আমার বইমেলা ২০২৩-২ : আদর্শ হিন্দু হোটেল

Spread the love

“হরিচরণবাবু বলিলেন – এই দেখ। তোমার বয়সে আর আমার বয়েসে – খুব বেশি তফাৎ হবে না। তোমারও প্রায় পঞ্চাশ হয়েছে। না হয় এক আধ বছর বাকি। কিন্তু তোমার জীবনে উদ্যম আছে, আশা আছে, মনে তুমি এখনও যুবক। কাজ করবার শক্তি তোমার অনেক বেশি এখনও। এই বয়সে বম্বে যাচ্ছ, শুনে হিংসে হচ্ছে হাজারি। বাঙ্গালির মধ্যে তোমার মত লোক যত বাড়বে ঘুমন্ত জাতটা ততই জাগবে। এরা পয়ক্রিশ বছর বয়েসে গলায় তুলসীর মালা পরে পরকালের জন্য তৈরি হয়- দেখছ নাআমাদের গাঁয়ের দশা? ইহকালই দেখলি নে, ভোগ কররি নে, তোদের পরকালে কি হবে বাপু? সেখানেও ভূতের ভয়। পরকালে নকরকে যাবে। তুমি কি ভাবো অকর্ম, অলস, ভীরু লোকদের স্বর্গ জায়গা দেন নাকি ভগবান?”

-আদর্শ হিন্দু হোটেল, বিভূতিভূষন বন্দোপাধ্যায়

এক সহস্র নয় শত ষষ্ঠ আশি সালের ফাল্গুন মাসের ২ তারিখে কোনো টিনের তোরঙ্গ নয়, কোন শক্তমক্ত বিলাতী স্যুটকেস নয়, কাঁধে ঝোলানো যায় একটি বড়সড় ব্যাগ ও একটি কাপড়ের মার্শাল ব্যাগ লইয়া কমলাপুর রেলস্টেশনে আমি আসিয়া নামি। ব্যাগ দুইখান ছাড়াও খবরের কাগজ দিয়ে মোড়ানো দড়ি দিয়ে বাঁধা একখানা তোষকও আমার সঙ্গে ছিল। সেটি মাথায় লইয়া দুই কাঁধে দুই ব্যাগ লইয়া আমি এই জাদুর শহরে আইসা পরি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গ্রামের সন্তান এর আগে কয়েকবার ঢাকা শহরে আসিলেও এবারের আসাটি ভিন্নরকম। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় নামের একটি বাঁশবাগানে নিজেক সঁপিয়া দিতে আসিয়াছি। রেলস্টেশন হইতে খালার বাসা হইয়া বৈকাল বেলা ঐ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাইবার জন্য রিকশা খুঁজিয়া হয়রান। রিকশাওয়ালারা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বলিয়া কিছু চিনে না। রহমতগঞ্জের কালাম ভাই বলিয়াছিল পলাশী। সেই সঙ্গে বলিয়াছিল – সিরাজদৌলার কথা মনে করিলে পলাশী নাম মনে পড়িবে। সেই পলাশীর কথা কহিয়া রিকশা যোগে আহসান উল্লাহ হল খুঁজিয়া লইলাম। হলের গেটে ব্যাগ, তোষক নামানোর পর রিকশাওয়ালা কহিল – এঞ্জিনারিং ইনভার্সিটি কইলেই তো এতো ঘোরান লাগিতো না!!!

বুঝিলাম, নয়া এক জগতে আসিয়া পরিয়াছি। তখন কি জানিতাম এই বাগানেই আমার জীবনের অষ্টাদশ বর্ষ কাটিয়া যাইবে। আহসান উল্লাহ হলের তিনতলার টেলিভিশন কক্ষের পাশে একটি ছোট কক্ষ হইয়া উঠে আমার তীর্থস্থান। ছোটবেলা হইতে যে সকল বই যোগাড় করিতে পারি নাই তাহার প্রায় সকলই সেখানে পাওয়া যায়। শিবরামের রচনাবলী, মানিকের রচনাবলী, বিভূতিভুষনের নানা বই সকলই সেখানে আছে। এঞ্জিনারিং ছাত্রদের সাহিত্য হইতে মনে হয় দূরে থাকিতে হয়। কাজে অচিরেই গ্রন্থগারিকের সঙ্গে আমার ভালই সখ্য গড়িয়া উঠিল। চতুর্থ বর্ষে পদার্পনের আগেই কয়েক আলমিরা গ্রন্থের সকলই আমি গলাধকরণ করিয়া ফেলিলাম। এ কথাগুলান অবশ্য আমার বাঁশবাগানের স্মৃতিকথা পড়ো পড়ো পড়ো বইতে আছে।

