ভিক্ষার বাটি!!!
এসব কিন্তু রাজাকে যে বড় অহংকারী করেছে তা নয়। রাজা দয়াশীল ও দানশীল। তবে, দান-খয়রাত করার জন্য সেরকম ভিক্ষুকও আবার সে দেশে নাই। তাই মাঝে মধ্যে রাজা এ নিয়ে একটু হয়তো মন খারাপও করে থাকেন।
যদিনের কথা বলছি। সেদিন ভোররাতে প্রবল বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর প্রকৃতির এক সুন্দর পরিবেশ। রাজামশাই ভাবলেন – তিন হাটতে বেরোবেন। সাঙ্গপাঙ্গদের একটু দূরে রেখে রাজা তাই হাটতে বের হলেন।
দূর থেকে দেখলেন এক ভিখারী। রাজা খুশি হলেন। তার সামনে গিয়ে রাজা বললেন- তুমি কী চাও?
হাসতে হাসতে ভিখারী বললো- আপনি এমনভাবে বলছেন যেন মনে হয় আপনি আমার সাধ পূরণ করতে পারবেন!
রাজা একটু রাগই করলেন। ব্যাটা মনে হয় এ রাজ্যে নতুন। বললেন- অবশ্যই আমি পারবো। কী সেটা?
ভিখারী রাজাকে সতর্ক করে দিয়ে বললে- রাজা মশাই, কোন প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আগে বার দুই ভেবে নিলে হতো না!
ভিখারী বললো- খুবই সাধারণ আমার সাধ। আপনি কি আমার এই ভিক্ষার বাটিটি পূর্ণ করে দিতে পারবেন!”
রাজামশাই অবাক হলেন। তারপর তার খাজাঞ্চিকে ডেকে বললেন – ভিখারীর ভিক্ষার বাটিটি টাকা দিয়ে পূর্ণ করে দাও।
পাত্রটি ছোট দেখে খাজাঞ্চি দুই মুঠো স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে এসে ঐ বাটিতে ঢেলে দিল। তার ধারণা ছিল স্বর্ণমুদ্রার কয়েকটি বাটি উপচে পড়বে।
টাকশালের লোকেরা দৌড়ে আসলো। পাইক পেয়াদাও আসলো। বাটি উল্টে পাল্টে দেখা হলো না গোপন কোন সুড়ঙ্গ নেই। কাজে আবার সবার সামনে ঢালা হলো। কিন্তু না, ভিক্ষার বাটি খালিই থাকলো!
মূহুর্তের মধ্যে সারাদেশে রটে গেল, রাজার সম্পদ দিয়ে এক সামান্য ভিখারীকে তুষ্ঠ করা যাচ্ছে না। রাজাও রেগে গেছেন। বললেন – যা কিছু আছে সব কিছু নিয়ে এসে ঐ বাটিতে রাখতে।
যাই রাখে সেটাই উধাও হযে যায়। দুপুর নাগাদ রাজভান্ডার ফুরিয়ে গেল কিন্তু বাটির কোনাও ভরলো না।
সমস্ত ভিড় নিশ্চুপ। পিন ড্রপ সাইলেন্স।
কী আর করা। রাজা মশাই ভিখারীর পায়ের উপর পড়লেন – আপনি জিতেছেন। কিন্তু চলে যাবার আগে আমার কৌতুহল নিবারণ করে যান। এই ভিক্ষার বাটির গোপন রহস্য কী?”
বিনম্রভাবে ভিক্ষুক উত্তর দিলে -এর কোন গোপন রহস্য নেই। এটি কেবল মানুষের বাসনা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে!!!
…
….
“কি, মুনির মিয়া, আয় রোজগার কেমন হচ্ছে?”
প্রফেসর আলী মূর্ত্তাজা স্যার বুয়েট কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক। আমার কাছে একদিন জানতে চাইলেন। বেতনাদি ছাড়াও আমি তখন পরামর্শ সেবা দিয়ে ভালই আয় রোজগার করি। আগের বছরের হিসাবটা জানা ছিল। সেটার গড় করে মাসিক ফিগারটা স্যারকে বললাম।
স্যার বললেন, “বাহ। ভালো তো। চলে যাচ্ছে তো?”
হ্যা বলতে গিয়ে একটু থামলাম। গাড়ি কিনেছি নতুন, কিন্তু সেটা কনজিউমার ক্রেডিট স্কিমে। যে বাসাটায় থাকি সেটা ছোট, যদিও একা মানুষ হিসাবে খারাপ না। ব্যাচেলর বলে কেউ বাসা ভাড়া দেয় না, তাই বনানী কাকলি ডিওএইচএসে গ্যারেজের ওপর থাকি। এদিক সেদিক যাই। কিন্তু বেশি ঘোরাঘুরি নাই। বিদেশ যাওয়া হয় নাই।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম – না, স্যার। পোষাচ্ছে না। মাসে আরও ১০ হাজারের মতো বাড়ানো দরকার।
স্যার বললেন – কী করবা তাইলে?
