবাহিনী হ্রাস করতে শুরু করলে জায়গাটি পরিত্যক্ত হয়। ব্রেমেনের একদল বনিক সেখানে এই আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে তুলেছে। এখানে প্রায় ৯০টি দেশের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে যার মধ্যে আমাদের বাংলাদেশও রয়েছে। ক্যাম্পাসে আমরা ঝুমা, মুনা, রাহুল ও তুহিন – এই চার বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর দেখা পেয়েছি।
ইউরোপের প্রায় সব শহরে সাইকেল আরোহীদের জন্য পৃথক রাস্তা ও ট্রাফিক বাতি। ব্রেমেনও ব্যতিক্রম নয়। ওদের প্রায় সবারই পকেটে মোবাইল ফোন আছে। তবে সেটির ব্যবহার খুব একটা দেখিনি। শুরুতে আমাদের দলের জেসমিন আক্তারের বরাদ্দকৃত রুম খুঁজে পাওয়া যায় নি। একজন স্বেচ্ছাসেবক দেখলাম প্রায় ৪০০ মিটার দূরের ‘পোর্টার লজে’ হেটে হেটে গেল। সেখান থেকে সে কোন ফোন করলো না। চাবি সেখানেও নেই এই খবরটি সে হেটে এসে দিয়েছে। তারপর আর একজন মূল দপ্তরে হেটে গিয়ে নতুন রুমের বরাদ্দ দিয়েছে। যে কয়জন যুক্ত দিল এই কাজে, তাদের কেউ ভুলেও ফোনাফুনি করেনি। ২২টি বাস নিয়ে আমরা একদিন গিয়েছি ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য ওয়াডেন সাগর দেখতে। সাড়ে তিন ঘণ্টার বাস যাত্রায় কোন বাসের গাইড বা চালক অন্য কোন বাসের গাইড বা চালকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একটি শব্দও উচ্চারণ করে নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের রেলস্টেশন থেকে সিটি সেন্টারের যাওয়ার ট্রেন প্রতি ঘণ্টার ২৭ ও ৫৭ মিনিটে ছাড়ে এবং ঠিক ২১ মিনিট পরে গন্তব্যে পৌঁছায়। আমাদের রাতের খাবারের সময় ছিল সন্ধ্যা আটটা পর্যন্ত। আমি, আমাদের দলনেতা ড. মাহবুব মজুমদার ও শ্রীলঙ্কার দুজন একদিন নগর কেন্দ্র থেকে পৌছেছি সোয়া আটটায়। আমাদের সেদিন রাতের খাবার জুটেনি। যতো কিছু পারে ওরা পুনঃ ব্যবহার করে। বোতলজাত পানীয়ের বোতল ফেরত দিলে ৩০ সেন্ট ফেরত দেয়। আমাদের আয়োজকরা বার বার পানির বোতল ফেরত দেওয়ার জন্য বলতো যাতে তারা সেটি আবার ফেরত দিতে পারে।
সব জার্মানকে দেখেছি যাতে ব্যাগ নিয়ে বাজার করতে যান। পলিথিনের কোন ব্যাগ দেখিনি। কিছু প্লাস্টিকের ব্যাগ চোখে পড়েছে। বড় দোকান কাগজের ব্যাগ ফ্রি দিলেও কাপড় বা প্লাস্টিকের ব্যাগ ১০ সেন্ট দিয়ে কিনতে হয়। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ট্রলি নিতে হলে ৫০ সেন্ট জমা রাখতে হয়। ঠিক ঠিক জায়ায় আবার ট্রলি রাখলে ৫০ সেন্ট ফেরত পাওয়া যায়।
সঙ্গীতজ্ঞ, ক্যাথেড্রাল এবং সিড়ি ঝাড়ু–র কাহিনী
গাধার পিঠে কুকুর, তার পিঠে বেড়াল আর বেড়ালের পিঠে মোরগ – এটি ব্রেমেন শহরের প্রতীক। নগরীর বিভিন্ন স্থানে এই স্থাপত্য পাওয়া যায়। ইউরোপের অন্যান্য শহরের মতো নগরের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে পার্ক, খোলা জায়গা। প্রায় সোয়া সহস্র বছর আগের ক্যাথেড্রাল রয়েছে। ক্যাথেড্রালের কাছেই বনিকদের কার্যালয়, চেম্বার অব কমার্স। ব্রেমেন শহরকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে শহরের বণিক সম্প্রদায়। আর পুরোহিতরা সেখানে কোন বাদ সাধেনি।
