বইমেলার বই-২: ব্যাটারি রিচার্জিং
গণিত অলিম্পিয়াড নিয়ে সারাদেশের হাইস্কুলের পড়ুয়াদের সঙ্গে আমার জানাশোনা দেড়যুগেরও বেশি। ক্রমান্বয়ে তাতে যুক্ত হয়েছে বিজ্ঞান, প্রোগ্রামিং ও হালের আইওটি। এসব করতে গিয়ে গিয়ে লক্ষ লক্ষ এগিয়ে থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে আমার প্রতিনিয়ত দেখা হয়, তাদের স্বপ্নের কথা জানতে পারি, তাদের চেষ্টায রসদ জুগিয়ে যেতে কাজ করি। গণিত ক্যাম্প, প্রোগ্রামিং ক্যাম্প, অনলাইন কোর্স এরকম নানান উদ্যোগের মাধ্যমে তাদের এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি আমরা। এরা এমনিতেই একটু এগিয়ে থাকে। ফলে আমাদের সাহচর্য, উৎসাহ এবং পথ-দেখানোর সুযোগে তারা আরও এগিয়ে যেতে পারে।
অথচ যারা একটু পিছিয়ে গেছে, ভালো অবস্থান থেকেও কোন কারনে খেই হারিয়ে ফেলেছে তারা কি হতাশ হয়ে বসে থাকবে? তাদের জন্যও কি কিছু করা যায় না। একবার ভেবেছিলাম এমন একটা কিছু করার। ভেবেছিলাম একটা বি-টিম বানাবো। সেরকম একটা ঘোষণাও দিয়েছিলাম একটি প্রোগ্রামে যে যারা নিচের থেকে ১০ পর্যন্ত হবে তাদের সঙ্গে আমি কাজ করবো। তেমন সেরকম আগ্রহী কাউকে পাওয়া যায়নি।
ব্যটারি রিচার্জ করার অনেক বুদ্ধি আছে। জাফর ইকবার স্যার বলেন গণিত অলিম্পিয়াডের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সময কাটালেই ওনার ব্যাটারি রিচার্জ হয়ে যায়। কিন্তু ঝিমিড়ে পড়াদের ব্যাটারি কীভাবে চার্জ করা যায়?
সেই কাজটি করার জন্য হাবলু দ্য গেট ঝংকার মাহবুব ফেলেছ নতুন বই। ডাউন হয়ে যাওয়া ব্যাটারি রিচার্জ করতে ঝংকার মাহবুবের এই বই – রিচার্জ your ডাউন ব্যাটারি। পরিশ্রমী পোলাপান দিনের পর দিন সাধনা করে যে দক্ষতা অর্জন করে, যে জ্ঞান অর্জন করে অলসরা সেটাকেই ট্যালেন্ট বলে। সেজন্যই কলেজের মেধাবী স্টুডেন্টরা ভার্সিটিতে গিয়ে, পরিশ্রম করা ছেড়ে দেয়, খেই হারিয়ে ফেলে। কারণ বিভিন্ন কারনে তাদের ব্যাটারির চার্জ কমে যায়। এই ব্যাটারির চার্জ কমে যাওয়ার পরেও যাতে আবার লাইনে ফেরত আসে সেজন্যই – ‘রিচার্জ your ডাউন ব্যাটারি’ বইটা।
শুধু ট্যালেন্ট নিয়ে নয় বরং কেউ তার পছন্দের সাবজেক্ট পড়ার সুযোগ না পেলেই যে তার স্বপ্নের সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়তে পারবে না তার জন্য সে ঝংকার লিখেছে- সাবজেক্ট ক্যারিয়ারের জন্য বেরিয়ার বা বাধা না। কারণ এখন অনেকেই সাহিত্যের সাবজেক্টে না পরে লেখক হচ্ছে। আমাদের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ রসায়নের ছাত্র, জাফর ইকবাল স্যার পদার্থ বিষয়ে পড়ালেখা করেছেন। আমাদের দেশের অনেক সাংবাদিক, অনেক প্রোগ্রামার, অনেক গায়ক, ব্যবসায়ী যে জিনিস নিয়ে প্রতিদিন কাজ করে যাচ্ছে সেই রিলেটেড সাবজেক্টে পড়ালেখা করেনি। তাই তুমি যদি তোমার সাবজেক্টের বাইরে অন্য কোন ফিল্ডে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাতে চাইলে তোমাকে নিজের পড়ালেখা ঠিক রেখে বাড়তি সময় দিতে হবে। প্রোগ্রামার হাসিন হায়দার পড়েছে সিভিল ইঞ্চিনিয়ারিং-এ।