বললাম – স্যার, বিজনেজ ডেভেলপমেন্ট বাড়ায় দেই। কয়েকটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। এগুলোকে কাজ বানাই ফেলি।
“ঠিক আছে। করো”।
স্যার চলে গেলেন। আমি পূর্ণদ্যমে কাজে লেগে গেলাম।
মাস ছয়েক পরে, স্যার আমাকে আবার ধরলেন – কী মিয়া, হইছে তোমার ১০ হাজার বাড়তি!
“জি, স্যার। একটু বেশিও হয়েছে। তবে, স্যার অফিসে বেশিক্ষণ থাকতে হয় এ আর কি।“
“তো, এখন তো তাহলে তোমার প্ল্যান মাফিক সব হচ্ছে?”
হ্যা, বলতে গিয়ে আবার আটকে গেলাম। তাইতো, চট করে মনে হলো কী কী করা যাচ্ছে না, টাকার জন্য। একটা স্টেশন ওয়াগন গাড়ি চালাই। আসলে তো দরকার একটা করোলা এক্সিভ! এবারও বেড়ানোর জন্য সিঙ্গাপুর যেতে পারলাম না।
আমার চেহারা দেখেই স্যার আঁচ করলেন। বললেন, হুম বুজছি। তোমার আরও টাকার দরকার।
একটু সময় নিয়ে তারপর বললেন, “দেখো মুনির। তুমি একন আরও খাটতে পারো। কনসালটেন্সি বাড়িয়ে আরও টাকা কামাতে পারো। কিন্তু ছয় মাস পরে তোমার মনে হবে আরও টাকার দরকার। এটি একটি নেভার এন্ডিং প্রসেস। তুমি কখনোই নিজেকে তুস্ট করতে পারবে না”।
স্যারের কথা আমার মর্মে। আমি ভাবছি কথা সত্য। কিন্তু আমি কী করবো? আমার বন্ধুরাতো কেউ স্টেশন ওয়াগন চালাচ্ছে না। আমি কেন চালাবো?
স্যার বললেন,”এই ইদুর দৌড়ে তুমি কখনো শান্তি পাবে না। শান্তির জন্য তোমার ভাবতে হবে উল্টো করে। তোমার যা আছে তাই দিয়ে তুমি চলতে পারো কিনা চেষ্টা করে দেখো। অন্যদের দেখে নিজের প্রয়োজনের হিসাব করার দরকার নাই। তোমার কী দরকার সেটি দেখো। তুমি একটু আধটু লেখো, সেখানে সময় দাও। ছুটির দিনে রাত ৮-১০টা যে সফটওয়্যার বানানোর কাজটা করো সেটা ছেড়ে দাও। পড়াশোনা করো। বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতে চাও, সেটা করো। যা করলে শান্তি পাও সেটাই করো। অহেতুক টাকার পেছনে দৌড়ানোর দরকার নাই। যখন তুমি টাকার পেছনে না দৌড়ে তোমার উদ্দেশ্যের পেছনে দৌড়াবে দেখবে তখন তোমার সব হবে এবং তুমি শান্তিও পাবে”।
স্যারকে সেদিন কী বলেছিলাম মনে নেই। কিন্তু স্যারের প্রতিটি কথা আমার মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। সেদিনই আমি বুঝেছিলাম – জীবনের পারপাসটাই আসল। অহেতুক টাকা, খ্যাতির পেছনে দৌড়ে কোন লাভ নেই।
তারপর থেকে আমি গণিত অলিম্পিয়াডসহ আমার পছন্দের সব কাজে ঝাপিয়ে পড়লাম। এখনো অনেকেই যখন শুনে আমি প্রকৌমল বিদ্যা বাদ দিয়ে এসব করে বেড়াই তখন অবাক হয়। আমি আজকাল ব্যাখ্যাও করি না। জানি, আমি যা করছি তা আমার জন্য শান্তির।
তবে, সব ছাপিয়ে ঐ শাদামাটা আলী মূর্ত্তাজা স্যারের কথাটাই মূর্ত হয়ে উঠলো।
আজ মনে হচ্ছে, আমার আত্মানুসন্ধানের দ্বিতীয় পর্ব করো করো করো’র কাজটা আবার শুরু করা দরকার।
তবে, এও জানি তখনই আমি কাজটা করতে পারবো যখন জানবো ওতেই আমার সুখ, ওতেই শান্তি। কাজে তাড়াহুড়া করার দরকার নাই।
“জীবন মানে নিজেকে খুঁজে পাওয়া নয়, জীবন হলো নিজেকে তৈরি করা (Life isn’t about finding yourself. Life s about creating yourself.” জর্জ বার্নাড শ’র এ কথাগুলো সেদিন জানতাম না। তবে, যা বুঝেছি সেটা সেদিনই বুঝে ছিলাম।
সবার জন্য ভালবাস।
One Reply to “ভিক্ষার বাটি!!!”
Leave a Reply Cancel reply
You must be logged in to post a comment.
Very practically written but in a simle and nice way. I really enjoy to read your wrute up.