ক্যাথেড্রালের সঙ্গে রয়েছে একটি পুরনো মদের দোকান। সেখানে রয়েছে প্রায় ৬০০ বছরের পুরনো মদ। তবে মজার বিষয় হলো সেগুলো এতো দামী যে তা আর বিক্রি হয় না।
নগরকেন্দ্রের আশপাশেই রয়েছে কয়েকশ বছরের পুরনো ঘরবাড়ি। কোন কোনটি রেস্তোরা, কোনটি দোকান আবার কোনটি হোলে। তিনশ বছরের পুরনো একটি দেড়তলা বাড়িকে হোটেল বানিয়ে রাখা হয়েছে। নগরের প্রাণকেন্দ্রে একটি মূর্তিও রয়েছে এবং ওখানেই রয়েছে সিটি হল আর নগর সংসদ ভবন। এর মধ্যে কেবল নগর সংসদ ভবনটিই নতুন। বাকি সবই অনেক পুরনো ঘরবাড়ি।
ব্রেমেনে রয়েছে মজার এক সংস্কৃতি। ব্রেমেনর তরুণ-তরুণীদের ৩০ পেরোনোর আগেই বিয়ে করতে হয়। যদি কেহ সেটা করতে না পারে তাহলে তাঁকে ঝাড় দিতে হয় ক্যাথেড্রালের সিড়ি। সেদিন তার আত্মীয়-স্বজন বা পাড়াপড়শি নানারকম জঞ্জাল এনে ক্যাথেড্রালের সিড়িতে রেখে দেয় বেচারা (অথবা বেচারি) কে সেটা পরিস্কার করতে হয়। এই ঝাড় দেওয়ার পর্বটি চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না কোন তরুণী (অথবা তরুন) এসে ওই ঝাড়ুদারকে চুমো খাচ্ছে!
বাংলাদেশী শিক্ষার্থী ঝুমা আমাদের জানালো সে একদিন একজনকে ৫ ঘণ্টা ঝাড়ু দিতে সে দেখেছে। আমাদের গাইড অবশ্য বলেনি যদি কেহ না আসে তাহলে কী হয়?
মাসির্ডিজ, ম্যাগলেভ ও যুদ্ধাপরাধী
ব্রেমেন শহরে রয়েছে মার্সিডিজ কোম্পানির কারখানা। রয়েছে ম্যাগলেভ ট্রেনের একটি গবেষণাগারও। তব ব্রেমেনহ্যাভেন নামে একটি ছোট শহরে রয়েছে ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত জাদুঘর। রয়েছে জলবায়ু সংক্রান্ত জাদুঘরও। তবে, জার্মানিতে গেলে সবচেয়ে বেশি দরকার ন্যুরেমবার্গ নাজি কসাইখানা জাদঘুর দেখে আসা। জার্মানীর যেকোন শহর থেকে ট্রেনে করে হ্যানোভা হয়ে সে কসাইখানা দেখতে যাওয়া যায়। আইখম্যাডের নেতৃত্বে নাজিরা এই কসাইখানাসহ জার্মানির বিভিন্ন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে লাখো লাখো ইহুদিকে হত্যা করেছে। আমাদের অবশ্য সেখানে যাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। আমাদের দলনেতা ড. মাহবুব সে চেস্টা করেছিলেন। ইন্দোনেশিয়ার দলনেতাকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা কসাইখানা দেখার জন্য বের হোন। আমরা সেদিন অন্য জায়গায় গিয়েছিলাম। কিন্তু রাতে যখন মাহবুব ফিরে আসলেন তখন শুনলাম তারা যাদুঘরের সামনে পৌঁছানোর আগেই সেটা বন্ধ হয়ে যায়।
ওয়াডেন সাগর ও ওয়েঙ্গারুজ
আইএমওতে প্রতিবারই একটা দলবেধে বেড়ানো থাকে। এবারও সেটা হয়েছে। এবার আমাদের নেওয়া হল উত্তর সাগরের একটা দ্বীপে। ব্রেমেনের খুব কাছেই উত্তর সাগর। তারই একটা দ্বীপ ওয়েঙ্গারুজ। সেখানেই আমাদের গন্তব্য। সকালে বাসে করে আমাদের নেওয়া হল হারসিয়েলে। সেখান থেকে বড় বড় কয়েকটা ফেরিতে করে দ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা। ফেরিগুলোতে পর্যটকদের জন্য কিছু বাড়তি ব্যবস্থা আছে। পুরো যাত্রাপথে গাংচিলের নানান ওড়াওড়ি দেখেছি। আর শুনেছি দ্বীপে গিয়ে কী করা যাবে না!!! ওয়েঙ্গারুজের একপাশে উত্তর সাগর আর এক পাশে ওয়াডেন সাগর। ওয়াডেন সাগর আবার ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য। একটা সাগর কেন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ তা বুঝি নাই। তবে, মাইকের কচকচানিতে বুঝলাম এই সাগর জীববৈচিত্রে ভরপুর। এবং জার্মানরা এই ২০০৯ সালেই এটিকে বিশ্বঐতিহ্যের অংশ করেছে। কাজে আমরা যেন কোনভাবেই প্রকৃতির কোন ক্ষতি না করি সেব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে বারবার।