কিন্ত কী আশ্চর্য সেখানে এই গ্রন্থ ছিল না। আমিও তাই এই আশ্চর্য আখ্যানের রস হইতে বঞ্চিত হইয়াছি  বেশ কিছুকাল পর্যন্ত। এরই মধ্যে কয়েকবছর আগে পুত্রের পাল্লায় পরিয়া পলো কোয়েলো নামের এক লেখকের আলকেমি নামে একটি বই পড়িবার সৌভাগ্য হইয়াছিল। এরও এক দশক আগে ফিকশনের পরিবর্তে অফিকশন পড়িবার ঝোঁক আমার বাড়িয়া যাওয়াতে নতুন-পুরাতন গল্প উপন্যাস পড়াতে নেহায়েতই খামতি হইয়া গিয়াছে। কিন্তু গোগ্রাসে আলকেমি পড়িবার পর মনে হইতো আহা চাকরি না খুঁজিয়া চাকরি দেওয়ার মন্ত্রের উদ্যোক্তা হইবার এমন কাহিনী কেন আমাদের বাংলা সাহিত্যে নাই। কেনই বা কেবল পুতু পুতু প্রেম কিংবা ‘লোহা তপ্ত হইলেই তখন বাড়িটা মারিতে হয় বলিয়া” কুসুম কেন শশীবালাকে পরামর্শ দেয়। কেনই বা ভাত বেশি খাইতো বলিয়া বড় ভাই-এর গঞ্জনা সহ্য করিতে না পারা যুবকের কলকাতায় বাণিজ্য ভবন গড়ার গল্প কেউ লেখেন নাই। আলকেমির দুই একখান অনুবাদ উল্টাইয়া পাল্টাইয়া মনে হইয়াছে নিজেই অনুবাদ করিয়া ফেলাই। কিন্তু সেও আর হয়ে উঠলে না নে।

তবে, সেই দু:খ এখন আর নাই। আমার বাঁশবাগানের অন্যতম প্রিয় শিক্ষক আনিসুল হক স্যারের একখানা পোস্টে আদর্শ হিন্দু হোটেল সম্পর্কে খান কতক লাইন দেখিতে পাই। তারও কিছুকাল আগে হইতে এই বই সম্পর্কে কিয়ৎ জানিয়া আফসুস ক্রমাগত বাড়িতে ছিল। স্যার কহিলেন – মুনির, তোমার এটি অবশ্য পাঠ্য। বাজারে মুদ্রিত কপি পাওয়া যায়। এর পরই কারওয়ান বাজারে প্রথমার বিপনী কেন্দ্রে নিজের গণিত পুস্তকের খবর লইতে যাই। তখনই কথা প্রসঙ্গে জানিতে চাহিলে সনাতন হাসিয়া কহিল – আদর্শ হিন্দু হোটেল আর ইন্দু বালা খাবার ঘর দুই হোটেলের খাওয়াই আপনাকে খাইতে হইবে।

ভাবিলাম আদর্শ হিন্দু হোটেল তথা হাজারীর হোটেলে এ বেলা খাইয়া লই। সে আগ্রহে  আমার হিন্দু হোটেলে অভিযান। এবং হোটেলের অভিযানের কারণে কন্যাকে এক সকালে একা একা স্কুলে রওনা করাই দিয়া নিজে সকালের ঘুম নষ্ট করিয়া গ্রন্থখানা সম্পূর্ণ পড়িয়াও ফেলিয়াছি। এবং তাহার পর হইতে এক আশ্চর্য ভাবের উদয় হইয়াছে। প্রথমত বাংলা সাহিত্যের উদ্যোক্তা বানাইবার কারিগর মূলক এই উদ্দীপনা মূলক গ্রন্থটি কেন আমি এতদিন কাহারও বাসা হইতে মারিয়া দিতে পারি নাই সেটা নিয়ে নিজেকে শাপ-শাপান্ত করিলাম।

তারপর আমি বুঝিলাম ব্রাজিলের ঐ লোক আলকেমি লেখার রসদ কোথা হইতে পাইয়াছে। ব্রাজিলে গিয়ে তাহার বাসার সামনে গেলেও তাহার সঙ্গে দেখা হয় নাই কারণ ঐ ব্যাটা নিজের বাড়িতে না থাকিয়া ইউরোপের কোথায় জানি থাকি। কিন্তু এখন আমি নিশ্চিত যে আলকেমির উৎসখানা এই গ্রন্থ।

