বড় মামার ছবি
জরাসন্ধের লৌহকপাট অনেকেই পড়েছেন। জরাসন্ধ ছিলেন জেলার, মানে জেলখানার অধিকর্তা।। ভারতবর্বষের বিভিন্ন জেলখানার গল্প। কোন এক খন্ডে তার সহকর্মী জেলার আবদুল খালেকের কথা তিনি লিখেছেন। খালেক সাহেবের আদিবাড়ি মুর্শিদাবাদে তবে পাকিস্তানে চলে আসেন অপশন দিয়ে। আর চাকরি জীবনের শেষে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার আলাওলের দীঘির পাড় ঘেষে নিজের একটি বাড়ি বানান। সেখানেই এখন শায়িত। তবে, তাঁর জন্য এই লেখা নয়।
খালেক সাহেব মোঘল বাদশাদের কেন জানি বেশি ভালবাসতেন। তার ছেলেদের নাম যথাক্রমে জাহাঙ্গীর, হুমায়ুন, আওরঙ্গজেব, সুজা আর খসরু। ঠিক ধরেছেন মোঘল বাদশাদের নাম। যারা মোঘল বাদশাদের জীবনী জানেন তারা এরইমধ্যে ফাঁকটা ধরতে পেরেছেন। হ্যা। ওনার ছেলেদের নামের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী মোঘল বাদশার নাম নেই!
প্রকৃতি এই ব্যাপারটা কেন মেনে নেবে?
কাজে প্রকৃতি সেটা সংশোধন করে দিল। ওনার বড়মেয়ের স্বামীর নাম আকবর। গোলাম আকবর। আমার বড় মামা। কোন একদিন বড়ো মামার শ্বশুর বাড়ির কারও সঙ্গে ছোট মামার কী বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল। তখন ছোট মামা বলেছিলেন – দেখো তোমাদের ঘরে সব মোঘল বাদশারা। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো বাদশা কিন্তু আমরাই পাঠিয়েছি।
আমার নানা, পূর্ববঙ্গের প্রথম মুসলিম এমবি ডাক্তার, ড. এম এ হাসেম তার ছেলেদের নাম রাখার সময় কেন গোলাম আকবর, গোলাম মোস্তফা রেখেছিলেন সেটি আমার জানা নেই। তবে, আমার বড়ো মামা ছিলেন তার নামের সঙ্গেই মানানসই। মামা খুবই সুন্দর ছিলেন। এমন সুন্দর ছিলেন যে, ছোটবেলায় নানী তাকে লুকিয়ে রাখতেন যেন মানুষের নজর না লাগে!
খুব ছোটবেলায় এক অনুষ্ঠানে নানী একবার একটি কমলা রঙ্গের শাড়ি পড়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে মামা খুবই কান্নাকাটি করেন। কেউ তাঁকে থামাতে পারেনি। তখন কী মনে করে নানী কমলা রঙ্গেরশাড়ি পাল্টে একটা শাদা শাড়ি পরে আসেন। সঙ্গে সঙ্গে মামা চুপ। সেই থেকে বড় ছেলের কারনে নানী কখনো অন্য রঙ্গের শাড়ি পড়েননি। সেই থেকে নানী শাদা শাড়িই পড়তেন!