৫ বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপে হাজার খানেক লোক থাকে। আর দিনের বেলায় অনেক পর্যপকও আসে। তবে, দমকলের গাড়ি ছাড়া আর কোন ইঞ্চিনচালিত ব্যক্তিগত বাহন নাই। সবাই হাটতেই অভ্যস্ত। আর দ্বীপের মধ্যে শাটল ট্রেনের ব্যবস্থা আছে। ঘাট থেকে আমরা ঐ ট্রেনে করেই দ্বীপের মাছামাছি পৌছুলাম।
দেখার অনেককিছুই আছে। যেমন দুইটা বাতিঘর। এর একটা নষ্ট। কিন্তু সেটাই সবাই দেখে, কারণ তা ৪৫০ বছরের পুরোনো। দুই ইউরো দিলে সিড়ি বেয়ে একেবারে ওপরে ওঠা যায়। আমার সাহসে কুলালো না।
দ্বীপের মাঝখানকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের জন্য নানানরকম খেলার ব্যবস্থা আছে। আমি গিয়ে জুটলাম কয়েকজন ডেপুটি লিডারের সঙ্গে। তারা দ্বীপ একচক্কর ঘুরে দেখতে চায়। তবে, ব্যাটাদের সঙ্গে আমার পক্ষে পারা সম্ভব ছিল না। ফলে, আমি প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে হাপিয়ে উঠেছি!
বিকেলে আবার ট্রেনে করে ফেরিঘাটে। ফেরি রওনা দেওয়ার একটু পর মাইকে আমাদের জনানো হল পেছনে দেখার জন্য। পেছনে তাকিয়ে আমরা টের পেলাম কেন ওয়াডেন সাগর বিশ্বঐতিহ্যের অংশ। দেখলাম ছোট্ট দ্বীপটি আকারে বেড়ে যাচ্ছে!!! মানে ভাটার কারণে দ্বীপের পানির নিচের অংশ বের হয়ে আসছে। আশে পাশে আরো কয়েকটা দ্বীপও দেখা যাচ্চে। এবং দেখলাম একটাতে অনেকগুলো সিন্ধুঘোটক। দলবেধে আছে। এরা পানির নিচে ছিল আর এখন মুক্ত বাতাসে এসে পড়েছে। আশেপাশের যে দ্বীপগুলো ভেসে উঠছে সেগুলোতে হামলে পড়ছে গাংচিল। লক্ষ্য হলো ভেসে ওঠা পোঁকা এবং জলজ উদ্ভিদ। সেই হিটলারের আমল থেকে স্বল্পভাষী জার্মানরা গর্ব করতে ভুল করে না। আমার মনে হয়েছে তাদের গর্বের জায়গাও অনেক।
নৌকাবাইচ
জার্মানরা তিনবেলাতে পারলে মাখন যায়। তাই তারা একটু গাবদু-গুবদু। তবে, হোদল কুতকুত নয়। কারণ তারা ব্যাপক পরিশ্রমী। হাটা, সাইকেল চালানোর পাশাপাশি নৌকা চালানোতেইও ওরা সিদ্ধ হস্ত। যেখানে নদী সেখানেই ব্যপকভাবে তারা নৌকা চালায়। ট্রেনে করে ব্রেমেন যাওয়া আর আসার পথে অনেক স্থানেই দেখেছি জার্মানরা নৌকা বাইছে।
ফ্রাঙ্কফুর্টের মাইন নদীতে তাই পর্যটকদের জন্য নৌকা করে ঘুরে বেড়ানোর অনেক সুযোগ। সেরকম একটা নৌকা করে আমরা ঘুরে বেড়ানোর সময় দেখেছি নদীর দুই পাড়ের স্থাপনা। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মত জার্মানীতে দুর্গ আর গির্জার ছড়াছড়ি। মাইন নদীর পাড়েও রয়েছে গির্জা। সেখানে রয়েছে ১৯২০ সালের ‘কারওয়ান বাজার’। মানে, ফ্রাঙ্কফুর্টের সবজি আড়ৎ। তবে কয়েক বছর ধরে মূল আড়ত সরে গেছে অন্যত্র। বাজারের এখানে তখন গড়ে উঠবে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন ভবন। তবে, ১৯২০ সালের ভবনকে এই জন্য ভাঙ্গা যাবে না। কারণ সেটি জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ।
মাইন নদীতে ঘুরে বেড়িয়ে আমরা গেলাম রনির বাসায়। আর সেখান থেকে বিমানবন্দর।
ব্যাক টু দি প্যাভিলিয়ন।