এই রকম প্রায় চল্লিশটা বিভিন্ন পরিস্থিতি নিয়ে বই লিখেছে যার মধ্যে আছে কেউ নিঃসঙ্গ অনুভব করলে কি করবে, কীভাবে রিস্ক নিবে, কনফিডেন্স কীভাবে বাড়াবে, কীভাবে বুঝে উঠবে বন্ধুদের মধ্যে কে ভাইরাস আর কে ভিটামিন। আবার কেন কেউ চাকরি করে কখনোই ধনী হতে পারবে না। বিজনেস করতে চাইলে কিভাবে শুরু করতে হবে। ভালো না লাগার রোগ, ছুতা ধরা রোগ এ ধরলে কিভাবে কনফিডেন্সের বড়ি গিলবে। কীভাবে ছোট ছোট প্লানের তাবিজ ধরবে।
একটু পিছিয়ে পড়েও কিভাবে মরা ইঞ্জিনের কেরামতি দেখাতে পারবে।
সবচেয়ে ভালো লেগেছে বইয়ের শেষের দিকটায় এসে। সেখানে ব্যাটারি চার্জ মাপার জন্য সত্যি সত্যি একটা ব্যাটারি দিয়ে দেয়া হয়েছে। তারপর কিভাবে লাইনে আনতে হবে। কী কী স্টেপে কাজ করতে হবে, রুটিন বানাতে হবে, আত্মদিবস পালন করতে হবে, স্পেশাল ছুটির দিনগুলো কাজে লাগাতে হবে সেটার জন্য একদম নিরীক্ষা ধর্মী কাজের কাজের ধাপগুলো দিয়ে দিয়েছে।
আগেই বলেছি আমাদের মুনির এন্ড মুনির শো ঝংকার এর ইন্টারভিউ দিয়ে শুরু করছিলাম। তার যে দীর্ঘ একটা ইন্টারিভউ আমি আর ফারদীম নিছিলাম সেটা থেকে মনে হয়েছে সে যেভাবে পিছিয়ে পড়ে আজকের অবস্থানে আসতে পারছে সেই ধাপগুলো। সেই অনুপ্রেরণাগুলো, সেই সিক্রেটগুলোই সে বলে দিয়েছে এই বইতে। অন্যদের ব্যাটারি ডাউন হয়ে বসে থাকুক সেটা চায় না সে।
https://www.youtube.com/watch?v=Gz6g_BR8X9A
কঠিন রসকসহীন কথাগুলো গল্প আর সাবলীলভাবে উপস্থাপন করায় পুরা বইটা আমার কাছে প্রাণবন্ত মনে হয়েছে। জীবনের ভয়, বাঁধাগুলো অতিক্রম করার উপায় কখনো একজন কাছের বড় ভাই-এর মুখ থেকে আবার কখনো নিজের উপলব্ধি থেকে প্রকাশ করায় গাইডলাইনগুলো অনেক বেশি বাস্তব, কার্যকরী মনে হয়েছে।
এই বইটার পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করার আগে ঝংকার সেটা আমার কাছে পাঠিয়েছিলো আমার মন্তব্য আর বইয়ের মুখবন্ধ লিখে দিতে। তখন আমার মনে হয়েছে- দেশের লাখ লাখ পিছিয়ে পড়া তরুণদের যারা ঘুরে দাড়াতে চায় তাদের জন্য এই বই। কারণ হাবলুদের শুধু প্রোগ্রামিং শিখলেই হবে না। তাদের হেঁচকা টান দিয়ে সামনে এগুতে হবে। আটকে গেলে জোরসে ঠেলা দিতে হবে। আবার যারা হতাশ হয়ে ভেঙ্গে পড়েছে, তাদেরকেও এই বই বিদ্যুৎপৃষ্ঠের মতো চমকে দিতে পারে। তারা গা ঝাড়া দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অনেক প্রণোদণা পাবে।
এই বইটা আসলে সবার জন্য দরকার। কারণ যখন তখন কিন্তু ব্যাটরি ডাউন হতে পারে যে কারোরই।
বইটি প্রকাশ করেছে আদর্শ। পাওয়া যাচ্ছে বইমেলার আদর্শ-এর স্টল ৩২৬-৩২৮ নং স্টলে। মেলাতে গিয়ে কিছুদূর ঢোকার পর হাতের বামদিকে ৬ নং চত্ত্বরে এই স্টল।
আর পাওয়া যাবে রকমারিতে।