মামার জন্য ১৯৩৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ৫ বোন আর চার ভাই তারা। ৯ জনের মধ্যে বড়ো মামা চতুর্থ। নানা নিশ্চয়ই চাইতেন তার বড়ো ছেলে ডাক্তার হোন। সেভাবে মামা প্রথমে এলএমএফ এবং পরে এমবিবিএস পাস করেন। তরুন বয়সে মামা ছিলেন অভিনেতা গ্রেগরি পেকের ভক্ত। ইংরেজি সিনেমা, নোবেলের ভক্ত। স্মৃতিও অসাধারণ। উত্তম সুচিত্রার দীপ জ্বেলে যাইতে – এ রাত তোমার আমার গান ব্যপকভাবে হিট হয়। মা’দের সুমারিশে মামা সেই সিনেমা দেখতে চান এবং সিনেমা হলেই তিনি জানিয়ে দেন যে, ঐ গানটি একটি ইংরেজি গানের সুরের নকল (মা আমাকে এটার পুরোটা বলে গিয়েছেন, কিন্ত আমার আর ইংরেজি গানটার কথা মনে নেই)।
মামার সঙ্গে আমরা কিছু সিনেমা দেখেছি মনে হয়। আমার মনে আছে আলমাস সিনেমা হলে আমরা “The Bridge on the River Khawai” দেখেছি।
আমার সেজো খালা ১৯৫৫ সালে চট্টগ্রামে একটা পত্রিকা সম্মাদনা করতেন, মাসিক কল্লোল। সেই পত্রিকারজন্য ছবি তলতেন ভাস্কর নভেরা আহমেদ। বড় মামা সেই পত্রিকা প্রকাশে সহায়তা করতেন।
আমার বুদ্ধিসুদ্ধি হওয়ার আগেই আমার নানা মারা যান। কাজে মামা আর নানার একসঙ্গে কোন স্মৃতি আমার নেই। বড় মামার একটা কালো (??) রঙ্গের একটা গাড়ি ছিল। ১৯৭১ সনে আমরা শহর থেকে পালিয়ে যখন রাউজান যাই, তখন মামা গাড়ি চালিয়ে গিয়েছিলেন। এটা কি মনে আছে না পরে শুনেছি সেটা বলতে পারবো না।
মামা নানার সমাজসেবাটা খুব ভালোভাবে পেয়েছিলেন। ফলে, বেশিরভাগ দিনই মামাকে রোগীরা কোন টাকা না দিয়ে চলে যেত। মামা সেটি মনে রাখতেন না।
ছোটবেলায় মামাই আমাদের চিকিৎসা দিতেন। আমরা থাকতাম নানার বাড়ির দোতলায়। কাজে মামারবাড়ির আবদারতো আমাদের ছিলই। ১৯৭১ সালে কাপাশগোলায় যে বাড়িটাতে আমরা থাকতাম রাজাকাররা সেটি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তখন টেম্পোরারিলি আমরা নানার বাড়িতে চলে আসি। পরে সেখানেই থেকে যাই ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত।
তো, মামা খুব সৌখিন ছিলেন আর ছিলেন চেইন স্মোকার। খেতেন ক্যাপস্টান আর ব্রিস্টল সিগারেট। সকালে তার কেবল একটা দিয়াশলাই কাঠি লাগতো। দিনভর আর লাগতো না। অথচ কী আশ্চর্য মামা যেদেন সিগারেট খাওয়া ছাড়লেন সেদিন একবারেই ছেড়ে দেন। আর কখনোই খাননি। মনের জোর তার এমনিই ছিল। তবে, মনটা ছিল খুব নরম। বিশেষ করে খুব কাছের কোন আত্মীয় স্বজনের কঠিন অসুখ হলে মামা নার্ভাস হয়ে যেতেন, ভয় পেতেন।
মামা বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন, চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, চট্টগ্রাম মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি, কদম মোবারক স্কুলের সহসভাপতি ছিলেন। আরও কিসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে, আমার ঠিক মনে নেই।
আমি যখন ভার্সিটিতে পড়ি তখন নবীন মেলা একটি ফ্রি সানডে ক্লিনিক চালু করার চিন্তা করে। নবীন মেলার সভাপতি জামাল উদ্দিন বাবুল প্রথমই মামার কাছে যান আর মামা সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে যান। তারপর দীর্ধদিন মামা একাই ঐটা চালাতেন আর পরে অন্য ডাক্তার যোগ দেন। এখনও সেটি চালু আছে।
আমার কাছে বড় মামার কোন ছবি নেই। আমি খুঁজিও নাই। মামার কথা ভাবলেই আমি মামাকে দেখতে পাই। সেই ছবিটাই আমার কাছে থাকুক।
আল্লাহ মামাকে বেহস্ত নসীব করুক।