এই বইখানার কাহিনীটি সংক্ষেপে এরকম- রানাঘাটের বেচু চক্রবর্তীর হোটেলের পাচক হাজারি দেবশর্মার রান্নার হাত খুবই ভাল। দূর দূরান্তের লোকেরা তার খাবার খাইয়া পরিতৃপ্ত হয়। হাজারী নিজেও একদিন একা একটা হোটেল দেওয়ার কথা স্বপ্নে ভাবে। সে জন্য নিজেকে তৈরি করে। যেহেতু বেচু চক্তোতীর হোটেলের অন্য কর্মচারীরাও বাঙ্গালি কাজেই তাহাদের ষড়যন্ত্রে হাজারীর চাকরি চলিয়া যায়। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় হাজারী নিজেই একটা হোটেল খুলিয়া বসে। তারপর আর তাহার পিছন ফিরিয়া তাকাইতে হয় নাই। সে তর তর করিয়া বড় উদ্যোক্তায় পরিণত হইয়াছে।

বিভূতি বাবু তার আশ্চর্য সাবলীল গদ্যে একজন ছয়-চল্লিশ বছরের তরুণের যে কাহিনী আমাদের সামনে তুলিয়া ধরিয়াছেন সেটি এক কথায় অনন্য। না কেবল কাহিনীখানা নয়। বরং তার কুশলী বর্ণনা, প্রেক্ষাপট তৈরি করা এবং শেষ পর্যন্ত উদ্যোক্তার জয়রথ উড়াইয়া হাজারীকে বোম্বের রেলে তুলিয়া দেওয়া পর্যন্ত থামিবার কোন সুযোগ নাই।

এই বই যদি আমি আগে পড়িতাম তাহলে কষ্ট করিয়া বিলাতের তিন তরুণের শরবত কোম্পানি খুলিবার গল্প ‘শরবতে বাজিমাত‘ আদৌ লিখিতাম না। শরবতে বাজিমাত বই-এ যেভাবে তিন তরুণের ধাপে ধাপে সফল হওয়ার কাহিনী বিবৃত হইয়াছে, এই গ্রণ্থেও অনুরুপ ধাপে ধাপে সকল পর্যায় বর্ণিত হইয়াছে। শরবতে বাজিমাতে আমরা দেখিয়াছি তিন তরুণকে কেউ অনুপ্রাণিত করে না। বরং সকলে তাহাদের দ্বারা যে এই কাজ হইবে না সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করিয়াছে। কিন্তু তাহাতে না দমিয়া তিন তরুণ নানাভাবে চেষ্টা চরিত্র করিয়া অবশেষে প্রশান্ত মহাসাগরে ব্যক্তিগত দ্বীপের মালিক হইয়াছে। শরবতে বাজিমাত বইতে উদ্যোক্তাদের জন্য প্রয়োজনীয় দাদীমা টেস্ট, এ/বি টেস্ট, দোরগোড়ায় মার্কেটিং, টিম বানানোর ফন্দী সকলই যথাযথভাবে বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু যেহেতু তাহারা নিজেরাই অবিবাহিত ছিল তাই বাংলার শ্বশুর-জামাতা ডুয়োর ব্যাপারটা সেখানে নেই। কিন্তু আদর্শ হিন্দু হোটেল যেহেতু বাঙ্গালীর তাই সেখানে হাজারীর জামাতা খোঁজার ব্যাপারটিও একটি বিশেষ মাত্রা পাইয়াছে।

পরিশেষ ইহা বলিতে কোন আপত্তি নাই যে, যে আলকেমী পড়িয়া বাঙ্গালী উদ্যোক্তা হইবার রসদ পাই তাহাদের কাছে এটি একটি স্বর্ণ খনিই বোধ হইবে।

যাহারা উদ্যোক্তা হইবে বলিয়া পণ করিয়াছে, যাহারা পশ্চিমের একদল তরুণ উদ্যোক্তাকে নিজেদের আইডল বলিয়া মানিয়া লইয়াছে এবং যাহারা এই উদ্যোক্তা হইবার ব্যাপারটিকে মানিয়া লইতে পারিতেছে না তাহাদের সকলের উচিৎ এই গ্রন্থখানার রস আস্বাধন করা।

 

Leave a Reply Cancel reply